ক’দিনের ইউরোপ সফরে শরীর ও মন ক্লান্তিতে অবসন্ন ছিলো। তাই মক্কায় হোটেলের বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই হারিয়ে গেলাম ঘুমের গভীরে। এক সময় ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি বেলা ১০টা বাজতে চলেছে। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে রওনা দিলাম রেষ্টুরেন্টের দিকে। বিদেশ যাত্রার সময় যখনই হোটেল বুকিং দেই সাথে ব্রেকফাস্ট অন্তর্ভূক্ত রাখি। এতে খরচ একটু বেশী হলেও সময় বাঁচে। তবে হোটেলের ব্রেকফাস্ট খেতে হলে সময়মতো হাজিরা দিতে হয়।
৫টি ভবন নিয়ে আমার বিশাল হোটেলটিতে ৪৭৬টি ডিপ্লোমেটিক রুম, ১২০টি এক্সিকিউটিভ স্যুট, ৬০টি রয়েল স্যুট, একেকটা ভবনে একেক ধরনের রেষ্টুরেন্ট। কোনটা এশিয়ান, কোনটা মরোক্কান, কোনটায় বা মধ্যপ্রাচীয় দেশের খাবার। রুম থেকে বেরিয়েই সাইন চোখে পড়লো এশিয়ান রেষ্টুরেন্টের। সময় থাকলে হয়তো খুঁজে পেতে অন্য দেশীয় খাবারের স্বাদ নিতাম। কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য খোঁজাখুঁজিতে না গিয়ে এশিয়ান রেষ্টুরেন্টেই রওনা হলাম। রেষ্টুরেন্ট এখনো খোলা আছে কিনা জানতে চাইলে একজন ওয়েটার খাটি বাংলায় জবাব দিলো সমস্যা নেই। তারা আমাকে বুফে খাবার দেখিয়ে দিলো। বিশাল আয়োজন। রেষ্টুরেন্টে বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, ভারতীয় এবং বার্মার সব স্টাফ। এই শিফটের ম্যানেজার একজন পাকিস্তানী। কিচেনেও কয়েকজন বাংলাদেশী কাজ করেন। বুফের বাইরে কিচেন থেকে বিশেষ কোন খাবার বানিয়ে আনবে কিনা জানতে চাইলে আমি তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিলাম হেরেম শরীফের দিকে।
হোটেলের শ্যাটল প্রতি ১৫ মিনিট পরপর হেরেম শরীফের দিকে ছেড়ে যায়। আমি উঠতে না উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো। যাত্রীদের প্রায় সবাই এহরাম পড়া, মুখে তালবিয়া (লাব্বায়েল আল্লাহুমা লাব্বায়েক…….)। অল্পক্ষণেই পৌছে গেলাম হেরেম শরীফের গেটে। এক্সেলেটর দিয়ে একটু উপরে উঠলেই হেরেম শরীফ চত্ত্বর। তারপর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই পবিত্র কাবা শরীফ। সারা দুনিয়ার মুসলামানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান এই বায়তুল্লাহ। চোখের সামনে কাবাঘর দেখে অজান্তেই দুগন্ড বেয়ে অশ্রু নেমে এলো। আমি কি সৌভাগ্যবান! দ্বিতীয়বারের মতো এই পবিত্র ঘর জিয়ারত করার সৌভাগ্য হলো।
তারপর তাওয়াফ শুরু হলো। কাবা শরীফের যে কোনায় হাযরে আসওয়াদ ঠিক সেই কোনা বরাবর নীল দাগ থেকে তাওয়াফ শুরু হয় এবং কাবা ঘরের চতুরদিক ঘুরে আবার সেই নীল দাগ স্পর্শ করলে তাওয়াফ সম্পন্ন হয়। কোন সময় হাত দিয়ে পবিত্র কাবাঘর ধরে, কখনো মাকামে ইব্রাহীম ছুঁয়ে, কখনো হাযরে আসওয়াদ বা কালো পাথরকে দূর থেকে চুমু খেয়ে ৭ বার তাওয়াফ সম্পন্ন করলাম।
তাওয়াফের পর মাকামে ইব্রাহীমের পাশে দু’রাকাত নামাজ পড়ার নিয়ম। কিন্তু এতই ভীড় ছিলো যে, একটু দূরে নামাজ আদায় করে সাঈ করতে গেলাম। সাঈ হচ্ছে সাফা এবং মারুয়া পাহাড় দু’টির মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় পর্যন্ত আসা-যাওয়া করা। দু’বার যাওয়ার পর আমি আর পারছিলাম না। বয়স যে হয়েছে তা টের পাচ্ছিলাম। যাদের হাটতে অসুবিধা হয়, তাদের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে। ৭৫ রিয়াল দিয়ে একটা হুইল চেয়ার ভাড়া করে সাঈ শেষ করলাম। পরের দিন অবশ্য ৫০ রিয়ালেই হুইল চেয়ার ভাড়া পেয়েছিলাম। বুঝলাম এখানেও দরদাম চলে।
সাঈ সমাপ্ত করে চুল কেটে পেট ভরে জমজমের পানি পান করে ফিরে এলাম হোটেলে, বিকেলে জিয়ারতের জন্য বের হতে হবে। হোটেলের বাংলাদেশী রুম সার্ভিস আসাদ একজন বাংলাদেশী ড্রাইভারকে ঠিক করে দিলেন, যিনি আমাকে মক্কার আশেপাশের দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখাবেন। দেশী ভাই হিসেবে খুবই আন্তরিকভাবে আমাকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গেলেন।
