আজ রাতেই মদিনা ছেড়ে জেদ্দার পথে রওনা হবো। সকাল ছয়টায় ফ্লাইট। তিনটায় রিপোর্ট করতে হবে এয়ারপোর্টে। শেষ দিন দূরে কোথাও না গিয়ে মসজিদে নববীতে বেশী সময় দেয়ার পরিকল্পনা করলাম। ঢাকার প্রাক্তন মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফের ভায়রা ভাই এবং সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের খালু হারুণ ভূইয়া তার এক আতœীয়ের সাথে দেখা করতে বলেছিলেন। তার নাম ইকবাল। যিনি গত ১৮ বছর যাবৎ মসজিদে নববীতে খাদেম হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি আগেও একবার আমার সাথে দেখা করে গেছেন। আজ মসজিদে নববীতে সারাদিন আমার সাথে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি হারাম শরীফ সংলগ্ন আমার হোটেল হিলটনে এলে তাকে নিয়ে মসজিদে নববীতে গেলাম।
ইকবাল জানান, প্রথম হিজরী সনে নির্মিত এই মসজিদের আয়তন ছিলো ৮৫০ দশমিক ০৫ বর্গমিটার। বিভিন্ন সময়ে মসজিদটির সংস্কার ও সম্প্রসারণ করার পর এর বর্তমান কাঠামো নান্দনিক রূপ নিয়েছে। এখন মসজিদটির আয়তন ৯৮ হাজার ৫০০ বর্গমিটার। মসজিদের ভিতর ১ লাখ ৬৬ হাজার, ছাদের উপর ৯০ হাজার এবং বাইরের আঙ্গীনায় মোট ২ লাখ ৫০ হাজার সহ সর্বমোট ৬ লাখ মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদে ১০টি মিনার ৮টি ফোল্ডিং ছাতা, ২৭টি গম্বুজ, ৭টি প্রবেশ পথ এবং ৮২টি দরজা আছে। মসজিদের বাইরে আন্ডার গ্রাউন্ডে তিন তলা পর্যাপ্ত টয়লেট, অজুর জায়গা এবং গাড়ী পার্কিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে পাঠাগার ও লাইব্রেরী।
ইকবাল আরো জানান, মসজিদে নববীতে প্রথমে কোন গম্বুজ ছিলো না। মসজিদের প্রথম সম্প্রসারণ উমাইয়া বংশের খলিফা ওয়ালিদ কর্তৃক হয়েছিলো। ১২৭৯ খ্রীষ্টাব্দে মসজিদে প্রথম কাঠের গম্বুজ তৈরী হয়। এরপর অনেকবার এর সংস্কার কাজ করা হয়। রওজা মোবারকের গম্বুজটিকে সবুজ রঙ-এ রঙ্গীন করা ১৮৩৭ সালে। মসজিদের বাইরেও বেশ কয়েকটি স্লাইডিং গম্ভুজ রয়েছে। জোহর নামাজের পর এই গম্বুজগুলো সরে যায় এবং মসজিদে সূর্যের আলো এসে পড়ে। এই স্লাইডিং গম্বুজগুলোর পরিকল্পনা করেন জার্মান স্থপতি মাহমুদ বডো রাসের। সমগ্র আরব উপদ্বীপের মাঝে মসজিদে নববীতে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি আসে ১৯০৯ সালে।
তারপর আমরা গেলাম রিয়াজুল জান্নাতে। মসজিদে নববীতে হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর রওজা মোবরক এবং তার সময়ের মূল মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থানকে বলা হয় রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেস্তের বাগান। মসজিদের অন্য কারপেটগুলো লাল রংয়ের হলেও এই জায়গার কার্পেট সবুজ-সাদা রংঙের। ভিন্ন রং-এর কার্পেট দেখে এই জায়গাটা সহজেই চেনা যায়। রিয়াজুল জান্নাত সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহ এই স্থানটুকু বেহেস্তে স্থানান্তর করবেন। এখানে নামাজ ও জিকির করলে রহমত ও সৌভাগ্য লাভ করা যায়। এই জয়গাটিতে নামাজ পড়ার জন্য সবসময় ভীড় হয়। সৌদী পুলিশরা গ্রুপে গ্রুপে এখানে প্রবেশ করার সুযোগ দেন। শুধুমাত্র ২ বা ৪ রাকাত নামাজ নামাজ পড়ার সময় পাওয়া যায়। তারা প্রায় ধাক্কিয়েই মুসল্লিদের বের করে দিয়ে অপেক্ষমান অন্য গ্রুপকে নামাজ পড়ার সুযোগ দেন। আমরাও খুব দ্রুত ২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিলাম।
