পবিত্র মক্কা নগরীতে আজ আমার শেষ দিন। কাল সকালে এই পবিত্র শহরটি ছেড়ে চলে যাবো নবীর (সা:) শহর মদিনায়। হোটেল থেকে বের হয়ে বিদায়ী তাওয়াফ করতে গেলাম। এখন হজ্বের সময় নয়। তারপরও মসজিদুল হারাম ও কাবা চত্তর লোকে লোকারণ্য। বর্তমান অবস্থায় ১০ লাখ মসুল্লি এখানে একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। হজ্ব মৌসুমে ৪০ লাখ মুসল্লীর স্থান সঙ্কুলান হয়। হারাম শরীফ এলাকার সংস্কার কাজ চলছে। আশা করা যায় এই কাজ সমাপ্ত হলে আরো অধিক পরিমান মুসল্লী একত্রে নামাজ আদায়ের সুযোগ পাবেন। কাবা চত্তরে ঢোকার জন্য মোট ৮১টি দরজা থাকলেও সংস্কার কাজ চালু থাকার কারণে অনেকগুলো দরজাই বন্ধ থাকে বিধায় মুসল্লীদের ঢুকতে কষ্ট হয়।
সৌদী সরকার শুধু কাবা ঘরের সংস্কার কাজই করছেন না। চারপাশের পরিবেশও করছেন দৃষ্টি নন্দন। আমি যে হোটেলটাতে ছিলাম এর নাম ফিয়ার মাউন্ট হোটেল। এটি যে টাওয়ারের উপর নির্মিত এটাকে বলা হয় ক্লক টাওয়ার। এই টাওয়ারে অনেকগুলো ৫ তারকা মানের হোটেল নির্মিত হয়েছে। এখানে নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি ঘড়ি। এজন্যই এটি ক্লক টাওয়ার নামে পরিচিত। ঘড়িটি স্থাপনের কাজ শুরু হয় ২০০২ সালে এবং উদ্বোধন হয় ২০১২ সালে। ঘড়িটিতে সাদা ও সবুজ রংয়ের প্রায় ২১ হাজার বাতি ব্যবহার করা হয়েছে। দিনের বেলা ১২ কিলোমিটার এবং রাতের বেলা ১৭ কিলোমিটির দূর থেকে ঘড়ির সময় দেখা যায়। মুসলমানদের বিশেষ দিনগুলোতে ঘড়ির ওপর আকাশের দিকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১৬ রংয়ের আলো বিচ্ছুরণ ঘটানো হয়। প্রতি ৫ ওয়াক্ত নামাজের সময় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ফ্ল্যাশ লাইটের মাধ্যমে নামাজের ইঙ্গিত দেয়া হয়। ঘড়ির উপর বড় করে আল্লাহু শব্দটি লেখা রয়েছে।

একটু সময় নিয়েই বিদায়ী তাওয়াফ সারলাম। তাওয়াফ সেরে গেলাম হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জন্ম ভিটা দেখতে। সাফা পাহাড়ের ডান দিকে অল্প দূরেই তাঁর এই পৈত্রিক ভিটা। এখানেই ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে মহানবী (সা:) জন্মগ্রহণ করেন। হযরত খাদিজা (রা:) -এর সাথে বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই বাড়িতেই বসবাস করতেন। বর্তমানে এটি একটি লাইব্রেরী।
রাসুল (সা:) এর এই জন্মভিটা দেখেতে প্রতিদিন প্রচুর মানুষের ভীড় হয়। বাড়ীর দেয়ালে বিভিন্ন ভাষায় অনেক কিছু লেখা রয়েছে। বাংলা ভাষাও আছে। সবাই তাদের মনোবসনা পূরণের আর্তির কথা লিখেছেন বিভিন্ন ভাষায়। বাড়ীর আশেপাশে এবং সামনের আঙ্গীনায় অনেককেই নামাজ পড়তে দেখা গেলো। নবীর জন্ম ভিটা পরিদর্শণ শেষ করে হেরেম শরীফের বাইরে একটি পাকিস্তানী বিরিয়ানী হাউজে দুপুরের খাবার খেয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম হুদাইবিয়ার উদ্দেশ্যে।
