
বিশ্ব মুসলিমের মহা সম্মিলন এবং অসখ্য নবী ও রাসুল (সা:)-দের স্মৃতি বিজরিত আরাফাতের ময়দান ছেড়ে যেতে মন চাচ্ছিলো না। তারপরও যেতে হয়। তালিকার দর্শণীয় অনেক স্থান তখনো দেখার বাকী। তাই আস্তে আস্তে গিয়ে তারিফের গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। এক পর্যায়ে গাড়ী এসে থামলো আরাফাত ময়দানের শেষ সীমানায় মসজিদে নামিরার সামনে।
হজ্ব করতে আসা প্রত্যেকের কাছে মসজিদে নামিরা একটি পরিচিত নাম। আরাফা ময়দানের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত এই মসজিদ থেকেই হজ্বের খুৎবা দেয়া হয়। মসজিদের পশ্চিম পাশে ছোট একটি পাহাড় রয়েছে। যার নাম নামিরা। এই পাহাড়ের নামানুসারেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে। মসজিদে নামিরার আয়তন ১ লাখ ১০ হাজার বর্গমিটার। এখানে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। হজ্বের সময় ছাড়া বছরের অন্য সময় এই এলাকায় শুধু দর্শনার্থী ছাড়া স্থানীয় কেউ থাকে না। তাই মসজিদটি বেশীর ভাগ সময় বন্ধ থাকে।
বিদায় হজ্বের সময় এখানেই রসুল (সা:) এর তাবু স্থাপন করা হয়েছিলো। এখান থেকেই তিনি হজ্বের খুৎবা প্রদান এবং নামাজে ইমামতি করেন। যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে হজ্বের খুৎবা প্রদান এবং ইমামতি করেন ঠিক সেই জায়গাতেই হিজরীর দ্বিতীয় শতকে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানেও এই মসজিদ থেকে হজ্বের খুৎবা দেয়া হয়। স্থানীয় সময় অনুসারে সাধারণত: খুৎবা শুরু হয় দুপুর ১২টা ১৬ মিনিটে এবং শেষ হয় ১টা ১৬ মিনিটে। সৌদী আরবের রাজকীয় মুফতি এই খুৎবা প্রদান করে থাকেন। হজ্বের খুৎবা শেষে এখান থেকেই জোহরের আজান হয় এবং একই আজানে দুই একামতে জোহর ও আসরের কসর দুই রাকাত নামাজ আদায় করা হয়। এই স্থানেই ফেরেস্তা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-কে হজ্বের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিয়েছিলেন। মসজিদে নামিরা খুবই দৃষ্টি নন্দন। এটাতে রয়েছে ৬০ মিটার উচু ছয়টি মিনার, তিনটি গুম্ভুজ, ১০টি প্রধান প্রবেশদ্বার এবং ৬৪টি দরজা। এই মসজিদটির কাছেই রয়েছে জাবালে রহমত হাসপাতাল। যেখানে আরাফাতের দিনে অসুস্থ হাজীদের জরুরী স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়।
আমরা যখন মসজিদে নামিরার কাছে গিয়ে নামলাম তখন এটি বন্ধ ছিলো। মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে মুনাজাত করে আবার গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। একটু পড়ে গাড়ী এসে থামলো মসজিদে খায়েফের সামনে। এই জায়গাটি মিনায় অবস্থিত এবং মক্কা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে। সওর পাহাড়ের বিপরীত দিকে পাহাড়ের অদূরে অবস্থিত এই মসজিদের উচু মিনারগুলো দূর থেকেই চোখে পড়ে। পাহাড়ের চেয়ে নীচে এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উঁচু স্থান-কে আরবী পরিভাষায় খায়েফ বলা হয়। আবার দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যাকাসম ভূমিকেও খায়েফ বলে আরবরা। জানা যায় নবী করীম (সা:) এখানে ৭০জন নবী নামাজ আদায় করেছেন এবং তাঁরা এখানেই সমাহিত। এই মসজিদে ৩০ হাজার মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটির চারকোনায় ৪টি সুউচ্চ মিনার এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। মসজিদের সামনে স্থাপিত সাইনবোর্ডে অনেকগুলো ভাষায় মসজিদের নাম লেখা রয়েছে। এরমধ্যে বাংলা ভাষাও একটি।
