আমস্টারডাম-নেদারল্যান্ডের রাজধানী। শহরটির যেমন রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তেমনি রয়েছে আধুনিক জগতের সমস্ত আকর্ষণ। পুরো শহরে রয়েছে ১৬৫টি খাল। ৯০টি ছোট-বড় দ্বীপ। যেগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত রয়েছে ২৮১টি সেতুর মাধ্যমে। ৬,৮০০ ঘরবাড়ী রয়েছে শহরটিতে। এরমধ্যে ১৬ শতক থেকে বিংশ শতাব্দীতে তৈরী বাড়ীঘর যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু অত্যাধুনিক স্থাপনা। নতুন-পুরনোর মিশেলে একাকার এই আমস্টারডাম। ৫০টি দেখার মতো যাদুঘর রয়েছে এই শহরে। এরমধ্যে ভ্যানগগ যাদুঘর এবং রিক্স যাদুঘরটি খুবই বিখ্যাত। এছাড়াও জলে ভাসা বসতবাড়ি, প্রকাশ্য রেডলাইট ডিষ্ট্রিক্ট, গুঞ্জিকা সেবনের বৈধতা, স্থাপত্য বৈশিষ্ট সবকিছু মিলিয়ে আমস্টারডাম সব মানুষের আকর্ষণ। বলা যায় এক শহরে যেনো দুই দুনিয়া। আর এ জন্যই শহরটি সারা বছর সারাবিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
আমস্টারডাম-কে খালের জন্য উত্তরের ভেনিস-ও বলা হয়। গত বছর ইতালীর ভেনিস শহর ঘুরে এসেছি। তাই উত্তরের ভেনিসটা দেখার আগ্রহ ছিলো। এবারের ইউরোপ ট্যুরে ভ্রমণের তালিকায় প্রথমেই অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম আমস্টারডাম-কে।
ভ্রমণটা শুরু হয়েছিলো আইসল্যান্ড দিয়ে। আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকজাভিক-এর দর্শনীয় স্থানগুলো পরিভ্রমণ করে ওয়াও এয়ারলাইন্সের বিমানে চড়ে আমস্টারডাম-এর শিফল বিমানবন্দরে যখন পা রাখলাম তখন বেলা দুটো। আগেই জেনেছিলাম ব্যস্ত বিমানবন্দরটি সমুদ্র সমতল থেকে ১১ ফুট নীচে। তবে বাইরে থেকে তেমন কিছু বুঝা যায়নি।
শিফল বিমানবন্দরের নামেরও একটি ইতিহাস রয়েছে। এক তথ্যমতে ‘শিফ হল’ অর্থ জাহাজের নিরাপদ ঘর। অন্য ভাষ্যমতে- প্রাচীন ডাচ ভাষায় ‘হল’ মানে সমাধি। অর্থাৎ জাহাজের সমাধি। আবার কারো মতে শব্দটি এসেছে ‘শিফ হেল’ অর্থাৎ জাহাজের নরক থেকে। যেখানে প্রায়ই জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটতো।
শিফল বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে বেরুতেই ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ঘিরে ধরলো। অনেকটা লাগেজ নিয়ে টানাটানি। এদের মধ্য থেকে বয়স্ক মতো একজনকে বেছে নিয়ে উঠে পরলাম ট্যাক্সিতে। গাড়ী ছুটে চললো নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম-এর পথে।
১৫/২০ মিনিট হাইওয়ে ধরে চলার পর ট্যাক্সিটি সরু পথ ধরে নেমে গেলো। একে-বেঁকে রাস্তা ধরে চলছিলো ট্যাক্সি। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিলো- মিটারে বেশী ভাড়া তুলতে ড্রাইভার ঘুরপথে যাচ্ছে। পরে আবশ্য এ ধারণাই ঠিক হয়েছিলো। নিয়মিত ভাড়ার চেয়ে দেড়গুণ ভাড়া আদায় করেছিলো সে। আমার হোটেল রিসেপসনিষ্ট একথাই বলেছিলো।
