পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অন্যতম হচ্ছে মিশরীয় সভ্যতা। প্রায় ৫ হাজার থেকে ৩ হাজার খ্রীষ্ট পুর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে মিশরে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটে। খ্রীষ্টপূর্ব ৪ হাজার অব্দে মিশরে হায়ারোগ্লিফিক বা চিত্রলিপি এক উন্নত লিখন পদ্ধতির উদ্ভব হয়। নল খাগরা জাতীয় গাছের মজ্জা থেকে তৈরী প্যাপিরাস নামের এক ধরণের কাগজের উপর তারা লেখার কাজ সম্পন্ন করতো। প্রাচীন মিশরেই জন্ম হয় গণিত শাস্ত্র এবং জ্যামিতির। ক্যালেন্ডার তৈরি করা প্রথম কৃতিত্বও তাদেরই। ছবিতে দেখা সুবিশাল গগণচুম্বি পিরামিড, অত্যাচারী ফেরাউন, নীল নদ, মুসা নবীর দেশ, মমির গল্প, সব মিলিয়ে আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো মিশর। এবারে আমার আমেরিকান ট্যুরিস্টদের নিয়ে ভ্রমণের সমাপ্তি ছিলো গ্রীসের এথেন্সে। তাদের সবাইকে এথেন্স বিমানবন্দর থেকে নিউইয়র্কের বিমানে তুলে দিয়ে আমি রওনা হলাম কায়রোর পথে। আমার এই ভ্রমণ ছিলো ইতিহাসের দুই দেশ মিশর ও তুরস্ক দেখা। আর নিউইয়র্ক ফেরার পথে প্যারিস।
এথেন্স থেকে আমার কায়রো ফ্লাইট ছিলো রাত ১২টায়। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে ইজিপ্ট এয়ারের বিমানে চড়েই সীটে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। গত কয়েকদিনে শরীরের উপর দিয়ে বেশ ধকল গিয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে ট্যুর গ্রুপ নিয়ে প্রথমে আইসল্যান্ড, পরে নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম হয়ে গ্রীসের এথেন্সে গিয়ে ট্যুরের সমাপ্তি। ট্যুরের প্রতিটি দিন ছিলো সকাল সন্ধ্যা প্রোগ্রামে ঠাসা। আজ এথেন্স থেকে নিউইয়র্কের পথে আমার ট্যুর গ্রুপ-কে বিদায় দিয়ে এখন আমার ফ্রি টাইম। আহ! কি প্রশান্তি!
এজিয়ান এয়ারলাইন্সের সরাসরি ফ্লাইটে এথেন্স বিমানবন্দর থেকে এক ঘন্টা ৫৫ মিনিটে চলে এলাম কায়রো। আগেই মিশরের ভিসা নেয়া ছিলো নিউইয়র্ক থেকে। তাই এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশি একটা বিলম্ব হলো না। আমেরিকান পাসপোর্টের বদৌলতে এয়ারপোর্টে হাঙ্গামা পোহাতে হয় খুব কম। বিমানবন্দর থেকে বেরুতেই ছেঁকে ধরলো দালালেরা। সবাই আমাকে সুলভ মূল্যে ট্যুর প্যাকেজ দিতে চায়। পিরামিড, আলেকজান্দ্রিয়া, লুক্সর, আসোয়ানবাঁধ – সবই তারা দেখিয়ে দেবে মনের মতো করে। আমি একটু রুঢ়ভাবেই বললাম, দেখো আমি একজন প্রফেশনাল ট্যুরিস্ট, সারা বিশ^ ঘুরে বেড়াই। কোথাও যাবার আগে আমি সে দেশ সম্পর্কে হোম ওয়ার্ক সেরে তবেই আসি। তাছাড়া আমি নিউইয়র্ক থেকে মিশর দেখার সব ট্যুর প্রোগ্রাম আগেভাগেই বুক করে এসেছি। এখানে ট্যুর সস্তা বা দামি তা দেখার এখন কোন অবকাশ নেই। আমার রুদ্র মূর্তি দেখে দালালদের অনেকেই কেটে পড়লো। দু একজন যা ছিলো তাদের পাত্তা না দিয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে বেরুলাম। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডেও একই অবস্থা। কেউ কেউ লাগেজ নিয়ে টানাটানি শুরু করলো। এদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিয়ে দ্রুত গাড়ীতে চেপে বসলাম। মিটার চালু করে ট্যাক্সি ছুটে চললো ডাউন-টাউন কায়রোর পথে।
