হোটেলে নাস্তা সেরে আমার গাইড এরশাদউল্লাহর গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। আজকে আমাদের গন্তব্য খন্দকের যুদ্ধের মাঠ। যেখানে পঞ্চম হিজরীর সাওয়াল মাসে (৬২৭ খ্রী:) মক্কার কুরাইশ, মদিনার ইহুদী, বেদুঈন এবং পৌত্তলিকরা সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করেছিলো। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিলো মদিনার উপর গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দু:সহ অভিজ্ঞতা।
খন্দক শব্দের অর্থ পরিখা বা গর্ত। যেহেতু এই যুদ্ধে অনেক লম্বা পরিখা খনন করা হয়, তাই এই যুদ্ধের নাম দেয়া হয় খন্দকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আহজাব নামেও পরিচিত। আহজাব অর্থ সম্মিলিত বাহিনী।

খন্দকের যুদ্ধের কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকরা যে ব্যাখ্যা দেন তা হলো বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা কোরাইশদের উপর নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। তারপরেই প্রতিশোধ গ্রহণে মরিয়া হয়ে তারা অহুদের যুদ্ধ বাধায়। যাকে ঐতিহাসিকরা নিষ্ফল বিজয় বলে আখ্যায়িত করেন। অহুদের যুদ্ধে কোরাইশরা চেয়েছিলো হযরত মুহাম্মদ (সা:)-কে হত্যা করে ইসলামের নাম-নিশানা স্তব্ধ করে দিতে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সেজন্য মরিয়া হয়ে ৬২৭ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে ১০ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয় কোরাইশদের এই জোট। সেই খবর পেয়ে সাহাবীদের নিয়ে জরুরী বৈঠকে বসেন হযরত মুহাম্মদ (সা:)। সিদ্ধান্ত হয় শহরের ভিতর থেকে কোরাইশদের আক্রমণ প্রতিহত করা হবে। সৈন্য সংগ্রহ শুরু হলে দেখা গেলো বাছাই প্রক্রিয়া শেষে সর্বমোট ৩ হাজার সৈন্যের জোগার হয়েছে। এতো অল্প সংখ্যক সৈন্য দিয়ে ১০ হাজার সৈন্যের মোকাবেলা কিভাবে হবে এজন্য সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমন সময় এক অসাধারণ যুদ্ধ পদ্ধতির ধারণা নিয়ে আসেন সাহাবী সালমান ফার্সী। তিনি বলেন নগরীর উত্তর ও পশ্চিম দিক সবচেয়ে বেশী অরক্ষিত। তাই ওদিক দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। তিনি এই দিক দিয়ে পরিখা খনন করার পরামর্শ দিলেন। তার পরামর্শ সবার মনোপুত হলে সকলের পরিশ্রমে পরিখা খনন হয়ে যায়। রাসুল (সা:) নিজেও এই খনন কাজে অংশ নেন। কুরাইশ বাহিনী এসে মুসলিম বাহিনীর এই কৌশল দেখে হতচকিত হয়ে যায়। মাঝেমাঝে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের ১০জন নিহত হয়। মুসলিম পক্ষের ৬ জন শহীদ হন। এভাবেই ২৭দিন থাকার পর কাফেরদের উপর গজব হিসেবে ঘুর্ণিঝড় নেমে আসে। ঝড়ে কাফেরদের তাবুসমূহ উড়িয়ে নিয়ে যায়। এবং তারা যুদ্ধ ক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, খন্দক যুদ্ধ নিয়ে আল্লাহপাক সুরা আহজাবে ৯ থেকে ২৭ পর্যন্ত ১৯টি আয়াত নাজিল করেন।