হোটেলে চেক-ইন করেই তাড়াহুড়া করে ছুটলাম আমাদেও গ্রুপের জন্য ট্যুর প্রোগ্রামে যোগ দেয়ার জন্য। দিনব্যাপী একটি ওয়াকিং ট্যুর বুক করেছিলাম আগেভাগেই নিউইয়র্ক থেকে। ওয়াকিং ট্যুর-এর মাধ্যমে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই দেখা যায়। ট্যুর গাইড যতক্ষণ হাঁটতে থাকে ততক্ষণ সে চারপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোর ধারা বর্ণনা করতে থাকে, যা ট্যুরিস্টদের কাছে হয় উপভোগ্য ও আকর্ষণীয়। হোটেল রিসেপশন থেকে জানিয়েছিলো গাইডের সাথে আমাদের মিটিং প্লেসটা খুব দূরত্বে নয়। হাঁটা পথে ২০ মিনিটের মতো। তবে সময়-স্বল্পতার জন্য অচেনা দেশে কোন রিস্ক নিতে চাইনি। এজন্য ট্যাক্সি নিয়ে যথাসময়ে পৌছে গেলাম সঠিক ঠিকানায়।
ওয়াকিং ট্যুরটার সদস্য ছিলো অনেক। নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষ। দুই গ্রুপে ভাগ করে দুজন গাইড নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। আমাদের ভাগের ট্যুর গাইডের নাম মারিয়া। বয়স ৩০-এর কোঠায়। অধ্যাপনা করেন একটা কলেজে, আর পার্ট টাইম ট্যুর গাইড। তাকে নিয়ে শুরু হলো আমাদের হাঁটাপথে আমস্টারডাম নগর ভ্রমণ।
টিপিক্যাল গাইডদের মতো প্রথমেই নেদার্যান্ড নিয়ে একটা বড় লেকচার দিলো মারিয়া। নেদারলান্ড শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘নি¤œভূমি’। উত্তর ও দক্ষিণ হল্যান্ড নামে দুটো প্রদেশ নিয়ে গঠিত নেদারল্যান্ড। নিয়মিত বন্যার কবলে পড়া শহরটিকে বাঁধ দিয়ে সুরক্ষিত করে বহু বছরের চেষ্টায় গড়ে তোলা হয় বর্তমান আমস্টারডাম। শহরটির মূল কেন্দ্রবিন্দু ড্যাম্স স্কোয়ার নামের বিশাল চত্বরটি উন্মুক্ত হয় ১২৭০ সালে আমস্ট্যাল নদীতে বাঁধ তৈরী করার পর। এরপর জলের তলায় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে তৈরি করা হয় বাড়িগুলো। আর এভাবেই গড়ে উঠে আমস্টারডাম-এর নগর স্থাপত্য।
আমস্ট্যাল নদীর মোহনায় আমস্টারডম শহর। এটি ক্যানেলের মাধ্যমে উত্তর সাগরের সাথে সংযুক্ত। আমস্টারডাম-এর খালের পাড় ঘেষে বাড়িঘরগুলো। প্রতিটি বাড়ী একটি সাথে আরেকটি লাগোয়া। একই উচ্চতায় একই রকম বাড়ী। গাইড জানালো, জলের আগ্রসন ঠেকিয়ে জাগিয়ে তোলা মাটির মধ্যে সহ্য ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে ১৫০০ শতক থেকে এধরনের বাড়ি নির্মানের অনুমতি দেয় সরকার। বাড়িগুলো যেন বেশী ওজন না হয়, সেজন্য একই ধরনের পরামর্শ দেয়া হয় এবং তা নজরদারীও করা হয়। এসব বাড়িগুলোতে স্থানীয়রা আদর করে বলে ড্যান্সিং হাউজ। আমস্টারডাম-এর এসব বাড়িগুলো বেশীরভাগ কমবেশী সামনের দিকে হেলানো। কারণ হিসেবে গাইড জানায় বাড়িগুলোর উপর তলায় উঠার জন্য সিড়িগুলো হচ্ছে সরু। আর সেগুলো দিয়ে বড় কোন আসবাসপত্র উঠানো প্রায় অসম্ভব। তাই দড়ি বেঁধে যাতে জানালা দিয়ে উঠানো যায়, সেজন্যই বাড়িগেুলো সামনের দিকে হেলিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
