কায়রোর কেন্দ্রস্থলে নাইল রিজ কার্লটন হোটেলে শুয়েছিলাম ভোররাতে। একটু দেরী করে উঠবো সে ভাগ্য ছিলো না। সকাল ৮টায় কর্কশ শব্দে আমার এলার্ম ঘড়িটা বেজে উঠলো। ৯টায় ট্যুর গাইড এসে আমাকে তুলে নেয়ার কথা। যাবো স্বপ্নের পিরামিড দর্শনে। তারও আগে গোসল সেরে রেডি হওয়া, ব্রেকফাস্ট সাড়া সবই করতে হবে এক ঘন্টার মধ্যে। তাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে হলো।
বিছানায় উঠে বসে জানালা দিয়ে চোখ যেতেই অবাক বিস্ময়ে থ মেরে গেলাম। জানলার গা ঘেঁষেই বইছে নীল নদ। ইন্টারনেট ঘেঁটে নীল নদের পাশের হোটেলটাই বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এতো যে কাছে হবে ভাবতেই পারিনি। জানলা দিয়ে চেয়ে দেখছি আমার ভালো লাগার নীল নদ-কে। যার কথা এতো জেনেছি, এতো পড়েছি। পৃথীবির অন্যতম এই বৃহত্তম এই নীল নদ আফ্রিকায় জন্ম নিয়ে ৬,৬৯৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে আছড়ে পড়েছে ভূমধ্যসাগরের বুকে। আমি নয়নভরে উপভোগ করছি এক শান্ত সুনীল স্্েরাতস্বনী-কে আজ থেকে প্রায় ৭ হাজার বছর আগে যার দুপাড়ে গড়ে উঠেছিলো প্রথম সভ্যতার উন্মেষ। সেই হাজার বছর আগে থেকে মিশরে এবং বর্তমানে যা কিছু ঘটে চলেছে তাও এই নীল নদের তীর ঘেঁষেই। এই নীল নদের পাড়ে এখনো জন্ম নেয় বাংলাদেশের নল খাগড়ার মতো এক ধরণের উদ্ভিদ- যার নাম প্যাপিরাস। কাগজ তৈরীর আগে এই প্যাপিরাসেই লিখা হতো সভ্যতার ইতিহাস। ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ, কত হিংসা, অত্যাচার সব কিছুর স্বাক্ষি এই নীল নদ। এই নীল নদ দেখেছে তার তীরে মিশরের ইতিহাসের ফারাও রাজাদের। যাদের হাত দিয়ে তৈরী পিরামিড সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম হিসেবে সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে টানে। যার টানে আমি সুদূর নিউইয়র্ক থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ছুটে এসেছি মিশরে।
জানালার পাশে বসেই নীল নদের দৃশ্য দেখে আরো অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু বাস্তবতার টানে আমাকে উঠতে হলো। দ্রুত গোসল-নাস্তা সেরে হাজির হলাম লবি-তে। দেখলাম সময়ের আগেই ট্যুর কোম্পানীর লোক এসে অপেক্ষা করছে ওখানে।
মুখে মানানসই চাপ দাঁড়ি, বয়স ত্রিশ এর কোঠায়, আমার গাইড এসে প্রথমেই ‘আসসালামু আলাইকুম’ সম্ভাষণ জানিয়ে একটি পলিথিনে মোড়ানো ব্যাগ আমার হাতে তুলে দিলো। নাম বললো- ইব্রাহীম। তিনি স্থানীয় ট্যুর কোম্পানীর গাইড। আজ সারাদিন তিনি আমাকে সঙ্গ দেবেন। তার সাথে আমি দেখবো খুফুর পিরামিড, স্ফিংস, সাক্কারা এবং মেমফিস। তার পর মরুদ্যানের কোন এক রেস্তোরায় মিশরের খাবার খেয়ে ফিরে আসবো হোটেলে।
ব্যাগে কি জানতে চাইলে মৃদু হেসে ইব্রাহীম জানায় কিছু ফল আছে এতে। যেহেতু মিসরে আমি অতিথি তাই অতিথিকে কিছু খাবার-দাবার দিয়ে বরণ করতে হয় এটাই তাদের নিয়ম। যাহোক, ফলের ব্যাগটা রেখে এলাম। অনিয়ম তো করতে পারি না!
গাইড ইব্রাহীমের সাথে নীচে নেমে এলাম। সেখানে গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছিলো ড্রাইভার মোহাম্মদ। তার সাথে সালাম বিনিময় করে উঠে পরলাম গাড়ীতে। গাড়ী ছুটে চললো গীজার পিরামিডের দিকে।
গাড়ীতে উঠেই ইব্রাহীম তার ডিউটি শুরু করে দিলো। অর্থাৎ ধারা বর্ণনা। সমগ্র পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ জায়গা জুড়ে আফ্রিকা মহাদেশের অবস্থান। সেই আফ্রিকার উত্তর প্রান্তেই ১০ লাখ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই মিশর। রাজধানী কায়রো পুরো আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম বড় শহর।
গাইড আগেই জানিয়েছিলো হোটেল থেকে পিরামিডে পৌছাতে সময় লাগবে আধা ঘন্টার মতো। কিন্তু রাস্তায় প্রচন্ড যানজট। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কোন বালাই নেই। বাস-কার-ট্রাক যে যার মতো চলছে। আমেরিকায় লেটেস্ট মডেলের গাড়ী দেখা আমার চোখ বারবার আটকে যাচ্ছিলো। রাস্তার বাসগুলো বাংলাদেশের ৩০ বছরের আগেকার সদরঘাটের মুড়ির টিন বাসগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো। কারগুলো সব পুরনো মডেলের।
কিছুটা সময় নীল নদের তীর ঘেঁসে চলছিলো আমাদের গাড়ী। ইব্রাহীম নীল নদের বর্ণনা দিতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলো বারবার। বলছিলো মিশর হচ্ছে নীল নদের দান। প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত মিশর টিকে রয়েছে এই নীল নদের জন্য। বৃষ্টি-বিরল মিশরে প্রতি গ্রীষ্মকারে প্রবল বণ্যার সময় নীল নদের গতি পথের দু পাশের ভূমি প্লাবিত হয়ে যেতো। ফলে দুই পাশেই পলিমাটি জমে জমি হয়ে উঠতো উর্বর ও শস্য-শ্যামলা।
নীল নদের এক তীর ঘেঁষে চলছিলো আমাদের গাড়ী। দেখছিলাম দুই তীর ঘিরেই গড়ে উঠেছে শহর। মনোমুগ্ধকর সুউচ্চ দালান, কারুকার্য খচিত অসংখ্য মিনার, ফ্লাই ওভার, প্রশস্ত রাস্তা দুই পাড়েই। গাইড জানালো মিশর সরকারের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পর্যটন। আর তাই পর্যটকদের সুবিধার্থে নীল নদের দুই তীরেই তৈরী করা হয়েছে ফাইভ স্টার হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, স্পা ইত্যাদি।
গাইডের সাথে গল্পে-স্বল্পে কখন যে সময় কেটে গেলো টের পাইনি। গাড়ীর জানালা দিয়ে নীল নদের দু’পাশের সৌন্দর্য দেখছিলাম। এক সময় গাইডের ডাকে চমক ভাঙলো। সামনে তাকিয়ে দেখুন- পিরামিড। চমকে চেয়ে দেখলাম পিরামিডের ত্রি-কোনাকার মাথা দেখা যাচ্ছে। ক্রমেই চোখের সামনে হাজির হচ্ছিলো মহাকালের স্বাক্ষী পিরামিড। কালের আঁচরে কিছু ক্ষয় হয়েছে সত্যি কিন্তু তার মহিমা এখনো অমলিন।
আবাক কৌতুহল নিয়ে দূর থেকে দেখছিলাম পিরামিড। এর নির্মাণ কাঠামো, কৌশল আর বিশালত্বের সামনে মাথাটা যেনো নূয়ে আসতে চায়। এই সেই পিরামিড যার বিস্ময়ের কোন শেষ নেই। হাতে চিমটি কাটছিলাম, সত্যি আমি এখন মিশরে তো?
গাইডের তাগাদায় গাড়ী থেকে নামলাম। ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে চলে যাবে পার্কিং লটে। আমরা যাবো পিরামিডের কাছে। গাইড আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে ঢুকলো টিকেট কাটার জন্য। টিকিটের মূল্য পরিশোধ করা হয়েছিলো বুকিং-এর সময়েই। একটু পরেই টিকিট হাতে ফিরলো গাইড। তার সাথে গেট দিয়ে ঠুকলাম পিরামিড ”ত্ত্বরে। আবার শুরু হলো গাইডের লেকচার। বিরক্ত হবার কোন অবকাশ নেই। কারণ এটাই তার পেশা। ট্যুরিস্টকে খুশি করতে না পারলে তার চাকুরীটাই হারাতে হবে।
পিরামিড শব্দটি প্রাচীন গ্রীকদের দেয়া নাম। গ্রীক ভাষায় পিরামিড শব্দের অর্থ হলো খুব উঁচু। এক কথায় পিরামিড হলো পাথরের তৈরী বিশাল সমাধি সৌধ। এ পর্যন্ত মিশরে প্রায় ৮০টি পিরামিড বা তার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। ৭০টি এখন পর্যন্ত টিকে আছে। এই পিরামিডগুলো প্রাচীন রাজ বংশের আমলের ৩৫০০ থেকে ২৫০০ অব্দের মধ্যে নির্মিত।
আমাদের আজকের কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত গীজার তিনটি পিরামিড দেখা। এর একটি খুফুর পিরামিড (২৫৬০-২৫৪০) খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে নির্মিত। এর কয়েকশ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছুটা ছোট আকৃতির খাফ্রে’র পিরামিড এবং আরো কয়েকশ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মাঝারি আকারের ম্যানকাওরের পিরামিড। সর্বশেষ চত্তরের পূর্ব পাশে গ্রেট স্ফিংস দেখা।