বর্তমানে বায়তুল্লাহর সীমানা প্রাচীরের মধ্যেই রয়েছে আবু জেহালের বসতবাড়ী। যে বাড়িটিকে সৌদি সরকার এখন গণ টয়লেটে পরিণত করেছে। মসজিদে হারামের আনুমানিক ৫০ মিটার দূরে আব্দুল মুত্তালিবের বাড়ী। যেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা:)। বর্তমানে এই বাড়িটিকে লাইব্রেরীতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। শহরের মধ্যভাগে রয়েছে মক্কা মিউজিয়াম। যেখানে আছে আদি কাবা ঘরের নমুনা। সৌদি আরবের আদি পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রাচীন ধাতব মুদ্রা, জমজমের কুপ থেকে পানি উত্তোলনের পুরানো যন্ত্রপাতি, পুরান আমলের হাতে লেখা পবিত্র কোরআন শরীফের কপি ইত্যাদি। এরপর আমরা গেলাম জাবালে নূরের পাদদেশে। এখানেই পবিত্র কোরআন নাজেলের শুভ সূচনা শুরু হয়। সূরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াত এখানেই নাজিল হয়। ওহি নাজেল হওয়ার আগে হুজুর (সা:) এই জাবালে পাহাড়েই ধ্যানে বসতেন। বিবি খাদিজা প্রতিদিন সেখানে গিয়ে তাঁর খাবার দিয়ে আসতেন। ৫৬৫ মিটার উচ্চতার এই পাহাড়ে উঠতে সময় লাগে সোয়া ঘন্টার মতো। ভাবলে অবাক হতে হয় যে বিবি খাদিজার মতো একজন নারী প্রতিদিন কিভাবে এই পাহাড়ে আরোহণ করতেন।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য জাবালে সওর। সময়ের অভাবে উপরে উঠা হয়নি। যদিও তরুণ বয়সে হজ্ব করার সময় আমি একবার এই পাহাড়ে আরোহণ করেছিলাম। জাবালে সউর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর স্মৃতি বিজরিত স্থান। মক্কা থেকে মদিনায় হিযরতের সময় তিনি এবং হযরত আবু বকর এখানে তিনদিন অপেক্ষা করেছিলেন। শত্রুরা খুঁজতে খুঁজতে এই গুহার সামনে এসে ফিরে যায়। আল্লাহর হুকুমে এই গুহা মুখে মাকরসা জাল বুনে শত্রুদের বিভ্রান্ত করেছিলো।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আরাফা প্রান্তর।
মক্কা শরীফ থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে এই প্রান্তরটি অবস্থিত। এবং পবিত্র বায়তুল্লাহ থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। বাবা আদম (আ:) এবং মা হাওয়ার দুনিয়াতে প্রথম মিলনের স্থান এটা। এখানেই তাদের দোয়া কবুল এবং গুনাহ মাফ হয়। হযরত ইব্রাহীম (আ:) এবং বহু নবী ও তাঁদের অনুসারীরা এই ময়দানে এসে কান্নাকাটি করেছেন। এই আরাফা মাঠের পাশেই জাবালে রহমতের অবস্থান। জাবালে রহমতের উপর দাঁড়িয়েই নবীজি তার বিদায়ী হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। হজের সময় এখানেই হাজীরা জমায়েত হন।
আরাফা মাঠের পাশেই মসজিদে নামিরা। হিজরী শতাব্দীর দ্বিতীয় মধ্যভাগে এটি নির্মিত হয়। হজের সময় ব্যতিত লোকজন এখানে খুব একটা থাকে না। তাই এই সময়টা খুব নিরব এবং সুনসান মনে হলো। আরাফার দিনে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এখানেই নামাজে ইমামতি করতেন। এরপর আমরা এলাম মসজিদে খায়েফ-এ। এটা মিনায় অবস্থিত। অধিকাংশ ইসলামী চিন্তাবীদদের মতে এই মসজিদে ৭০জন নবী নামাজ আদায় করেছেন। হজুর (সা:) এই মসজিদে বিদায়ী হজের নামাজ আদায় করেন। এরপর আমরা এলাম মসজিদে জীন পরিদর্শনে। এখানে জীনরা হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর কন্ঠে পবিত্র কোরআন শুনে ঈমান আনে। এখানেই পবিত্র কোরআনের অন্যতম সুরা জীন অবতীর্ণ হয়। মক্কা ফিরার পথে আমরা এলাম জান্নাতুল মাওয়ায়। এটা মক্কা শরীফের একটা বিখ্যাত কবর স্থান। এখানেই হাজার হাজার সাহাবী সমাহিত হয়েছেন। রাসুল (সা:) এর প্রথম বিবি হযরত খাদিজা (রা:) এর কবরও এখানেই।
আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য আল কিসওয়া ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরিতেই কাবার গিলাফ তৈরী করা হয়। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে বাদশাহ আব্দুল আজীজের নির্দেশে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।