হোটেলের নাস্তা সেরে সকার সকাল বেরিয়ে পড়লাম। মক্কায় ইব্রাহীম আল খলিল রোডে আমার হোটেল হায়াৎ রিজেন্সীর সামনে থেকে ট্যাক্সি যায় সোজা নবীর শহর মদিনায়। দর-দাম করে একটি ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলাম। ৭ সিটের ট্যাক্সি। একটু পর লোক ভর্তি হলে রওনা দিলো মদিনার উদ্দেশ্যে। ড্রাইভারকে আমি আগেই বলে রেখেছিলাম- আমাকে মদিনায় আমার হোটেলে নামিয়ে দিতে।
মিনিট দশেক চলার পর একটা গ্যাস ষ্টেশনে গিয়ে গাড়ী থামলো। সবার কাছ থেকে অগ্রিম ভাড়া নেয়া শুরু করলো ড্রাইভার। কেউ অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে দেয়ার ভয় দেখাচ্ছিলো। আমি কিছু না বলে গাড়ী থেকে নামলাম। তার গাড়ীর নাম্বার প্লেটের ছবি তুললাম। ছবি তুললাম ড্রাইভারেরও। মধ্য বয়সী ড্রাইভার, মাথায় টুপি এবং সৌদি রুমাল। তার ছবি কেন তুলছি জানতে চাইলে বললাম- তুমি যাত্রীদের সাথে যে আচরণ করলা তা আমার কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর আমি তোমাকে অগ্রীম অর্থও পরিশোধ করবো না। মদিনায় আমার হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেই তবে তোমার পাওনা অর্থ পাবে। আর যদি আমার সাথে বেয়াদবী করো তাহলে তোমার ছবি সহ ট্যাক্সি নম্বর আমি পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দিবো। তখন শুধু আমি নই এই ট্যাক্সির অন্য যাত্রীরাও তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবে। তারপর পুলিশ যা ভালো বুঝে তাই করবে।
পুলিশের কথা শুলে জোকের মুখে লবন দেয়ার মতো অবস্থা হলো ড্রাইভারের। কোন কথা না বাড়িয়ে সোজা গাড়ীতে গিয়ে বসে রওনা হয়ে গেলো মদিনার পথে।
প্রায় ৪০০ কিলোমিটার রাস্তা চুপচাপ পাড়ি দিলো ড্রাইভার। মদিনা শহরে এসে রাস্তা থেকে দূরে আমার ম্যারিয়ট হোটেল আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে নামতে বললো। আমি তার পাওনা মিটিয়ে দিলে সে চলে গেলো। আমি অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলাম যে, সে আমার হোটেলের সামনে দিয়েই যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম যাবার বেলায় একটা ছোট্ট প্রতিশোধ নিয়ে গেলো।
লাগেজ দুটো ঠেলে ঠেলে হোটেলে গিয়ে পৌছলাম। একজন বাংলাদেশী হোটেল কর্মী আমাকে রিসিভ করলেন। তার নাম আলাউদ্দিন, বাড়ী চাঁদপুর। তিনি খুব দ্রুত ফরমালিটিজ শেষ করে আমার লাগেজ সহ ১০ তলায় আমার রুমে পৌছৈ দিলেন। বললেন- পাশেই একটি পাকিস্থানী হোটেল আছে, দুপুরের খাবার খেতে পারবো সেখানে। নবীর রওজা মোবারক হাঁটা দূরত্বেই। তারপরও তাদের গাড়ী আছে, যা আমি ব্যবহার করতে পারবো। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিশ্রামের জন্য রুমে গেলাম।