এরপর আমরা এলাম আরো একটি ঐতিহাসিক স্থান মুজদালিফায়। এর অর্থ মিলিত হওয়া, কাছে আসা, নৈকট্য হাসিল করা ইত্যাদি। স্থানটি আরাফাত ও মিনার মাঝামাঝিতে অবস্থিত একটি উপত্যকা। আদি পিতা হযরত আদম (আ:) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়া (আ:) এর আরাফাত প্রান্তরে প্রথম সাক্ষাতের পর তারা মুজদালিফাতে রাত্রি যাপন করেন। ৯ জিলহজ্ব সূর্যাস্তের পর হাজী সাহেবানরা আরাফাতের মাঠ থেকে এই মুজদালিফায় আগমন করেন এবং এখানে এসে এশার ওয়াক্তে মাগরিব ও এশার নামাজ পর পর একত্রে আদায় করেন। ইসলামী সাম্যের সবচেয়ে সেরা দৃষ্টান্ত এই মুজদালিফা। নীচে খালি মাঠ, উপরে খোলা আকাশ, খালি মাথা, খোলা পা, কাফনের কাপড় পরিহিত সাম্যের এরচেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। এখান থেকে বুটের দানার আকার পাথর সংগ্রহ করে পরদিন মিনায় গিয়ে শয়তানকে মারতে হয়।
হজ্বের সময় যেসব স্থানে যেতে হয় আমরা তারিফের সাথে সেই জায়গাগুলোই ভ্রমণ করছিলাম। আরাফাত, মুজদালিফার পর আমরা এলাম মিনায়। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। এর আয়তন ২০ বর্গ কিলোমিটার। হজ্বের সময় ১১ ও ১২ জিলহজ্ব হাজী সাহেবানরা এখানে অবস্থান করেন এবং প্রতিদিন তিনটি শয়তানের প্রতীক স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করেন। হজ্বের প্রধান করনীয় বিষয়গুলো পালন করতে হয় আরাফাত মুজদালিফায় এবং মিনায়। অন্য দুটি স্থানের মতো এই মিনারও ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) স্বপ্নে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কোরবানী করার জন্য আদিষ্ট হয়ে প্রিয়তম পুত্র নবী হযরত ইসমাইল (আ:)-কে কোরবানী করার সিদ্ধান্ত নেন। পুত্রকে নিয়ে তিনি এই মিনায় পৌছে শয়তান তিন স্থানে তাদের আল্লাহর হুকুম পালন করা থেকে নিবৃত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। এমন অবস্থায় তারা পাথর মেরে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন। তারপর এই মিনার-ই এক স্থানে পুত্র ইসমাইল (আ:)-এর গলায় ছুড়ি চালিয়ে দিলে আল্লাহর তরফ থেকে তা করতে নিষেধ করা হয়। এবং এটা যে পরীক্ষা ছিলো তা ঘোষিত হয়। এরপর পুত্রের পরিবর্তে একটি বেহেস্তী দুম্বা কোরবানী দেন হযরত ইব্রাহীম (আ:)। পিতা-পুত্রের সেই ত্যাগের ঘটনা স্মরণে প্রতি বছর হাজীরা মিনায় পাথর নিক্ষেপ ও কোরবানী করে থাকেন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) নবী হযরত ইসমাইল (আ:)-কে যে স্থানে কোরবানী করতে চেয়েছিলেন, সে জায়গাটি চিহ্নিত থাকলেও চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া থাকায় কাছে যাওয়া হয়নি। মিনায় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীর সাক্ষাৎ পেলাম, যারা এখানে কাজ করেন। প্রচন্ড রৌদ্রে পুড়ে তাদের চেহারা ছাই বর্ণ ধারণ করে আসে দেখে খুবই কষ্ট লাগলো।
মিনা থেকে আমরা এলাম মসজিদে জ্বীন দেখতে। এটিও একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে জ্বীনরা এখানে রাসুল (সা:)-এর কাছে ইমান এনেছিলো। এই মসজিদটি মসজিদে জীন নামে পরিচিত। ইতিহাসে আছে একদিন এখানে মহানবী (সা:) নামাজ আদায়কালে আকাশ পথে যাওয়ার সময় একদল জ্বীন কোরআনের অভিনবত্ত্ব ও সুমধুর সুরে আকৃষ্ট হয়ে থমকে যায় এবং এই ঘটনা তারা তাদের জাতির কাছে তুলে ধরে। অতপর তারা এই মসজিদের স্থানে এসে ঈমান এনে ইসলাম গ্রহণ করে।
মসজিদে জীন জিয়ারত শেষে আমরা এলাম জান্নাতুল মোয়াল্লা কবর স্থানে। এটি মসজিদুল হারাম থেকে অল্প দূরত্বে অবস্থিত। এখানে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর দাদা আবু মুত্তালিব, চাচা আবু তালিব, তাঁর প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজা, বড় ছেলে কাসিম, ইসলামের প্রথম শহীদ সোমাইয়া সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কবর রয়েছে। জান্নতুল মোয়াল্লা মক্কার সবচেয়ে বড় কবরস্থান। মোয়াল্লা শব্দের অর্থ হচ্ছে উঁচু। এই কবর স্থানটি একটি উঁচু স্থানে অবস্থিত বলে এটাকে মোয়াল্লা বলা হয়।
সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে সবাই ছিলাম ক্লান্ত। তাই গাইড তারিফ-কে বললাম সেদিনের মতো জিয়ারতে বিরতি দিয়ে হোটেলে পৌছে দিতে।