এর নাম স্রাইন অব রিমেম্বারেস। একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর নির্মিত পিরামিড আকৃতির এই শহীদ মিনারটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে এই মিনারটি ১৯২৭ সালের ১৯ নভেম্ভর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং কাজ শেষ হয় ১৯৩৪ সালে। প্রতি বছর ১১নভেম্বর শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে এখানে এসে সবাই সমবেত হন।ঐ দিন একটা অন্য রকম অনুষ্ঠান হয় এখানে ।শহীদ মিনারটির ভেতরে একটি বেদীর উপর লিখা আছে “লাভ” শব্দটি।ছাদের একটি ছিদ্র দিয়ে এই লাভ শব্দটির উপর সূর্যালোক প্রক্ষেপণ করা হয়। এই আলোতে ঝলমল করে উঠে লাভ বা ভালোবাসা শব্দটি। দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের এই বিশেষ দিনটিতে এই ভাবেই স্মরণ করা হয়।
হাবিব রহমান: গাইড জানালো অস্ট্রেলিয়া একটা বিরাট দেশ। অসাধারণ সব আউটডোর নিয়ে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে জেগে থেকে তার আদিম রুপ ও সুন্দরের মিলিত ছন্দে। সারা বছর পর্যটকদের আনন্দ দিয়ে আসছে। এখানে দেখারও রয়েছে অনেককিছু। কেউ যদি ১৫ থেকে ২০ দিনের একটা ট্যুর প্রোগ্রাম নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ঘুরতে আসে তাহলেই মোটামুটিভাবে দেশটি ঘুরে দেখা সম্ভব।আমাদের হাতে এত সময় নেই।তাই পাখীর চোখে যতটা সম্ভব দেখে নেয়ার চেস্টা।
আজ আমরা দেখতে এসেছি কুইন ভিক্টোরিয়া মার্কেট।অনেকে হয়তো জানতে চাইবেন মার্কেট তো মার্কেটই তা আবার দেখার কি আছে!আছে-আর আছে বলেই গাইড আমাদের মার্কেটই দেখাতে নিয়ে এসেছে। এক কথায় বলতে গেলে পৃথিবীর সব মার্কেটই কমবেশী একই রকম শুধুমাত্র পণ্যের রকম ফের ছাড়া।কিন্তু কুইন ভিক্টোরিয়া মার্কেটের রয়েছে একটা আলাদা বিশেষত্ব।এটা দক্ষিণ গোলার্ধের অন্যতম বড়একটা ওপেন এয়ার মার্কেট।আর রাতের মার্কেট।মেলবোর্নের এই বাজারটি নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত”ভিক্টোরিয়া নাইট মার্কেট”নামে চলে।বুধবারে এর নামকরন হয়-সুজুকি নাইট মার্কেট।৬০০ এর বেশী দোকান সমৃদ্ধ এই ওপেন এয়ার মার্কেটে তাজা এবং সুস্বাদু ফল,সব্জি,খাবার দাবার ছাড়াও বার বিনোদন সহ নানা ব্যবস্হা রয়েছে।
দিন শেষে গোধূলির হাত ধরে যখন অন্ধকার নেমে আসে তখনই শুরু হয় এই বাজারের কেনাবেচা ।তবে এই নৈশ বাজার যে শুধু মেলবোর্নেই আছে তা নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আছে।মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আমি এ ধরনের বাজার দেখেছি।কুয়ালালামপুরের পেটালিং স্ট্রীট এবং লোরং টুংকু আবদুর রহমান নামক স্হানে এধরনের নৈশ বাজার রয়েছে।এরমধ্যে লোরং য়ে স্হানীয় মুসলমানদের ব্যবহার্য জামা কাপড় এবং পেটালিংয়ে সব ধরনের পণ্য বিক্রি হতে দেখেছি।