মক্কার ৯ মাইল উত্তর-পশ্চিমে হুদাইবিয়া অবস্থিত। এই স্থানে নবী করিম (সা:) ও কুরাইশদের মধ্যে একটি সন্ধি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো ষষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে। এই চুক্তির মাধ্যমে কুরাইশগণ ইসলামী রাষ্ট্রকে একটি পক্ষ ও শক্তি বলে স্বীকৃতি প্রদান করে। এবং ১০ বছরের জন্য স্বাধীনভাবে ধর্ম প্রচারের সুযোগ প্রদান করে। ইসলামের ইতিহাসে এই সন্ধিচুক্তিকে স্পষ্ট বিজয় বলে কোরান মজিদে ঘোষণা করা হয়েছে।
হুদাইবিয়ায় একটি মসজিদও রয়েছে। মসজিদের পাশে একটি জায়গা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। যেখানে হযরত ওসমানের কথিত হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সাহাবীরা রাসুল (সা:)-এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ ও রাসুল (সা:) এর সন্তুষ্টি অর্জন এবং যুদ্ধ করার লক্ষ্যে এই বাইয়াত অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বলে এটাকে বাইয়াতে রেজওয়ান বা বাইয়াতে রাসুল-ও বলা হয়। এই ঐতিহাসিক স্থানটি অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন রাখা হয়েছে দেখে মনে কষ্টবোধ হচ্ছিলো।
হুদাইবিয়া থেকে ফেরার পথে আমরা গেলাম রসুল (সা:)-এর সর্বশেষ বিবি উম্মুল মোমেনীন হযরত মায়মুনার কবর জিয়াত করতে। তার প্রকৃত নাম ছিলো বাররা। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা:: তার নাম পরিবর্তন করে মায়মুনা রেখেছিলেন। নবীজির (রা:) ইন্তেকালের পর মায়মুনা আরো ৪০ বছর মদিনাতে বসবাস করেন। মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন। এখানেই তাকে কবর দেয়া হয়। তাঁর কবরস্থান ঘিরেই একটি ভবন তৈরী করা হয়েছে। এর ভিতরে ঢোকা নিষেধ। জানালা দিয়েই কবরটি দেখা যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করে বিদায় নিলাম।
এরপর ড্রাইভার আমাদের নিয়ে এলো মক্কার অদূরে কাকিয়া নামক স্থানে একটি খেজুরের পাইকারী মার্কেটে। বিশাল মার্কেটে নানা রকমের খেজুর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েক পদের খেজুর কিনলাম। প্রায় প্রতিটি দোকানেই বাংলাদেশীরা কাজ করছেন।

কাকিয়া মার্কেটের বিপরীত দিকে একটি বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে গেলাম। রেষ্টুরেন্টটির মালিক খুবই আপ্যায়ন করলেন। স্পেশাল সালাদ বানিয়ে আনতে বললেন। কয়েক প্রকার ভাজি-ভর্তা আর ডাল নিয়ে উদরপূর্তি করে খেলাম। খাবার পর এলো চা এবং সবশেষে পান। দাম দিতে গেলে তিনি নিতে চাইলেন না। বুঝলাম প্রবাসী মাত্রই স্বজন। তবুও জোর করে হাতে ১০০ রিয়ালের নোট দিলাম। তিনি মাত্র ১০ রিয়াল রেখে বাকী অর্থ ফেরৎ দিলেন।
এরপর গেলাম নাক্কাসা নামক একটি স্থানে। এটি হেরেম শরীফ সংলগ্ন ইব্রাহীম খলিল রোড ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ দূরে। এখানে পাইকারী দরে সবজি, মাছ, ফল সবই পাওয়া যায়। দোকানগুলোর মালিক প্রায় সকলেই বাংলাদেশী। বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টগুলোতে ছোলা, বুট, মুড়ি সবই পাওয়া যায়। আমি যাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলাম, তার বাড়ি সিলেটে। নাম মমিনুল ইসলাম। গতবার এসে তার সাথে পরিচয় হয়েছিলাম। এবারে আসার পর হৃদ্যতার সম্পর্কটা আরো বেড়েছে। তিনি হঠাৎ করেই বললেন- ভাই সৌদী আরব আপনি এতোবার এসেছেন, গাওয়া খেয়েছেন কি? আমি তার কথায় হতবাক খেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম- এটা কি ধরনের খাবার বুঝতে পারিনি। তাই খাওয়া হয়নি। তিনি হেসে বললেন এটা কোন খাবার নয়, পাণীয়। ছোট ছোট কাপে করে সৌদীরা খায়। এতক্ষণে মনে পড়লো আমি মসজিদে নববীর ভিতরেও দেখেছি যে, সৌদিআনদের একসে বসে গাওয়া পান করতে। মমিনুল বললেন- চলুন আপনাকে গাওয়া আস্বাদন করাই।

গাড়ী উঠেই মমিনুল গাওয়ার গুণাগুণ বর্ণনা শুরু করে দিলো। বললো- আরবীয় সংস্কৃতিতে একটি ঐতিহ্যবাহী পানীয় হচ্ছে গাওয়া বা আরবীয় কফি। সাধারণত এটা বাড়ীতে বিশেষ অনুষ্ঠানে অতিথিদের সামনে ছোট কাপে পরিবেশিত হয়। বেশ সময় নিয়ে গাওয়া ছোট ছোট চুমুকে খেতে হয়। এর কোন হ্যান্ডেল নেই। বিশেষ এই কাপকে ফিনজান বলা হয়। কোন অনুষ্ঠান হলে পরিবেশনকারী ঐহিত্যবাহী আরবীয় পোশাক পড়ে অতিথিদের তার ফ্ল্যাক্স থেকে গাওয়া ঢেলে দেন। অতিথিকে বেশী সম্মান জানাতে বাড়ীর কিশোর ছেলেকে দিয়েও গাওয়া পরিবেশন করা হয়। গাওয়া ঔষুধেরও কাজ করে। এটি পান করলে শরীর চাঙ্গা হয় এবং কর্মস্পৃহা বাড়ে। গলায় কাশি থাকলে তা সেড়ে যায়। গাওয়া সাধারণত খেজুর দিয়ে খাওয়া হয়।
গল্প করতে করতে আমরা অনেক দূর পেরিয়ে এলাম। গাড়ী পার্ক করে মোমিনুল আমাকে নিয়ে এলো একটি আরবীয় রেষ্টুরেন্টে। ছোটখাটো দোকান, তবে বসার ব্যবস্থা আছে। মমিনুল জানালো- এই দোকানে শুধুই গাওয়া বিক্রি হয়। অর্ডার দেয়ার পর চায়ের কাপের মতো বড় কাপে পরিবেশিত হলো গাওয়া। প্রতি কাপ ৩ সৌদি রিয়াল। খেতে খুব একটা খারাপ লাগেনি। দুধ বা চিনি না থাকলেও দারুচিনি, এলাচি এবং সুগন্ধি মশলা থাকায় পুরো কাপটাই শেষ করলাম। আমাকে দোকানে বসিয়ে রেখে মমিনুল দোকানের বাইরে গেলো। একটু পর একটি প্যাকেট হাতে নিয়ে আমার সামনে রেখে বললো- এটা আপনাকে নিউইয়র্ক নিয়ে যেতে হবে। উৎসুক্য নিয়ে জানতে চাইলাম এর ভিতরে কি? বললো- গাওয়া। সে আরো বললো- ইন্টারনেট ঘাটলে গাওয়া বানানোর পদ্ধতি জানা যাবে। আমি দাম দিতে চাইলে সে কোনভাবেই নিতে চাইলো না। অবশেষে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।
প্রায় সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে সারা শরীর অবসন্ন লাগছিলো। মমিনুলকে বললাল- এবার হোটেলে নামিয়ে দিতে। আগামীকাল খুব ভোরেই রওনা দিতে হবে নবীর (সা:) শহর মদিনায়।