খন্দকের যুদ্ধ ক্ষেত্রের পরিখাগুলোর কোন চিহ্ন এখন আর নেই। যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ৭টি মসজিদ। যুদ্ধের সময় হযরত সালমান ফার্সী (রা:), হযরত আবু বকর (রা:), হযরত সাদ বিন মা’জ (রা:), হযরত আলী (রা:) যেখান থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সেখানে পরবর্তীকালে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে যুদ্ধের সময় নবী কন্যা হযরত ফাতিমা (রা:)-এর তাবু ছিলো সেখানে তাঁর নামে একটি মসজিদ এবং সর্বশেষ খন্দকের যুদ্ধের বিজয়কে স্মরণে রেখে মসজিদ আল ফাতাহ সহ মোট ৭টি মসজিদ নির্মিত হয়। সবগুলো মসজিদ একত্রে আসসাবায়া বা ৭ মসজিদ নামে পরিচিত।
গাইড এরশাদউল্লাহর তাড়া খেয়ে দ্রুত গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। এবারের গন্তব্য মদিনা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে বদরের মাঠ। মুসলিম ইতিহাসের প্রথম সশ¯্র যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এই বদরের মাঠে। ৬২৪ খ্রীষ্টাব্দে তথা দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজানে অনুষ্ঠিত হয় ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ও গৌরবময় অধ্যায় এই বদরের যুদ্ধ। বদর প্রান্তরেই মহান আল্লাহ প্রায় নির¯্র রাসুল (সা:) ও তাঁর সঙ্গীদের কাফেরদের সশ¯্র মোকাবেলায় বিজয়ী করেছিলেন।
গাড়ী এসে থামলো বদর প্রান্তরের পাশে একটি মসজিদের সামনে। গাড়ী থেকে নেমে আমরা গেলাম ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে। এখানেই মুসলিম বাহিনীর সাথে কোরাইশদের সম্মুখ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা:) নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ৩১৩জন মুসলমান অসামান্য রণ নৈপূন্য প্রদর্শণ করে বদরের যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। কুরাইশরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মক্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ১৪জন মুসলিম সৈন্য শাহাদৎ বরণ করেন। এরমধ্যে ৬জন মোহাজীর ও ৮জন আনসার ছিলেন। আবু জেহেল, ওৎবা, সায়েরা, অবু জেহেলের ভ্রাতা আছি, আবু সুফিয়ানের পুত্র আনজেলা সহ শতাধিক কাফের নিহত হয়। কুরাইশরা আবু জেহেলের মরদেহ যুদ্ধের ময়দানে ফেলেই পালিয়ে যায়। পরে মুসলমানরা বদর মাঠের এক কোণায় মাটিতে গর্ত করে তাকে পুতে রাখে। কোন এক সময় কেউ তার কবরটি চারিদেকে মাটি সমান দেয়াল দিয়ে পাকা করে দেয়। আমরা কবরের কাছে গেলাম। ভেতরে ময়লা আবর্জনার স্তুপ। মক্কায় দেখেছি হারাম শরীফ সংলগ্ন আবু জেহেলের বাড়িটি গণ টয়লেটে পরিণত করা হয়েছে। আর এখানেও মৃত্যুর পর অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে তার কবর। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (সা:) বিরোধীতার কি পরিণতি হয় আবু জেহেল এর প্রমাণ। এরশাদউল্লাহ জানালেন এক সময়ের বদর প্রান্তর এখন একটি সমৃদ্ধ শহর। এখানে বর্তমানে ১০ হাজার লোকের বসবাস। পরিকল্পিভাবে এই শহরটি গড়ে উঠছে। সৌদি বাদশা কর্তৃক নিয়োজিত একজন প্রশাসক আছেন এই শহরে। মাঠের পাশেই আরবীতে লেখা বিশাল সাইনবোর্ড। এখানেই শহীদ সাহাবাদের নাম লেখা আছে। তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া করে আমরা আবার গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।
