হাবিব রহমান: মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে বিমান ল্যান্ড করার আগেই আকাশে বসে আমার গ্রুপ সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে ট্যুর প্লানটা খানিকটা পরিবর্তন করে নিলাম।সিডনী থেকে নিউজিল্যান্ড ঘুরে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা ভ্রমন শেষে মেলবোর্ন আসার কথা ছিল।কিন্তু ভাগ্যচক্রে যখন মেলবোর্নটাই তালিকার শুরুতে এসে গেল তাই অস্ট্রেলিয়া ভ্রমন এখান থেকে শুরুর ই সিদ্ধান্ত নিলাম।লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে সোজা হোটেলে এসে উঠলাম।
ভিক্টোরিয়া প্রদেশের রাজধানী মেলবোর্ন একটি অন্যতম জনবহুল সিটি।সিটি সেন্টার ,ফেডারেশন স্কয়ার,ইউরোর টাওয়ার ,রানী ভিক্টোরিয়া বাজার,রয়েস এক্সিবিশন ভবন শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্হান।ক্রিকেটের শহর মেলবোর্ন ,টেনিসের শহর মেলবোর্ন।বিশ্ব সংস্কৃতির মিলনমেলা অপরুপ সৌন্দর্যর শহর মেলবোর্ন শহর ভ্রমনের সুযোগ পেয়েছি বলে মনটি একটি অন্যরকম ভালোলাগায় ভরে গেলো।
তবে মেলবোর্ন ভ্রমনের অন্যতম কারণ ছিলো বিখ্যাত গ্রেট ওশান রোড দেখা এবং পেঙ্গুইন প্যারেড পরিদর্শন।গ্রেট ওশান রোডের একটা কাহিনী আছে।তাহলো,১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্হায়ী হয় এবং প্রায় ৬০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান সৈনিক এই যুদ্ধে মারা যান।যুদ্ধফেরত সৈনিকরা শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে অটোয়া উপকুলের সব শহরকে সংযুক্ত করতে প্রায় ২০৩ কিলোমিটার লম্বা একটি সড়ক বানানোর কাজ শুরু করেন।এটা নির্মান করতে লাগে ১৪ বছর।১৯৩২ সালে সড়কটি সাধারনের জন্য খুলে দেয়া হয়।এই সড়কটির নামকরণ করা হয় গ্রেট ওশান রোড।এই সড়কটি শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত সবচেয়ে বড় স্মৃতি স্মারক আর সৈনিকদের ভ্রাতৃত্ববোধের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত।
আর অস্ট্রেলিয়ার ওয়াইল্ড লাইফের এক অনন্য নিদর্শন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রজাতির পেঙ্গুইন।প্রতিদিন সূর্য ডুবার সময় সাগর থেকে হাজার হাজার এই ছোট পেঙ্গুইনের মিছিল উঠে আসে বালিতে নিজের ঢিবিতে ফিরবার জন্য।আর তাই দেখতে সারা বিশ্বের পর্যটক এসে ভীড় করেন মেলবোর্নের সাগর পাড়ের ফিলিপ আইল্যান্ডে।যা দেখা ছিল আমাদের সবার আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু।
যাই হোক হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে লবির একটা ট্রাভেল এজেন্সী থেকে টিককিট ক্রয় করে গাইডের সাথে বেরিয়ে পড়লাম মেলবোর্ন সিটি পরিদর্শনে।
গাড়ী ছুটে চলছিলো মেলবোর্নের রাজপথ ধরে।এক একটা ভবন পার হচ্ছিলাম আর তার নাম ধাম ইত্যাদি বর্ণনা করছিলো গাইড।এক সময় পার হয়ে গেলাম পাবলিক লাইব্রেরি, রয়েস মেলবোর্ন ইন্সটিউট অব টেকনোলজি,মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি।গাইডের বর্ণনায় জানলাম মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।শহরের পাশে রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন,।পাশে হেলিপ্যাড।দেখলাম বিশ্ববিখ্যাত মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড।দূর থেকে মনে হচ্ছিলো যেন বিরাট একটা লোহার খাঁচা।বেশ কিছু নদী আছে মেলবোর্ন শহরের পাশে।বন্যার হাত থেকে শহরকে রক্ষা করে এই নদী।বেশ বড় একটি নদী দেখালো গাইড নাম-ইয়ারা।নদীটিএকে বেকে অনেক দূর চলে গেছে।একেবারেই শান্ত নদী।ঢেউ নেই।ইয়ারার দুই পাড়ই সুন্দর করে বাঁধানো।পাশাপাশি আছে সাইকেল ট্রাক আর ফুটপাত।ফুটপাত দিয়ে মানুষ হাঁটছে।সাইকেল আরোহি চলছে সাইকেল ট্রাকে।ইউরোপের দেশ ডেনমার্ক আর আমস্টারডাম এর পর এই মেলবোর্ন শহরে সাইকেলের আলাদা লেন দেখে ভালো লাগলো।শুনেছি ডেনমার্কে নাকি গাড়ীর চাইতে সাইকেলের পরিমান বেশী।ট্রেন স্টেশনের পাশে সে সব দেশে বহুতল বিশিস্ট সাইকেল পার্কিং ও দেখেছি।ইয়ারা নদীর এক পাড়ে মেলবোর্নের বানিজ্যিক এলাকা আর অপর পাড়ে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।আর্ট সেন্টার । পাশেই মেলবোর্ন সিম্ফনি অপেরা হল।রাস্তার মোড়ে মোড়ে বার।সেয়ান্সটন স্ট্রিটের উপর মেলবোর্ন সিটি হল।দেখলেই মনে করিয়ে দেয় অনেক প্রাচীন এই ভবনটি।গাইড জানালো মেলবোর্ন শহরের বয়সদুশো বছরেরও বেশী ।আর ভবনটিও সে সময়কার।তবে ভালোভাবে রক্ষনাবেক্ষন করায় শরীরে তেমন বার্ধ্যকের ছাপ পড়েনি।রাস্তায় একটু পর পর ম্যাকডোনাল্ডের দোকান চোখে পড়লো।ইউরোপের প্রতিটি শহরে ম্যাকডোনাল্ডের ছড়াছড়ি।অস্ট্রেলিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়
দেখে খুব ভালো লাগলো।
মেলবোর্নের সবচেয়ে বড় রেল স্টেশন-ফিল্ডার স্ট্রিট স্টেশনের পাশে গাইড গাড়ী থামিয়ে একটু সুযোগ দিলো ছবি তোলার জন্য ।দেয়ালজুড়ে অনেকগুলো ঘড়ি লাগানো হয়েছে এতে বিভিন্ন লাইনের সময়সূচি প্রদর্শিত হচ্ছে।স্টেশনের পাশেই বিশাল গীর্জা।ইউরোপের বড়বড়গীর্জার মতোই কারুকার্য খচিত।
চলার পথে রাস্তার পাশে কোথাও কোথাও চোখে পড়লো ওপেন এয়ার মার্কেট।অনেকটা নিউইয়র্কের ফ্লিয়া মার্কেটের মতো।ছোট ছোট টেবিল পেতে যে যার পসরা সাজিয়েছে।খাবারের দোকান থেকে শুরু করে হস্তশিল্প ,গয়না ,তৈরি পোষাক,বই সহ আরো কতো কি ! মানুষ ভীড়করে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনছে।মনে হলো কতো দেশের মানুষ!এর মাঝে কাঁধে রেকস্যাক বাঁধা পর্যটকের সংখ্যাই বেশী।
এর পর গাড়ী এসে থামলো অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড়ক্যাসিনো ক্রাউন কম্লপ্লেক্স এর সামনে।গাইড জানালো এই কমপ্লেক্সে ক্যাসিনো ছাড়াও রয়েছে ফাইভস্টার হোটেল ,শপিং মল,বার,সিনেমা হল,রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি।গাইড একটা অবাক করা তথ্য জানালো।তাহলো পৃথিবীতে অস্ট্রেলিয়ানরাই নাকি সবচেয়ে বেশী জুয়া খেলে।সারা পৃথিবীতে জুয়া খেলার যত ইলেকট্রনিক মেশিন আছে তার পাঁচ ভাগের একভাগ আছে এই অস্ট্রেলিয়ায়।অথচ অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তিনশোভাগের একভাগ।অস্ট্রেলিয়ারগড়ে শতকরা বিরাশিভাগ মানুষ কোন না কোন রকমের জুয়া খেলে। একজন সাধারন মানের জুয়ারীও বছরে গড়ে ৬২৫ ডলার জুয়া খেলে।আর প্রতি ১০ জন জুয়ারির মধ্যে কমপক্ষে একজন আত্মহত্যা করে।
কমপ্লেক্সের আঁশে পাশে অনেকগুলি ফোয়ারাও চোখে পড়লোএখানেও গাইড আমাদের একটু সময় দিলো ফটো সেসানের জন্য ।তারপর গাড়ী ছুটলো রাজপথ ধরে।
কতক্ষন পর গাড়ী এসে থামলো একটা বড় সড়ক্যাফের সামনে।গাইড জানালো এখানে কফি বিরতি।কফি খেয়ে ফ্রি টাইম পাওয়া যাবে আরো আধ ঘন্টা ।একটু এদিক সেদিক ঘোরা যেতে পারে।সবাই এই সূযোগে এদিক সেদিক ঘুরতে গেলেও আমি আলাপ জমালাম গাইডের সাথে জানতে চাইলাম মেলবোর্নে বাংলা দেশী কমিউনিটি সম্পর্কে তার কোন ধারনা আছে কিনা।আমাকে অবাক করে গাইড জানালো এখানকার বাংলাদেশী কমিউনিটি খুব জনপ্রিয়।তারা সারা বছর অনেক অনুষ্ঠান করে।তার কিছু বাংলাদেশী বন্ধুও আছে যাদের সাথে সে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান ও সে উপভোগ করেছে।এর মাঝে আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারী এবং বাংলা নব বর্ষের জমজমাট অনুষ্ঠান তার কাছে খুব ভালো লেগেছে।সে আরো জানালো মেলবোর্ন বাংলা স্কুল এবং মেলবোর্ন বাংলাদেশী কমিউনিটি ফাউন্ডেশন তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য মেলবোর্নে বসবাস রত অন্যান্য কমিউনিটির কাছেও খুব সুপরিচিত।ভিনদেশী একজন মানুষের কাছে নিজের দেশ এবং প্রবাসে বসবাসরত দেশী ভাইদের প্রশংসা শুনতে পেয়ে মনটা গর্বে ভরে উঠলো।
বিরতির সময় শেষ হওয়ায় গাইড উঠে দাড়িয়ে গাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো।এবার আবার যাত্রা শুরু হবে মেলবোর্নের অন্যস্থান দর্শনীয় গন্তব্যে।