আমার লোকাল গাইড এরশাদউল্লাহর সাথে কথা ছিলো সকাল ৮টায় হোটেল লবিতে অপেক্ষা করবো। তিনি ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সময়েই এলেন। গাড়ীর কাছে যেতেই তিনি বললেন- একটু অপেক্ষা করুন আমি হোটেলের পার্কিং লটে গাড়িটা রেখে আসি। আজ আপনাকে প্রথমে হারাম শরীফ সংলগ্ন মসজিদে গামামা দেখিয়ে আনবো।
মক্কা-মদিনার আনাচে-কানাচে মসজিদের ছড়াছড়ি। তবে এখানকার প্রতিটি মসজিদের সাথে জড়িয়ে আছে নানান ইতিহাস এবং রাসুল (সা:)-এর অসংখ্য স্মৃতি। তাই একটু উৎসুক্য নিয়েই তার সাথে হাঁটা শুরু করলাম। হোটেল থেকে ৭/৮ মিনিট হাঁটার পর মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায় হারাম শরীফের ৭ নং গেট সংলগ্ন মসজিদে গামামার সামনে গিয়ে পৌছলাম। মসজিদটি হারাম শরীফ সংলগ্ন হওয়ায় এখন আর নামাজ হয় না। মসজিদের সামনে গিয়েই এর ইতিহাস জানালের এরশাদউল্লাহ।
রাসুল (সা:) এই মসজিদের সামনের মাঠেই হিজরী দ্বিতীয় সালে প্রথম ঈদের নামাজ পড়েন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই মসজিদকে তিনি দুই ঈদের জন্য ঈদগাহ হিসেবে ব্যবহার করছেন। একবার বৃষ্টির অভাবে মানুষজন খুব কষ্ট পাচ্ছিলো, তখন রাসুল (সা:) এই মসজিদে বৃষ্টির জন্য ইশতিশকার নামাজ পড়েন। দোয়ার পড়েই আকাশে মেঘ জমে উঠলো, প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো। আরবীতে গামামা অর্থ মেঘ। নামাজের পরপরই আকাশে মেঘ জমে বৃষ্টিপাত হয়েছিলো বলেই এই মসজিদের নামকরণ করা হয় মসজিদে গামামা।

এই মসজিদটি আরো একটি কারণে বিখ্যাত। তাহলো আবিসিনিয়ার নওমসুলিম বাদশা নাজ্জাসীর মৃত্যুর পর হযরত মুহাম্মদ (সা:) এখানেই তার গায়েবানা নামাজ পড়ান। উল্লেখ্য, নাজ্জাসী চিঠির মাধ্যমে রাসুল (সা:) এর দ্বীনের দাওয়াত পেয়ে খৃীষ্টান ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম কবুল করেছিলেন। এমন কি মক্কার কাফেরদের হাতে নির্যাতিত কিছু মুসলমান নবীজীর নির্দেশে তাঁর কাছে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থণা করলে তিনি তাদের আশ্রয় দেন। কোরাইশদের একটি প্রতিনিধি দল তাদের ফিরিয়ে আনতে গেলে তিনি মুসলামানদের তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান।
গামামা মসজিদটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। গম্বুজ দ্বারা নির্মিত হয়েছে তার ছাদ। উত্তর দিকে ছোট ছোট ৫টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩২ দশমিক ৫ মিটার এবং প্রস্থ ২৩ দশমিক ৫ মিটার। ৭৪৮ হিজরী থেকে ৭৫২ খৃীষ্টাব্দ পর্যন্ত হোসাইন বিন কালাউন মসজিদটি সংস্কার করেন। সর্বশেষ সৌদি সরকার ২ মিলিয়ন রিয়াল ব্যয় করে মসজিদটি সংস্কার করেন। বর্তমানে সৌদি আওকাফ মন্ত্রনালয়ের তত্ত্বাবধানে মসজিদটি পরিচালিত হয়।
মসজিদে গামামার খুব কাছে আরো তিনটি ছোট ছোট মসজিদ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে মসজিদে আবু বকর, মসজিদে ওমর এবং মসজিদে আলী (রা:)। এই মসজিদগুলো হারাম শরীফের সন্নিকটে বিধায় মসজিদগুলোতে নামাজ আদায় হয় না। এই স্থানগুলোতে দাঁড়িয়ে হযরত আবু বকর, হযরত ওমর এবং হযরত আলী দাড়িয়ে হুজুরের পাহাড়ায় নিয়োজিত থাকতেন। পরবর্তীতে এই স্থানগুলোতে তাঁদের নামে মসজিদ তৈরী করা হয়।
আমাদের এখানে অপেক্ষা করতে বলে এরশাদউল্লাহ গাড়ী আনতে গেলেন। একটু পরেই তিনি ফিরে এলে তার সাথে আমরা রওনা হলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ‘উহুদ প্রান্তরে’। এই পাহাড়ের পাদদেশেই সংগঠিত হয়েছিলো ঐতিহাসিক উহুদ যুদ্ধ। এই যুদ্ধেই মুহাম্মদ (সা:)-এর দাঁত মোবারক শহীদ হয়। উহুদের যুদ্ধে যে ৭০জন সাহাবী শহীদ হন তাদের সবার কবর এখানে রয়েছেন। এখানে রসুল (সা:)-এর চাচা সাইয়াদুল শোহাদা হযরত আমীর হামজা (র:)-এর কবরও রয়েছে।