অল্পক্ষণ পরেই গাড়ী এসে থামলো একটি বালুর পাহাড়ের সামনে। আশেপাশে সব রুক্ষ পাথরের পাহাড়। এর মাঝে এই বালুর পাহারটা বড়ই বেমানান। এরশাদউল্লাহ জানান, এটাকে বলে জাবালে মালাইকা বা ফেরেস্তাদের পাহাড়। রাসুল (সা:) যুদ্ধের আগের রাতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানান, হে আমার প্রভু আমরা মাত্র ৩১৩জন অপরদিকে শত্রুরা এক হাজার। এরা যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তবে দুনিয়ার বুকে আপনার নামের মহিমা প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে। রাসুল (সা:) প্রার্থনার সময় তাঁর হাত এতো উপরে উঠিয়েছিলেন যে, তাঁর কাধ থেকে চাদর মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো। তখন আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো- আমি আপনার সাহায্যে মালাইকা বা ফেরেস্তা প্রেরণ করেছি। শত্রুদের এক হাজারের জন্য আমার একজন ফেরেস্তাই যথেষ্ট, আপনি হাত নামান। আমি আপনাকে বিজী ঘোষণা করলাম এবং আপনার সাথে ৩১৩ জনকেও আগাম জান্নাতি ঘোষণা দিলাম। এরশাদউল্লাহ আরো বলেন, এই বালির পাহাড়েই ফেরেস্তারা অবস্থান নিয়েছিলেন বলে একে জাবালে মালাইকা বা ফেরেস্তাদের পাহাড় বলা হয়। কোরআন পাকে এই পাহাড়ের কথা উল্লেখ আছে। পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে একটু দোয়া করে আমরা রওনা দিলাম নতুন গন্তব্যে।
এবার গাড়ী এসে থামলো মূল রাস্তা থেকে একটু দূরে একটি কুপের কাছে। এরশাদউল্লাহ জানালেন- এটাকে বলা হয় বীর এ রোহা। আবার অনেকে এটাকে বীর এ শেফা বলেও অভিহিত করেন। আরবীতে বীর অর্থ কুপ, রুহা মানে থুথু বা লালা আর শেফা মানে আরোগ্য। এই কুপটির রয়েছে একটি ইতিহাস। রাসুল (সা:) যখন বদর যুদ্ধ শেষে এই পথ ধরে মদিনায় ফিরছিলেন, তখন সাহাবীরা পিপাসার্ত হলে তাঁরা এই কুপের কাছে আসেন। কুপের পানি তোলা হলে দেখা গেলো পানি খুবই লবনাক্ত। কিছু সাহাবী এই পানি পান করার পর অসুস্থ হয়ে গেলেন। রাসুল (সা:) তখন তার লালা মোবারক এই পানিতে ফেলে তিনি আবার পানি তুলে তা সাহাবীদের পান করতে বলেন। আল্লাহর কুদরত আর রাসুল (সা:)-এর লালা মোবারকের বরকতে এই লবনাক্ত পানি মিষ্টি হয়ে গেলো। আর যারা এই পানি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তারাও সুস্থ্য হয়ে গেলেন। এজন্যই এই কুপের আরেক নাম আরোগ্যের কুপ। কুপটি গভীরতায় প্রায় ২০ মিটার। ১৪৫০ বছর আগে এই কুপটি খনন করা হয়।
আমরা কুপের পাশেই অনেক গাড়ীর লাইন দেখতে পেলাম। আরব দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পানি সংগ্রহ করতে তারা এসেছে। আমরাও পাশের একটি দোকান থেকে একটি কনটেইনার ক্রয় করে কিছু পানি সংগ্রহ করলাম। পানির জন্য কোন মূল্য দিতে হয়নি। জানা যায়, মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে রাসুল (সা:) এখানে বহুবার থেমে নামাজ আদায় করেছেন। আরো অনেক নবী ও রাসুল এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এখানে থেমেছেন এবং নামাজ আদায় করেছেন। হযরত আনাস (রা:) এবং হযরত আবু মুসা আনসারী (রা:)-এর বরাত দিয়ে উল্লেখ আছে যে, রাসুল (সা:) বলেছেন- মক্কা যাওয়ার পথে কমপক্ষে ৭০জন নবী এখানে থেমে নামাজ আদায় করেছেন। একসময় এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। সংস্কারের অভাবে এখন মসজিদটি ভাঙাচুড়া অবস্থায় আছে।
সারাদিনের ঘুরাঘুরিতে সবাই ছিলাম ক্লান্ত। গাইড এরশাদউল্লাহকেই দীর্ঘ পথ ড্রাইভ করতে হবে। তাই আজকের মতো জিয়ারতে বিরতি দিয়ে ছুটে চললাম নবীর শহর মদিনায় আমাদের হোটেলের দিকে।