
মক্কার এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মসজিদ। রাসুল (সা:) এবং তার সাহাবীদের বিভিন্ন স্মৃতি ঘেরা স্থানে এসব মসজিদ গড়ে উঠেছে। আমরা গত তিনদিন ধরে সে সব স্মৃতিময় জায়গা চষে বেড়াচ্ছি। আমরা শুধুমাত্র দর্শক তাই কোথায় যাব বা কি দেখবো তা দেখার দ্বায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি আমাদের স্থানীয় গাইড তারিকের উপর। তার কথামত সকাল আটটায় হোটেল লবিতে অপেক্ষা করছিলাম। সময় মত সে এসে পৌছালে আমরা গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।
একটু পরেই গাড়ী এসে থামলো মসজিদে নামেরার সামনে। এটি মক্কা থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে মক্কা- মদীনা রোডের আলহিজরা এলাকায় তানঈম নামক স্থানে অবস্থিত। এজন্য এটাকে মসজিদে তানঈমও বলা হয়। মসজিদটি ইসলামী শিল্প নৈপুন্যের এক অনুপম নিদর্শন। বিশাল এই মসজিদের দুটি মিনার ও একটি গম্বুজ অনেক দূর থেকে দেখা যায়। বিবি আয়েশা (রা:) এর এই মসজিদ ঘিরে রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। হিজরী ১১ সনে রাসুল (স:) বিদায়ী হজ্ব করতে আসেন মক্কায়। তাঁর সফর সঙ্গী হন বিবি আয়েশা। তিনিও হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর সাথে হজ্ব ও ওমরাহ এর নিয়ত করেন। কিন্তু শরীর খারাপ হওয়ায় তিনি রাসুল (সা:) এর সাথে ওমরাহ পালন করতে পারেননি। পরে তিনি বিবি আয়েশার ভাই হযরত আব্দুর রহমানের সাথে হারামের বাইরে এখান থেকে ওমরাহ এর ইহরাম বাঁধার জন্য পাঠিয়েছিলেন। পরে এখানে এই মসজিদটি তৈরি করা হয়। মসজিদ এবং মসজিদ চত্বরটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ৪০ জন ক্লিনার কাজ করেন। আর এদের সবাই বাংলাদেশী। তাদের বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ হলো। আয়েশা মসজিদে দু’ রাকাত নামাজ পড়ে আমরা আবার গাড়ীতে এসে বসলাম।
ততক্ষনে ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। সবার পেটে ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছিলো। তারিককে বললাম হেরেম শরীফ সংলগ্ন বাংলাদেশী অধ্যুষিত মিসফালায় নিয়ে যেতে। ওখানেই আমরা লাঞ্চ করবো। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে কিশোর বয়স আমার মায়ের সাথে হজ্ব করতে এসে এই মিসফালাহয় একটি বাড়ীতে উঠেছিলাম। আমাদের সৌদি মুয়াল্লিম ইব্রাহিম ওজাইমি আমাদের পরিবারের ১১জন সদস্যকে এখানেই একটি সুন্দর বাড়ীতে রেখেছিলেন। এর পরেও কয়েকবার পবিত্র মক্কায় আসা হলেও মিসফালায় আসা হয়নি। তারিক জানালো এই এলাকায় ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক হোটেল রয়েছে। এর মাঝে দুই তৃতীয়াংশ পরিচালিত হয় বাংলাদেশীদের দ্বারা। এখানে অনেকগুলি মসজিদ রয়েছে। তার অধিকাংশ বাংলাদেশী ইমাম বা মুয়াজ্জিন। আছে জামা কাপড়, জুয়েলারী জুতা সহ নানাবিধ দোকান। আছে বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট। ভর্তা ভাজি থেকে সব ধরনের বাংলাদেশী খাবার পাওয়া যায়।
মিসফালাহ অর্থ নীচু এলাকা। পাহাড় ঘেরা মক্কায় অপেক্ষাকৃত নি¤œ ভূমি হচ্ছে এই এলাকাটি। হেরেম শরীফের পাশে ইব্রাহিম খলিল সড়কটি মিসফালাহ এলাকার মধ্য দিয়ে চলে গেছে মক্কা শহরের ভেতরে। রাস্তার এক পাশে খালি জায়গায় ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর চরে বেড়াচ্ছে। অনেকে শস্য দানা কিনে ছিটিয়ে দিচ্ছে কবুতরদের খাওয়ানোর জন্য। ভীড়ের জন্য গাড়ী আস্তে আস্তে যাচ্ছিলো। চারদিকে বাংলা কথা বার্তা কানে আসছিলো। মনে হচ্ছিলোনা বিদেশে কোথাও আছি।
