হাবিব রহমানঃ নিউইয়র্ক থেকে স্পেনের বার্সিলোনায় উড়ে এসেছি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তরভুক্ত একটি ছোট্ট দেশ এ্যান্ডোরাঘুরে দেখবো বলে। দেশটি উত্তর থেকে দক্ষিনে ম্বায় মাত্র ২৫ কিলোমিটার ।আর পশ্চিম থেকে পূর্বে ৩০ কিলোমিটার। এটিফ্রান্স এবং স্পেনের সীমান্তে অবস্হিত।পুরো দেশটির সব স্ হাপনাতে মিশে আছে ফরাসী এবং স্পেনীয় স্হাপত্যের নিদর্শন।এটিএকচি ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের দেশ।যেখানে জনসংখ্যা কঠোর নিয়মের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে।এন্ডোরা খুব শান্ত একটি দেশ।অপরাধ নেই । হৈহল্লা নেই । বিক্ষোভ মিছিল নেই। দেশটি স্কি রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত।সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ,মৃদু জলবায়ু সারা বছরবিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষন করে।
পিরোনিজ পর্বতমালার উপত্যকায় গড়ে ওঠা এ্যান্ডোরাতে কোনো এয়ারপোর্ট নেই। ফ্রান্স বা স্পেনে নেমে সড়ক পথে দেশটিতেআসতে হয় ।তবে স্পেনের গিরোনা-কস্টা ব্রাভা এয়ারপোর্টই দেশটি থেকে কাছে।আমি নেমেছি স্পেনের বার্সিলোনা এয়ারপোর্টে।এখানকার একটি ট্যুর কোম্পানীর সাথে চুক্তি করে এসেছি তারা সড়ক পথে আমাকে এন্ডোরা ঘুরিয়ে আনবে।
বার্সিলোনায় ট্যুর কোম্পানীর অফিসের সামনে থেকে সকাল ৭টায় বাস ছাড়ার কথা।এখন শীতের সময়।সকাল ৭টা মানে খুবভোর সকাল।আমি সব জায়গায় সময়ের আগেই পৌছে যাই।এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।ট্যুর কোম্পানীর অফিসের সামনেযখন পৌঁছলাম তখনো অন্ধকার কাটেনি।অফিসের দরজাও খুলেনি।অফিসটা বড়রাস্তা থেকে একটু ভিতরে একটা গলিরভেতরে। কেমন যেন একটা নীরব এলাকা।রাস্তা দিয়ে তখনো তেমন লোক চলাচল শুরু হয়নি ।আমাকে একা দাড়িয়ে থাকতেদেখে হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামলো।দুজন নারী পুলিশ বেরিয়ে এসে জানতে চাইলো এই সাত সকালে কি করছিআমি এখানে।সামনে ট্যুর কোন্পানীর অফিসটা দেখিয়ে বল্লাম ওখান থেকে আমি এন্ডোরা ভ্রমনে যাবো। পুলিশ জানালোজায়গাটা তেমন ভালো নয়।ড্রাগ এডিক্টরা এখানে ঘোরাফের করে।সুযোগ পেলে তারা লোকজনের জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। তারাপরামর্শ দিলো মোড়ের কোনায় একটা ক্যাফে আছে সেখানে গিয়ে বসতে।বাস ছাড়ার সময় এখানে চলে আসতে বলে তারা চলেগেলো।
পুলিশের পরামর্শমত ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম।সময় কাটানোর জন্য গরম রফি এবং হালকা নাস্তার অর্ডার দিলাম।খেয়ে দেয়েসময়ের একটু আগেই পৌছে গেলাম ট্যুরিস্ট অফিসে।ততক্ষণে কর্ম চন্চল হয়ে উঠেছে অফিসটা।অনেক পর্যটক এসে ভীড় করেছেঅফিসে। বিভিন্ন জায়গায় তাদের ডেস্টিনেশন।