উহুদ পর্বত মদিনা শহরের উত্তরে অবস্থিত। এর উচ্চতা ৩,৫৩৩ ফুট। উহুদ পর্বতের দক্ষিণে রূমা পাহাড়। যুদ্ধের সময় এই পাহাড়েই রসুল (সা:) তীরন্দাজ বাহিনীর সমাাবেশ করেন। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সেখানেই অবস্থান করার নির্শেদ প্রদান করেন। কিন্তু যুদ্ধের প্রথম দিকে মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হলে তীরন্দাজ বাহিনী মালে গণিমত কুড়ানের জন্য মাঠে নেমে পড়েন। এই সুযোগে কাফেরদের সেনাপতি খালেদ বিন ওয়ালীদ পিছন থেকে আক্রমণ করে মুসলমানদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এই যুদ্ধে ৭০ জন মুসলান নিহত হন, অপরদিকে শত্রু পক্ষে নিহত হন ২৩ জন।
উহুদের মাঠে খোলা চত্তরেই বাম পাশে দেয়াল ঘেরা প্রশস্ত কবর স্থানে শুয়ে আছেন উহুদ যুদ্ধের শহীদরা। সবার আগে প্রথম কবরটি শহীদদের নেতা হযরত আমীর হামজা (রা:)-এর। তাঁর স্মৃতি অমর করে রাখতে এখানেই নির্মিত করা হয়েছে মসজিদে শোহাদা। আমরা শহীদদের কবর জিয়ারত করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।
নবীর শহর মদিনায় আমি বেশ কয়েকবার এসেছি। এই নগরী এবং তার আশেপাশে চলতে গিয়ে বারবার শিহরীত হই। যেসব জায়গায় আমরা জিয়ারত করতে যাই তার প্রতিটি স্থান রাসুল (সা:)-এর কদম মোবারকের স্পর্শে ধন্য। এসব জায়গায় পড়েছে সাহাবাদের পদধূলি। যে শহরটিতে শুয়ে আছেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) সেখানে সকাল-বিকাল আগমন ঘটতো ফেরেস্তাদের সরদার হযরত জিরাইল (আ:)-এর। সে সব জায়গায় জুতা পায়ে চলাফেলা করায় নিজকে বড় অসহায় মনে হয়।

এরশাদউল্লাহ এবার আমাদের নিয়ে এলেন একটি কুপের কাছে। ইংরেজীতে সাইনবোর্ড টাঙ্গানো আছে ‘গারস ওয়েল’ বা গারস কুপ। জায়গাটি মসজিদে কুবা থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তরে। গাড়ী থেকে নেমে কুয়াটির কাছে এলাম। লোহার নেট দিয়ে আটকানো কুয়াটির চারদিক। এরশাদ ভাই জানালেন এটি ছিলো একটি মিস্টি পানির কুয়া। রাসুল (সা:) নিয়মিত এখানে আসতেন। এই কুপের পানি দিয়ে গোসল ও ওজু করতেন। এই কূপের পানি পান করতেন। তিনি এক সময় হযরত আলী (রা:)-কে ডেকে বলেন- মৃত্যুর পর যেনো এই কুপের পানি দিয়ে তাঁর শেষ গোছল করানো হয়। হযরত আলী (রা:) তাঁর কথামতো এখানকার পানি দিয়ে রাসুল (সা:)-কে শেষ গোছল করিয়েছিলেন।
জুতা পায়ে এই কুপের চারিদিকে হাঁটতে গিয়ে নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হচ্ছিলো। এই কুপের চারিদিকে পড়েছে হযরত রাসুল (সা:) এবং তাঁর সাহাবীদের পদধুলী। তাই দ্রুত গাড়ীতে ফিরে এলাম। এই কুপটি বর্তমানে সৌদী আরবের একটি ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচিত। সৌদি কমিশন ফর ট্যুরিজম এবং ন্যাশনাল হেরিটেজ বর্তমানে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো তাই ফিরে এলাম হোটেলে। একটু বিশ্রাম নিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করার জন্য রওনা দিলাম মসজিদে নববীর উদ্দেশ্যে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম হারাম শরীফের আঙ্গীনায় স্থাপিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছাতাগুলো মসজিদে নববীর বাইরে যারা নামাজ আদায় করবেন, তাঁদের সূর্য্য তাপ থেকে রক্ষার জন্য ছাতা টানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। জার্মান স্থপতিদের দ্বারা এই ছাতাগুলো লাগানো হয়েছে। এর বৈশিষ্ট হচ্ছে এগুলো ভাজ করা যায়। ছাতাগুলো খুলে দিলে মসজিদের ১ লাখ ৪৩ হাজার বর্গমিটার জায়গা ডেকে যায়। ছাতায় বেশ কয়েক ধরনের ফিলটার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে করে প্রায় ৮ ডিগ্রি পরিমান তাপমাত্র কমে যায়। প্রতিটি ছাড়া উচ্চতায় ৩০ মিটার। ছাতাগুলো স্থাপন করা হয়েছে মসজিদুল হারামের সম্প্রসারিত ও বর্ধিত উত্তর-পশ্চিম আঙ্গীনায়।