প্রায় ৪০০ মাইল জার্নি করে ক্লান্তি ভর করেছিলো শরীরে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। আজানের মধুর শব্দে ঘুম ভাঙলো। তাড়াতাড়ি অজু করে নীচে নামলাম। গাড়ী নিয়ে আলাউদ্দিন অপেক্ষা করছিলেন নীচে। অল্প সময়ে তিনি আমাকে পৌছে দিলেন নবীর রওজা মোবারকের গেটে।
মদিনা মানে শহর। এই মদিনার আগে নাম ছিলো ইয়াসরিব। ইয়াসরিব অর্থ অলক্ষুনে, বা কু লক্ষণে। রসুলে করীম (সা:) হিজরতের পর ইয়াসরিবের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেন মদিনাতুন নবী। বা নবীর শহর। যাকে সংক্ষেপে বলা হয় মদিনা। আবরীতে বলা হয় মদিনা মনোওয়ারা। তথা আলোক শহর বা আলোকিত নগরী।
এই সেই মদিনা। পূণ্য ভুমি মদিনা। যে মদিনাকে নিয়ে কত কবি তাঁদের কবিতার লিখেছেন। বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে রয়েছে এই পবিত্র নগরী ঘিরে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। প্রিয় নবী (সা:) তাঁর জীবনের শেষ ১০ বছর এই নগরীতেই কাটিয়েছেন। বেশীরভাগ ওহি এই নগরীতেই নাজিল হয়। এই নগরীকে কেন্দ্র করে তিনি আল্লাহর সাহায্যে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই মদিনার অধিবাসীরাই তার বিপদের সময় আশ্রয় দিয়েছিলো, ভালোবেসে টেনে নিয়েছিলো বুকে। আমৃত্যু তিনি এই শহরটিকে ভুলেননি। ভুলেননি এই শহরের অধিবাসীদের। তাইতো মক্কা বিজয়ের পরও বসবাসের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রিয় মদিনাকে।
আমি মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করে গেলাম নবীজিকে সালাম পৌছে দিতে। যেজন্য আমি নিউইয়র্ক থেকে এখানে ছুটে এসেছি। বাব অসসালাম গেট দিয়ে ঢুকলাম রসুল (সা:) রওজা মোবারকের উদ্দেশ্যে। মসজিদে নববীর পশ্চিম পাশের গেট-কে বাব আসসালাম বলা হয়। গেটে প্রচার ভীড়। আমাকে হাঁটতে হচ্ছিলো না। ভীড়ের ঠেলায় নিজের অজান্তেই সামনে এগুচ্ছি। একসময় পৌছে গেলাম হুজুর পাক (সা:) এর রওজা মোবারকের সামনে। যতই নবীর রওজা মোবারকের কাছাকাছি হচ্ছি ততই শরীর ও মন শিহরীত হচ্ছিলো। কত বছরের লালিত সাধ প্রিয় নবীর মাজারে গিয়ে সালাম পেশ করা। সেই সাধ আজ পূরণ হতে চলেছে। নবীর রওজার সামনে গিয়ে সালাম পেশ করতেই আবেগে দু চোখের অশ্রু ঝরে পরছিলো। নবীর পাশেই শুয়ে আছেন তার প্রিয় সাহাবী হযরত আবু বকর (রা:) ও হযরত ওমর (রা:)। তাদেরও সালাম জানালাম। রওজা মোবারকের ভিতরে আরো একটি কবরের জায়গা খালি আছে। কথিত আছে সেখানে হযরত ঈশা (আ:) এর কবর হবে। এখানে উল্লেখ্য, হযরত ওমর (রা:) কে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানেই বিবি আয়শা সিদ্দিকা (রা:)-এর কবর দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তার জন্য নির্ধারিত সমাধি স্থানে তারই অনুমতিতে হযরত ওমর (রা:)-কে সমাহিত করা হয়।
ইচ্ছে থাকলেও বেশীক্ষণ অপেক্ষ করার সুযোগ ছিলো না। একদিকে পুলিশের তাড়া, অপরদিকে পেছন দিক থেকে জনতার চাপ। তাই আস্তে আস্তে সামনের দিকে রওনা হলাম। বাবে জিবরাইল মসজিদে নববীর বহির্গমন দরজা। এখানে হযরত জিবরাইল (আ:) ওহি নিয়ে অপেক্ষা করতেন। তাই এই নামকরণ করা হয়েছে।
মসজিদে নববীর অদূরেই জান্নাতুল বাকি। যেখানে বিবি ফাতেমা, হযরত ওসমান (রা:) সহ ১০ হাজার সাহাবীর কবর রয়েছে। প্রতিদিন ফজর এবং আসরের নামাজের পর জান্নাতুল বাকির দরজা খুলে দেয়া হয়। তাই দ্রুত ছুটলাম জান্নাতুল বাকিতে শায়িত সাহাবীদের কবর জিয়াতের জন্য। আরবীতে জান্নাতুল বাকীর নাম বাকী উল গারকাদ। যদিও মদিনাবাসীর কাছে এটা জান্নাতুল বাকি নামে পরিচিত। জান্নাতুল বাকি মসজিদে নববীর পূর্ব দিকে অবস্থিত। এখানে ১০ হাজার সাহাবীর কবর থাকলেও কোন কবর চিহ্নিত নেই। এই কবর স্থানের গোড়া পত্তন হয় ইসলামের সূচনা থেকেই। হযরত মুহাম্মদ (সা:) প্রায় শেষ রাতেই জান্নাতুল বাকিতে যেতেন এবং দোয়া করতেন। হুজুরে পাক (সা:) মদিনা থাকা অবস্থায় তাঁর দুধ ভাই হযরত ওসমান ইবনে মজউন (রা:) এর মৃত্যু হয়। তখন সাহাবী কেরাম হুজুর (সা:)-কে জিজ্ঞাসা করেন তাকে কোথায় দাফন করা হবে। হুজুর (সা:) তখন বলেন- আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে তাকে বাকি-উল গারকাদ-এ দাফন করার জন্য। আর এভাবেই জায়গাটা কবর স্থানের জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়ে যায়।
সৌদি সরকার দু’বার জান্নাতুল বাকি-কে সংস্কার করেছে। প্রথম সংস্কার হয় বাদশা ফয়সল ইবনে আব্দুল আজিজের সময়। দ্বিতীয় সংস্কার হয় বাদশা ফাহাদের সময়। এসময় আশপাশের সকল মহল্লা বা সড়ক উচ্ছেদ করে জান্নাতুল বাকিতে সংযোগ করে কবর স্থানটি প্রশস্ত করা হয়। এখন জান্নাতুল বাকির চতুর্দিকে ১৭২৪ মিটার লম্বা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। দেয়ালে লাগানো হয়েছে মর্মর পাথর। জান্নাতুল বাকির এক পাশে মৃতের গোছল দেয়া ও কাফন পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
জান্নাতুল বাকি জিয়ারতের জন্য ফজর ও আসর নামাজের পর খুলে দেয়া হয়। শুধুমাত্র পুরুষরা জিয়ারতের জন্য ভিতরে যেতে পারেন কারণ হিসেবে বলা হয় নারীদের জন্য ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক কবর জিয়ারত করা বৈধ নয়। জানা যায়, ওসমানী খেলাফত পর্যন্ত জান্নাতুল বাকিতে সাহাবাদের কবর স্থান চিহ্নিত ছিলো। পরে কবরকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের কুসংস্কার চালু হলে সৌদি সরকার সব কবর ধ্বংস করে দেয়। তবে মদিনায় যারা দীর্ঘদিন ধরে আছেন তাদের মতে জান্নাতুল বাকিতে প্রবেশের মুখে আলাদা করে ঘেরাও করে রাখা কবর দু’টোর একটি কবর হযরত ফাতেমা (রা:) এবং অপরটি হযরত আয়শা (রা:)-এর। আর কবর স্থানের একেবারে শেষ মাথায় রয়েছে খলিফা হযরত ওসমানের কবর।