এরপর গাইড আমাদের নিয়ে এলো ভ্যানগগ যাদুঘর পরিদর্শনে। আমস্টারডাম-এ সবচেয়ে বেশী পর্যটক আসেন এই যাদুঘরে। ভ্যানগগের চিত্রকর জীবনের শুরু থেকে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত যেসকল ছবি একেছেন এখানে ধারাবাহিকভাবে তা সাজানো আছে। ভ্যানগগের চিত্রকর্মের পাশাপাশি রেনেসাঁ ও ইম্প্রেসনিষ্ট যুগের মনে, মেতিস সহ অন্যান্য আরো কয়েকজন শিল্পীর বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম রয়েছে এই যাদু ঘরে।
যাদুঘরে ঢুকে প্রথমে আমরা উপভোগ করলাম শিল্পী ভ্যানগগের জীবন ও কর্ম নিয়ে তৈরী ৮ মিনিটের একটি প্রামাণ্য চিত্র। যাদুঘরের প্রথম তলায় মূলত: শিল্পীর পরিচিতি দিয়ে সাজানো। বিভিন্ন ছবি, আতœপ্রতিকৃতি ইত্যাদি। দ্বিতীয় তলায় তার পারিবারিক পরিচিতি, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ইত্যাদি। তৃতীয় তলাটি মুলত: বিখ্যাত কিছু সংগ্রহের। একপাশে জায়গা পেয়েছে শিল্পীর ভক্তদের আকাঁ কিছু ছবিও। এখানে ভ্যানগগের কিছু শিল্পকর্ম যেমন সানফ্লাওয়ার, দ্য স্টারি নাইট, পটেটো ইটার্স-এর মতো বিখ্যাত চিত্রকর্মও রয়েছে।
ভ্যানগগ যাদুঘর দেখতে দেখতে একটা ব্যাপার মনের কোনে বারবার উঁকি দিচ্ছিলো। গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেখছি সেসব দেশের মিউজিয়াম, বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম। কিন্তু একটি ব্যাপারে সকল শিল্পীর ভাগ্য একই রকম মনে হয়েছে। তাহলো তাদের বেশীরভাগ জীবদ্দশায় যেমন নিজেরা মূল্যায়িত হননি, তেমনী আর্থিকভাবেও বিবেচিত হয়নি তাদের শিল্পকর্মগুলো।
আমি আজ ভ্যানগগ যাদুঘরের যেসব শিল্পকর্মগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেগুলোর এক একটির বর্তমান মূল্য ৬০/৬৫ মিলিয়ন ডলার। অথচ এই শিল্পী জীবদ্দশায় অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন। রং তুলি কেনার পয়সাও তাঁর জুটেনি।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রিক্স যাদুঘর। ভ্যানগগ যাদুঘরের পাশেই এর অবস্থান। বিশ্বখ্যাত ডাচ শিল্পীদের চিত্রকর্মের সংগ্রহ আছে এই যাদুঘরে। এরমধ্যে দুজন শিল্পী হচ্ছেন র্যামব্রান্ট এবং ভার্মিয়ার। এই মিউজিয়ামের সবচেয়ে বড়, মূল্যবান ও বিখ্যাত চিত্রকর্মটি শিল্পী র্যামব্র্যান্টের আকাঁ। দুজন পাহাড়াদার সবসময় ছবিটি আগলে রেখেছে। পুরো একটি ঘরে শুধু এই ছবিটিই রয়েছে। সবমিলিয়ে ১০ লক্ষাধিক চিত্রকর্ম রয়েছে এই যাদুঘরে। এরমধ্যে ৮ হাজার শিল্পকর্ম দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।