ঘড়ির কাঁটায় তখন মধ্য রাত। তারপরও রাস্তাঘাট একেবারেই জনশূন্য নয়। কায়রো এয়ারপোর্ট থেকে আততাহরীর স্কোয়ার সংলগ্ন আমার হোটেলের দুরত্ব ২২ কিলোমিটার। ড্রাইভার আগেই জানিয়েছিলো ওখানে পৌঁছাতে আধা ঘন্টার বেশি সময় লাগবে না। বাস্তবেই তাই হলো। মাত্র ২৫ মিনিটে সে আমাকে নিয়ে এলো আমার বুক করা হোটেল নাইল রিজ কাল্টন এর সামনে। বিদেশ ভ্রমণে ভালো হোটেলে থাকা আমার একটা বিলাসিতা। ট্যুর গ্রুপ নিয়ে যখন কোন শহরে যাই, তখন স্বাভাবিকভাবেই সকলের কথা বিবেচনা করে মধ্যম মানের ট্যুরিস্ট হোটেল বেছে নিতে হয়। আর যখন একা ভ্রমণ করি, তখন আমি যুবরাজ। শহরের সেরা হোটেলটি আমার চাই। এবার কায়রোতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
ডলারের সাথে কায়রোর পাউন্ডের বিস্তর ব্যবধান থাকায় খুব সস্তায় এখানে হোটেল পাওয়া যায়। তাই ইন্টারনেট ঘেঁটে কায়রো সিটির কেন্দ্রস্থলে পাঁচ তারকা মানের এই হোটেলটি বেছে নিয়েছিলাম। ৩৩১টি গেষ্ট রুম, ৪টি রেস্টুরেন্ট আর ৫টি বারসহ সুবিশাল এই হোটেলটি ঐতিহাসিক আল তাহরীর স্কোয়ারের একেবারেই গাঁ ঘেষে। তাছাড়া কায়রোর বড় বড় হোটেলের যে কয়টি সরাসরি একেবারেই নীল নদের পাড় ঘেষে অবস্থিত, নাইল রিজ কার্ল্টন তার একটি। এর সামনেই বিখ্যাত ইজিপ্টসীয়ান মিউজিয়াম।
হোটেলের সামনে গাড়ি থামাতেই বেলবয় ছুটে আসলো। এসেই সালাম জানিয়ে লাগেজ তুলে নিয়ে প্রথমে রিসিপসন কাউন্টার এবং পরে রুমে পৌঁছে দিলো। জানতেই চাইলো ডিনার করেছি কিনা। বললাম – আকাশে বিমানের খাবার খেয়েছি। তবে এতো রাতে রেস্টুরেন্ট খোলা থাকলে খাবারে আপত্তি নেই। ছেলেটি তার নাম বললো- আহমেদ। সে বললো রাত বেশী হওয়ায় হোটেলের রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বাইরে এখনো প্রচুর রেস্টুরেন্ট খোলা আছে। আমি চাইলেই সে আমাকে নিয়ে আমার পছন্দমতো রেস্টুরেন্ট বেছে নিয়ে খাওয়াতে পারবে। আমি তাকে আধা ঘন্টা পরে আসতে বললাম। গোসল সেরে ফ্রেস হয়ে তার সাথে বেরুবো।
কাঁটায় কাঁটায় আধা ঘন্টা পরে দরজায় টোকা দিলো আহমেদ। আমি তৈরীই ছিলাম। তার সাথে বেরুলাম। জানতে চাইলাম, এতো রাতে রাস্তা-ঘাট নিরাপদ কিনা? আহমেদ তার ৩২ পাটি দাঁত বের করে বললো- স্যার নিশ্চিন্তে সারারাত কায়রো শহরে ঘুরে বেরাতে পারবেন। চোর-ডাকাত কারোরই টিকিটি খুঁজে পাবেন না।
রাস্তায় নেমে আহমেদের কথার সত্যতা পেলাম। মোড়ে মোড়ে কাফেগুলো জমজমাট। ক্যাফের পাশে খোলা জায়গায় চেয়ার-টেবিল পাতা। সবাই দল বেঁধে হোক্কা খাচ্ছে আর গল্প-গুজবে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে ফিরে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে কাবাব-নান কিনে ফিরে এলাম হোটেলে। আহমেদ এক কাপ গরম কফি নিয়ে এলো। খাবার খেয়ে বিছানায় গা এড়িয়ে দিতেই চারিদিকে মাইকে ভেসে এলো ফজরের আজান। মনে হচ্ছিলো ঢাকায় যেন শুয়ে আছি। আমেরিকার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে মাইকে আজান শুনিনি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে আজান শুনতে শুনতে চোখ মুদে এলো। সকালে বেরুতে হবে পিরামিড দর্শনে।