রিয়াজুল জান্নাতের ভিতরে কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে। এগুলোকে রহমতের স্তম্ভ বলে। রসুল (সা:)-এর সময় মসজিদে নববীতে খেজুর গাছের খুটি ছিলো। ওসমানী সুলতান আব্দুল মজিদ খেজুর গাছের খুটির স্থলে পাকা পিলার নির্মাণ করেন। এগুলোর গায়ে মর্মর পাথর বসানো এবং স্বর্ণের কারুকাজ করা রয়েছে। রিয়াজুল জান্নাতের একটি খুটির নাম ওস্তোয়ানা হান্নানা। বাংলায় এর অর্থ ক্রন্দসী খুটি। হাদিসে বর্ণিত আছে প্রথম দিকে হুজুর (সা:) একটি খেজুর গাছের খুটির সাথে হেলান দিয়ে জুম্মার খুৎবা দিতেন। যখন স্থায়ী মিম্বার বানানো হলো তখন হুজুর (সা:) সেখানে দাঁড়িয়ে খুৎবা বয়ান করতে গেলে হুজুর (সা:)-এর সাথে বিচ্ছেদের কারণে এই খুটিটি এমন কান্না শুরু করে যে মসজিদের সব লোক স্তম্ভিত হয়ে যায়। তখন হুজুর (সা:) মিম্বর থেকে নেমে এসে খুটির গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে সে শান্ত হয়। পরে এই খুটিটি দাফন করা হয়।
একটি ভুল করার পর হযরত আবু লুবাবা (রা:) নিজেকে একটি খুটির সাথে বেধে বলেছিলেন, যতক্ষন পর্যন্ত হজুরে পাক (সা:) নিজ হাতে বাধন না খুলে দেবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সাথে বাঁধা থাকবো। নবী করিম (সা:) বলেন- যতক্ষন পর্যন্ত মহান আল্লাহ আমাকে আদেশ না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি সে বাঁধন খুলবো না। এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর হযরত আবু লুবাবা (রা:)-এর তওবা কবুল হয়। অতপর: রাসুল (সা:) নিজ হাতে তার বাঁধন খুলে দেন। ফেরেস্তা হযরত জিব্রাইল (আ:) যখনই হজরত দেহইয়া কালভী (রা:)-এর আকৃতি ধারণ করে ওহি নিয়ে আসতেন, তখন অধিকাংশ সময় যে খুটির কাছে বেশী বসে থাকতেন তাকে বলা হয় ওস্তোয়ানা জিবরাইল। হুজুর (সা:) যেখানে এতেকাফ করতেন এবং রাতে আরামের জন্য যে খুটির কাছে বিছানা স্থাপন করতেন সে খুটিকে বলা হয় ওস্তোয়ানা শারীর। এই খুটিটি হুজরা শরীফের পশ্চিম পাশে জালি মোবারকের সামনে রয়েছে। ওফুদ হলো ওয়াফদের বহুবচন। এর অর্থ হলো প্রতিনিধি। যেখানে বসে রসুল (সা:) দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিদের সাথে বসে আলাপ-আলোচনা করতেন সে খুটিটির নাম ওস্তোয়ানা ওফুদ। এখানে অনেক বিধর্মী রাসুল (সা;) এর কাছে বায়াত গ্রহণ করতেন। ইতিকাফের সময় মা আয়েশা (রা:) জানালা দিয়ে নবীজীর খেদমত করতেন। এই খুটিটির নাম ওস্তোয়ানা আয়েশা (রা:)। হারেস অর্থ পাহারাদার। যেখানে দাঁড়িয়ে হযরত আলী (রা:) নবীজীকে পাহারা দিতেন সেই খুটিটির নাম ওস্তোয়ারা হারেসা বা ওস্তোয়ানা আলী (রা:)। আমরা অত্যন্ত আদবের সাথে এসব খুটিগুলো জিয়ারত করলাম।
আমরা রিয়াজুল জান্নাত থেকে ডান দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে রসুল (সা:)-কে বিদায়ী সালাম জানিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মসজিদ চত্তরে বেরিয়ে এলাম। বিদায় নিলাম বিশ্ব মুসলিমের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চির জাগ্রত নবীর মসজিদ থেকে। যেখান থেকে সারা দুনিয়ার অর্ধেক থেকে বেশী এলাকা শাসন করা হতো ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে।
নবীর সহর ও মসজিদ-এ-নববীতে যাওয়ার সৌভাগ্য আল্লাহ দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। তবে আপনার পোষ্টে বেশ কিছু অজানা ইতিহাস জানতে পারলাম। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। মিঃ হাবিব, শুভ কামনা আপনার জন্য।
অনেক ভালো একটি পোস্ট।