সিংগাপুরের নৈশ বাজারটির নাম টেক্কা মার্কেট ।ওখানেও যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।ওখানে প্রসাধনী,অলংকার, তাজা শাক শব্জী, মাছ মাংস ,ফুল ফল সবই বিক্রি হয়।এই বাজারটির আরেকটা বিশেষত্ব হলো তাজা জুঁই ফুল বিক্রয় হয় ওখানে ।সন্ধ্যার পর জুঁই ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠে এই মার্কেটের আশ পাশ।
আমার ঘুরে দেখা অন্য নৈশ মার্কেটের মাঝে আছে ফ্রান্সের অদ্রিক্স নাইট মার্কেট।এই বাজারটির অন্যতম আকর্ষন হলো আন্চলিক খাবার, মদ,ভেড়ার মাংস, তাজা আখরোট ইত্যাদি।তাই আমার দেখা বিশ্বের অন্যান্য নৈশ মার্কেটের সাথে তুলনা করে দেখার জন্যই কুইন ভিক্টোরিয়া মার্কেটে আমার আগমন।
গাইড জানায়,১৯ শতকে ভিক্টোরিয়ান শৈলিতে ৭ হেক্টর জায়গার উপর এই মার্কেট টি নির্মিত হয়। প্রচলিত আছে বাজারটি একটি। পুরাতন কবরস্থানের উপর নির্মিত। বাজারের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ আসে সৌর প্যানেল থেকে। ১২০ বছর যাবত এভাবেই বাজারটি বিদ্যুতায়িত হয়ে আসছে।
যারা শুধু বাজারটি দেখতে আসেন,তাদের জন্য রয়েছে ২ঘন্টার একটি ট্যুর প্যাকেজ। স্হানীয় গাইড বাজারটি ঘুরে ঘুরে দেখায়।বাজারে পন্য সামগ্রীর মূল্য খুবই কম।বাজারটি বন্ধ হবার ২ ঘন্টা আগে সব পণ্য সামগ্রীতে ছাড়দেয়া হয়।স্হানীয় বাসিন্দাদের তৈরি নানারকম হস্ত শিল্প সামগ্রী এখানে কিনতে পাওয়া যায়।
এবারে আমাদের দর্শনীয় তালিকায় মেলবোর্নের শহীদ মিনার। না,এটা বাংলাদেশীদের নির্মিত কোন শহীদ মিনার নয়। এর নাম স্রাইন অব রিমেম্বারেস। একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর নির্মিত পিরামিড আকৃতির এই শহীদ মিনারটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে এই মিনারটি ১৯২৭ সালের ১৯ নভেম্ভর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং কাজ শেষ হয় ১৯৩৪ সালে। প্রতি বছর ১১নভেম্বর শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে এখানে এসে সবাই সমবেত হন।ঐ দিন একটা অন্য রকম অনুষ্ঠান হয় এখানে ।শহীদ মিনারটির ভেতরে একটি বেদীর উপর লিখা আছে “লাভ” শব্দটি।ছাদের একটি ছিদ্র দিয়ে এই লাভ শব্দটির উপর সূর্যালোক প্রক্ষেপণ করা হয়। এই আলোতে ঝলমল করে উঠে লাভ বা ভালোবাসা শব্দটি। দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের এই বিশেষ দিনটিতে এই ভাবেই স্মরণ করা হয়।
স্মৃতি সৌধের পাশেই স্হাপন করা আছে একটি স্তম্ভ।যেখানে জ্বলছে শিখা অনির্বাণ।গাইড জানায় এখানে সারা বছর পর্যটকের সমাগম ঘটলেও মেলবোর্নবাসীরা এখানে আসেন শুধু এই একটি দিনেই।গাইড আরো জানায় এই শহীদ মিনারটি তৈরি করতে সরকারকে অনেক ঝক্কির মুখে পড়তে হয়।খৃস্টান পাদ্রীরা এর নির্মান বিরোধিতা করে।তাদের বিরোধিতার কারণ ছিলো স্নৃতি সৌধের ডিজাইনটির কোথাও ক্রুশ বা কোন ধর্মীয় চিহ্ন রাখা হয়নি। পরে অবশ্য আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা হয়।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন।৯৪ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই বাগানটিতে প্রতিবছর গড়ে ২ মিলিয়ন পর্যটক বেড়াতে আসেন।গাইড জানায় প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির গাছ গাছড়া আছে এই বাগানে।প্রায় তিনশো বছরের পুরনো একটি ইউক্যালিপটাস গাছ আছে এই এখানে নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে পৃথক হবার সময়ে এই গাছের নীচে দাঁড়িয়েই স্বতন্ত্র ভিক্টোরিয়া রাজ্যের ঘোষনা দেয়া হয়েছিলো।
পরবর্তী গন্তব্যে যাবার জন্য গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।তরুণ গাইডের বক্তৃতা শুনছিলাম বসে বসে।১৮৩৭ সালে তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ল্যাম্ব মেলবোর্নের নামানুসারে এই শহরটির নাম রাখা হয় মেলবোর্ন ।ছয় বাই
চার ব্লকের ছোট্ট শহরটির জনসংখ্যা ছিলো সেদিন মাত্র ১৭৭জন।১৯৫১ সালে হঠাৎ করেই সোনার খনি আবিস্কার হয় এখানে।তারপর এই ছোট্ট শহরটি ধনী শহরের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলে।সোনার টাকায় চেহারা পাল্টে যায় শহরের।শুরুতেই তারা শহরটির যে অবকাঠামো নির্মান করেন তার উপরেই গড়ে উঠে আজকের এই মেলবোর্ন শহর।
গাড়ী এসে থামলো মেলবোর্ন পার্লামেন্ট হাউজের সামনে। গাইডের অনুসরণ করে আমরা এসে থামলাম ছোট্ট বাগানঘেরা লাল টালির ছাদের একটা কুটিরের সামনে। গাইড জানালোএটা ক্যাপ্টেন জেমস কুকের স্মৃতি বিজরিত কুটির -কুকস কটেজ। ক্যাপ্টেন জেমস কুকের কথা ইতিহাসে অনেক পড়েছি। ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে জন্ম নেয়া কুক ছিলেন বৃটিশ রাজকীয় নৌ বাহিনীর একজন নাবিক। ১৭৭২ সাল থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত এক অভিযানে তিনি সমগ্র অস্ট্রেলিয়া আবিস্কার করে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।
গাইড জানালো এই কুটিরটাকে ইংল্যান্ড থেকে তুলে এনে এখানে বসিয়ে দেয়া হয়েঁছে । ১৯৩৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের শতবর্ষ পালিত হয়। মেলবোর্নের বিশিস্ট ব্যবসায়ী রাসেল গ্রিম এয়েড চাইছিলেন ভিক্টোরিয়ান সরকারকে কিছু একটা উপহার দিতে । ইংল্যান্ডে ক্যাপ্টেন কুকের বাড়ীটি নিলামে বিক্রি হচ্ছে জানতে পেরে তিনি তা কিনে নেন। মেলবোর্নের একদল স্থপতি কে সাথে নিয়ে ইট কাঠ টালি খুলে ২৫৩ টি বড়বাক্স আর ৪০ টি ব্যারেল ভর্তি করে মেলবোর্নে নিয়ে আসেন এই কুকস কটেজ।১৯৩৪ সালের ১৫ অক্টোবর রাসেল গ্রিম ওয়েড কটেজটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন মেলবোর্নের মেয়রের হাতে।
দিনের আলো ক্রমেই ফুরিয়ে আসছিলো।আর সারাদিন ঘুরে ঘুরে সবাই ছিলাম ক্লান্ত।আমাদের মুখের ভাষাটা যেন পড়তে পারছিলেন তরুন অথচ অভিজ্ঞ গাইড।তাই গাড়ী ঘুরিয়ে নিয়ে রওয়ানা হলো আমাদের হোটেলের দিকে।
—লেখক,সাংবাদিক, সিইও বাংলা ট্যুর।