তারিক বল্লো চলুন খাওয়ার আগে আরো একটি বাংলাদেশী এলাকা ঘুরিয়ে আনি। জায়গাটা মিসফালাহ থেকে খুব বেশী দূরে নয়। মিনিট পাঁচেক পর গাড়ী এসে থামলো একটি এলাকায়। জায়গাটির নাম নাক্কাসা। এখানে শুধু বাংলাদেশী নয় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলমানদেরও বসবাস। তাদেরও রয়েছে নানা ধরনের ব্যবসা। এখানে বাহারী রকমের শাক শব্জী, ফল, মুরগী, মাছ কিনতে পাওয়া যায়। এখানকার রেষ্টুরেন্টগুলি লাঞ্চ, ডিনারের পাশাপাশি বিকেল থেকে ছোলা, বুট, মুড়ি, পিয়াজু, কাবাব ইত্যাদি পাওয়া যায়। নাক্কাসা এলাকায় একটু ঘুরে ফিরে আবার ফিরে এলাম মিসফালাহ এলাকায়। বড় রাস্তা থেকে ভিতরে ঢুকে গেছে ছোট বড় গলি। গলির অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রথমেই দেখে থমকে গেলাম। তারপরও এসেছি যখন খেতে হবে। শুধু খেতে নয় পরিবেশ দেখার জন্যও। নীচে কিচেনে রান্না হচ্ছে। সিড়ি বেয়ে উপরে খাবার ব্যবস্থা। প্রতিটি রেষ্টুরেন্টের সামনে লোকজন দাড়িয়ে চিৎকার করছে। আসেন ভাই আমাদের এখানে ভাত, মাছ, গরু, খাসী, উট সব মাংস আছে। বলা যায় গ্রাহকদের নিয়ে টানাটানি। সারি সারি অনেকগুলি হোটেল। এর মাঝে থেকে বাংলাদেশ নামের হোটেলটা পছন্দ হলো। নীচে রাস্তায় দাড়িয়ে যেই ছেলেটি লোক ডাকছিল গায়ে লাল গেঞ্জি। সামনে পেছনে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। বাংলা ইংরেজীতে দুই ভাষায়ই বাংলাদেশ লেখা। নীচে দাড়ানো ছেলেটা আমাদের সাথে করে ওপরে নিয়ে এলো। টেবিল খালি নেই। একটু অপেক্ষা করার পর খালি হলে আমরা বসলাম। ভেতরটাও খুব অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্ন। কোন নেপকিন নেই। কাউন্টারের পাশে বড় গোল টিস্যুর রোল। আমাদের নিউইয়র্কে দোকানের বাথরুমে যেমন থাকে। নেপকিন চাইতেই বড় রোল থেকে ছিড়ে কয়েকটুকরা সামনে এনে রাখলো। যা হোক খাবারের অর্ডার দিলাম। বিভিন্ন রকমের ভর্তা ভাজি। তারপর গরু ভুনা এবং উটের মাংস। পছন্দ করে উটের মাংস নিয়েছিলাম। ছোট ছোট টুকরো করে গরুর মাংসের মত ঝোল দিয়ে রান্না করা। আমার কাছে গরুর মাংসের মতই মনে হয়েছে। আমার সঙ্গী নিউইয়র্কের বিখ্যাত শেফ খলিল বিরিয়ানী হাউজের স্বত্ত্বাধিকারী খলিল ভাই ছিলেন। এক একটা তরকারী তার কাছে নিলে তিনি তা সাথে সাথে নাকচ করে দেন। বল্লাম, এখানের শেফরা তো আপনার মত নিউইয়র্কের বিখ্যাত কুলিনারি ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে আসেনি। তাই রান্নার মান খুঁজবেন না। খেয়ে নিন। তিনি মৃদু হেসে খাওয়া শুরু করলেন। বুঝলাম ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য সবাই খেলেও কারো তৃপ্তি হয়নি। খাওয়া শেষে চা দিতে বল্লাম। দুধ, তেজপাতা এলাচ মিশিয়ে মজাদার মশলা চা খাওয়ার কষ্ট ভুলিয়ে দিলো।
আমাদের আগেই খলিল ভাই নীচে নেমে গেলন। হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম তিনি একটা দোকানের সামনে অপেক্ষা করছেন। বললেন, আমি জানি সবারই পেটের কিছু অংশ খালি রয়ে গেছে। আমি খাঁটি আখের রস খাইয়ে সে অংশটুকু পূরণ করে দেবো। খলিল ভাই সবার জন্য আখের রস অর্ডার দিলেন। আস্ত আখ মেশিনে ঢুকিয়ে রস বের করে আইস মিশিয়ে সবাইকে পরিবেশন করল দোকানি। সবাই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে রওয়ানা দিলাম হোটেলের দিকে।