গাইডের সাথেই পায়ে হেঁটে আমরা আমস্টারডাম শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখছিলাম। একটু পর পর দেখছিলাম সাইকেল আরোহীদের সারি। তরুণ-তরুনী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউই বাদ নেই। ২/৩ বছরের বাচ্চাদের জন্য রয়েছে সাইকেলের পিছনে বা সামনে বসার বিশেষ ব্যবস্থা।
গাইড জানালো আমস্টারডাম শহরে মানুষের চেয়ে সাইকেল বেশী। দেশের প্রেসিডেন্টও নাকি সাইকেলে চড়ে অফিস করেন। সাইকেলের জন্য রয়েছে আলাদা লেন বা রাস্তা। এখানে-সেখানে প্রচুর দোকান রয়েছে, যেখানে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। পর্যটকরা চাইলে সাইকেল ভাড়া নিয়ে শহর ঘুরে দেখতে পারেন। ট্রেন অথবা ট্রামে সাইকেল নিয়ে উঠে পড়া যায়। তাছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে সাইকেলের জন্য রয়েছে সুবিশাল কয়েক তলা গ্যারেজ।
আমস্টারডাম শহরের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত কফি শপ। এইসব কফি শপে খাবার-দাবার, কফির সাথে মারিজুয়ানা, গাজা সহ বিভিন্ন ড্রাগস লিগ্যালি বিক্রয় হয়। গাইড জানালো এই কফি শপগুলোর টানেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণ-তরুনীরা ছুটে আসে আমস্টারডাম- যা ড্রাগ ট্যুরিজম নামে পরিচিত।
গাইড আরো জানায়, ওলন্দাজরা জাতি হিসেবে খুবই উদার। এই দেশে সমকামিতা বৈধ। কিন্ডারগার্টেন থেকেই বাচ্চাদের সেক্স সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়। এরা চায় বাচ্চারা যেনো সেক্স সম্পর্কে তাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালোমতো জানতে পারে।
ইতোমধ্যেই দলের সবার কয়েক ঘন্টা হাঁটা হয়ে গেছে। কিন্তু গাইডের আলাপ-আলোচনায় সবাই এতোটাই মগ্ন ছিলো যে কেউই ক্ষুধা-তৃষ্ণা টের পায়নি। গাইড-ই তা মনে করিয়ে দিয়ে আমাদের একটি খাবার দোকানে নিয়ে এলো। এখানে পাওয়া যায় স্থানীয় ডাচ ফুড। গাইড সবার মতামত নিয়ে অর্ডার দিলো আলু ভর্তা আর সবজি মিলিয়ে এক ধরনের ডাচ খাবার। সাথে ভেড়ার মাংস। শেষে আপেল কেক। যার যার পছন্দ মতো ড্রিংঙ্কস। যেহেতু বিদেশে আমি মাংস খাইনা, তাই বাকী খাবারগুলো খেলাম। টেষ্ট ছিলো দারুণ।
দিনের সবশেষে ছিলো নৌকা ভ্রমণ। জলযানে করে খালের পানিতে ভেসে বেড়ানো। আমাদের সাথের গাইড এই নৌকা ভ্রমণের দর্শক কারণ এখানে রয়েছে আলাদা গাইড। তিনি ইংরেজী এবং ডাচ ভাষায় ধারা বিবরণি দিচ্ছিলেন। খালের দুপাশে মধ্যযুগীয় বাড়ী-ঘরের সারি। এর অনেকগুলোর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। গাইডের বর্ণনায় তাই উঠে আসছিলো। আর আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম।