আরাফাত শব্দটি আরবী। এর অর্থ জানা, চেনা, পরিচয় ইত্যাদি। আরাফাত ময়দানের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে বেশী যে মতবাদটি প্রচলিত তা হলো- বেহেস্ত থেকে পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর বাবা আদম ও মা হাওয়া পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা একে অপরকে খুঁজতে খুঁজতে এসে এই প্রান্তরে এসে মিলিত হন। এজন্য এর অন্য নাম আরাফাত বা মিলনস্থল।

আজ আমরা এসেছি ঐতিহাসিক আরাফাত প্রান্তরে। এই জায়গাটি মক্কা নগরী থেকে ২২ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর পূর্ব প্রান্ত তায়েফের সুউচ্চ পর্বতমালায় ঘেরা। বছরে মাত্র একদিন ৯ জিলহজ্জ হাজী সাহেবানরা হজ্বের সর্বপ্রধান অনুষ্ঠানে এখানে এসে সমবেত হন। আরাফাত ময়দানটি ১০ দশমিক ৪ কিলোমিটার বিস্তৃত। ময়দানটি তিনদিক দিয়ে পাহাড় বেস্টিত। এর দক্ষিণ পাশ দিয়ে রয়েছে মক্কা, হাদাহ তায়েফ রিং রোড। সড়কের দক্ষিণ পাশে সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উম্মুল কুরআ বিশ্ববিদ্যালয়। এই আরাফাতের মাঠে হাজী সাহেবগণ মধ্যাহ্নের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। সেদিন তাদের পরনে থাকে দুই প্রস্থ সেলাইবিহীন পোশাক। মুখে লাব্বায়েক ধ্বনি। আকুল হৃদয়ে সেদিন তারা রাব্বুল আলামিন-কে বলেন- আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোন শরীক নেই। সব প্রশংসা এবং নিয়ামত তোমার-ই এবং সব সা¤্রাজ্যই তোমার।
আরাফাত শব্দটি আরবী। এর অর্থ জানা, চেনা, পরিচয় ইত্যাদি। আরাফাত ময়দানের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে বেশী যে মতবাদটি প্রচলিত তা হলো- বেহেস্ত থেকে পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর বাবা আদম ও মা হাওয়া পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা একে অপরকে খুঁজতে খুঁজতে এসে এই প্রান্তরে এসে মিলিত হন। এজন্য এর অন্য নাম আরাফাত বা মিলনস্থল। অন্য একটি মতে আরাফাত শব্দটি আরাফ ধাতু থেকে এসেছে। এর অর্থ সুগন্ধি। কারণ আরাফাত প্রান্তর খোলামেলা এবং সুঘ্রানে ভরপুর। অপরদিকে মিনা হলো সেই জায়গা যেখানে ময়লা আবর্জনা ও কোরবানীর পশুর রক্ত জমা হয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ বলেছেন- যখন কোন ব্যক্তি ধৈর্যশীল ও আল্লাহ ভীরু হয় তখন তাকে বলা হয় আরেফ, ধৈর্য্যশীল ও আল্লাহ ভীড়– ব্যক্তি। ৯ জিলহজ্ব জোহরের পরে প্রচন্ড রৌদ্র তাপের মধ্যে হাজী সাহেবানরা যখন এই মাঠে তাবুর মাঝে অপেক্ষা করেন তখন তারা দু:খ-কষ্ট ও অসুবিধাসমূহ পরম ধৈর্য্যরে সাথে মোকাবেলা করেন। এখানে তারা অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল, ন¤্র, বিনয় ও আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এইজন্য দিনটিকে আরাফা এবং প্রান্তটিকে আরাফাত বলা হয়।
প্রান্তরটির নামকরণ নিয়ে আরেকটি মতবাদ রয়েছে তাহলো- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মোমিন মুসলমানগণ একে অপরকে খুঁজতে থাকেন। এজন্য এই প্রান্তরটিকে আরাফাত প্রান্তর বলে আখ্যায়িত করা হয়। অন্য একটি বর্ণনায় আছে- এই ময়দানে জিবরাইল (আ:) হযরত ইব্রাহীম (সা:)-কে হজ্বের বিধিবিধান শিক্ষা দেয়ার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন- হাল আরাফতা। অর্থাৎ আপনি কি বুঝতে পেরেছেন। হযরত ইব্ররাইম (আ:) বলেন হাঁ। এরপর থেকেই এই ময়দানের নাম হয়েছে আরাফা। এই আরাফাতে উপস্থিত না হলে জ্ব পূর্ণ হবে না। তাই হজ্বে এসে যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন তাদেরও অ্যাম্বুলেন্স করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হয় স্বল্প সময়ের জন্য।
এই ময়দানে এসে বারবার শিহরিত হচ্ছিলাম। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে কিশোর বয়সে মায়ের হাত ধরে এই আরাফাতের মাঠে এসেছিলাম। অদেখা পৃথিবীর এক আনন্দ খুঁজছিলো সেদিন আমার চোখ। আজ পরিণত বয়সে এসে নতুন করে যেনো সব আবিষ্কার করছিলাম। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে এই ময়দানে রাসুল (সা:) লক্ষাধিক সাহাবীকে সামনে রেখে বিদায় হজ্বের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ময়দানেই ইসলামের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে কোরআনের আয়াত নাজিল হয়েছিলো।
এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে এলাম জাবালে রহমতে। জাবাল অর্থ পাহাড়। জাবালে রহমত হলো রহমতের পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে একটি সাইনবোর্ডে বিভিন্ন ভাষায় দিক নির্দেশনা রয়েছে। কি করা যাবে বা কি করা যাবে না, দর্শনাথীরা যেনো বেদাতে অংশ না নেন তার নির্দেশনা। বাংলা-তেও এই সাইনবোর্ড দেখে ভালো লাগলো। পাহাড়ে উঠার জন্য সিঁড়ি তৈরী করা হয়েছে। সিঁড়িগুলো বেশ প্রশস্থ। পাহাড়ের উপরে একটি সাদা রং এর পিলার। আরাফাতের মাঠের চারিদিকে যেহেতু পহাড় তাই জাবালে রহমত চিহ্নিত করার জন্য এই পিলার তৈরী করা হয়েছে। এই পাহাড়ের পাদদেশে রাসুল (সা:) হজের খুৎবা ও বিদায় হজ্বের ভাষণ দিয়েছিলেন। জাবালে রহমতের আশেপাশে প্রচুর পুলিশের দেখা পেলাম। তারা দর্শনার্থীদের নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। যেনো পিলারটি জড়িয়ে না ধরেন, পিলারে যেনো চুমু না খান ইত্যাদি। রহমতের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য, স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সর্বপরি দেশের জন্য দোয়া করে নীচে নেমে এলাম।
মক্কায় আমার গাইড হিসেবে কাজ করেন সিলেটের তারিফ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করেন এবং জিয়ারতের কাজ করেন। তিনি যেসব জায়গা চিনেন তা গতানুগতিক। আমি যতবার যাই হোম ওয়ার্ক করে তাকে নিত্য-নতুন জায়গার হদিস দিতে বলি। তিনি তা খুঁজে বের করে রাখেন এবং পরের বার এলে আমাকে সেখানে নিয়ে যান। গতবার এসে তার কাছে নহরে জোবায়দার খোঁজ জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এটা তার জানা না থাকায় বলেছিলেন- তিনি খুঁজে রাখবেন এবং পরেরবার নিয়ে যাবেন। এবার আরাফাতের মাঠে আসলে তিনি জানান যে, নহরে জোবায়দার খোঁজ তিনি পেয়েছেন এবং আরাফাত মাঠের এক পাশে এখনো তার চিহ্ন রয়েছে। জাবালে রহমত দেখা শেষ করে তার সাথে আমরা নহরে জোবায়দা দেখতে গেলাম।
নহরে জোবায়দা নিয়ে একটি কাহিনী রয়েছে। বেগম জোবায়দা ছিলেন বাগদাদের খলিফা হারুন-অর রশীদের স্ত্রী। একদিন রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য লোক এসে তার সাথে দৈহিক মিলন করে পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এই স্বপ্ন দেখে তিনি ঘৃণা, লজ্জা এবং চিন্তায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি তার বিশ্বস্ত বাদীকে সা¤্রাজ্যের প্রধান কাজীর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে পাঠালেন। বাদী বেগম জোবায়দার আদেশ অনুযায়ী স্বপ্নটি নিজে দেখেছে বলে উল্লেখ করে। কাজী সাহেব তখন তাকে বললেন- এই স্বপ্নটি তুমি কখনো দেখতে পারো না। যে দেখেছে তার নাম বলো, নাহলে এর ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না। অগত্যা বাদী ফিরে গিয়ে বেগম সাহেবার অনুমতি নিয়ে এসে তার নাম জানালেন। অতপর কাজী সাহেব বললেন যে, বেগম সাহেবা দ্বারা এমন একটি মহৎ কাজ সাধিত হবে যা দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের লোক উপকৃত হবেন। পরবর্তীকালে বেগম জোবায়দা হজ্বের সময় হাজীদের কষ্ট দূর করার জন্য মক্কা শরীফ থেকে মদিনা শরীফ পর্যন্ত বিরাট একটি খাল খনন করে দিয়েছিলেন যা নহরে জোবায়দা নামে পরিচতি ছিলো। আব্বাসীয় খেলাফত পর্যন্ত এই নহরটির অস্তিত্ব ছিলো। কালের বিবর্তনে সে নহরটি আজ আর নেই। কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে। নহরে জোবায়দার একটি অংশ রয়েছে মসজিদে নামিরার পাশে। কিছু অংশ আরাফাত প্রান্তরে। আমরা তারিফের সাথে নহরে জোবায়দার কিছু অংশ দেখে আবার বাসের কাছে ফিরে এলাম।