কাউন্টারে আমার টিকিটটি দেখালে কর্তব্যরত একজন তরুনি খুব হাসিমুখেই দুঃসংবাদটি দিলেন।জানালেন এন্ডোরা যাবারপথে পাহাড়ি রাস্তায় ধ্বস নামার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্হা অচল হয়ে আছে কাল থেকে।আজও কোন বাস ছেড়ে যাবেনা এ্যানডোরার উদ্দেশ্যে।তবে সাথে আর একটা সু সংবাদ দিলো যে চাইলে এই একই টিকিটে আমি স্পেনের একটি বিখ্যাতপাহাড়ি গ্রাম রুপিট ভ্রমনে যেতে পারি।পাহাড়ের চুড়ায় অবস্হিত মধ্যযুগের এই গ্রামটি দেখতে সারা বিশ্বের পর্যটকরা এসে ভীড়করেন।
যদিও আমি এ্যান্ডোরা ভ্রমনের উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলাম।তবে রুপিট সম্পর্কে আমার জানা ছিলো।এটি একটি সেরা পর্যটন গ্রাম।জাতিসংঘ পরিচালিত ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেসান যে সেরা গ্রামের তালিকা তৈরি করেছে রুপিট তার একটি।বিশ্বজুড়েএ রকম ৩২ টি গ্রামের তালিকা করেছে সংস্হাটি।প্রতিটি দেশকে বিবেচনার জন্য তিনটি গ্রামের নাম জমা দিতে বলা হয়েছিলো।কিন্তু স্পেনের নাম দেয়া তিনটি গ্রামের মধ্যে তিনটিই তালিকায় চলে এসেছে।এর একটি হলো রুপিট।
মুখে অপ্রসন্ন ভাব দেখালেও রুপিট ভ্রমনে আমার আগ্রহের কমতি ছিলোনা।তাই দ্রুত গিয়ে বাসে চেপে বসলাম।পরে দেখেছি এসূযোগ মিস করলে বিরাট একটা ভুল হতো।একটা চমতকার অভিজ্ঞতা থেকে বন্চিত হতাম।
শহরের ভিড় ছেড়ে গাড়ি মোটরওয়েতে পড়লো,।পেরিয়ে যাচ্ছিলাম একের পর এক গ্রাম, প্রান্তর, ফসলের মাঠ। ইউরোপের সবদেশের কান্ট্রিসাইড ই ছবির মত সুন্দর।দিগন্তবিস্তৃত মাঠ বা ফসলের ক্ষেত, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দুটো ঘরবাড়ি, মাঝে মধ্যেব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরঝিরে নদী, চরে বেড়ানো ভেড়ার দল, কখনো দেখতে পাওয়া যায় বহুদূরের কোনো গির্জারচুড়া…..। শহরের কেন্দ্র থেকে একটু বাইরে গেলেই সবুজ আর সবুজ এবং দূরে দূরে সাজানো লোকালয়। বেশ প্রশস্ত আয়তনেলোকজন বসতি নির্মাণ করে। সবুজ বৃক্ষরাশি আর লতা গুল্ম সবকিছু যেন মিলেমিশে একাকার এখানে।
গাড়ি ক্রমেই একে বেকে চলছে পাহাড়ি রাস্তায় ।আস্তেআস্তেঘুর্ ঘুরে উপরে উঠছে।রাস্তাটি অনেকটা জলপাইগুড়ি থেকেদার্জিলিং যাবার রাস্তার মতো।কখনো চুলের কাঁটার মত বাঁক।দুটো গাড়ি কোন ক্রমে পাশ কাটাতে পারে।নীচে গভীর খাত।একটুএদিক ওদিক হলেই পপাত ধরনী তল।
গাইড জানালো রুপিট নামের ছোট্ট এই পাহাডি গ্রামটি মধ্যযুগে গড়ে উঠেছে।এটি সমতল খেকে ৮২২ মিটার উচুতে অবস্হিত।রুপিট একটি ল্যাটিন শব্দ।যার অর্থ রক বা পাথর।গ্রামের একমাত্র চার্চটি পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে ১০ম শতকে।বাড়ি ঘরগুলোপাথর দিয়ে নির্মিত।রাস্তা গুলোও পাথরদিয়ে তৈরি।স্পেন সরকার গ্রামের সেই পুরনো ঐতিহ্যটা ধরে রেখেছে। অধিবাসী অল্পসংখ্যক হলেও তাদের জন্য সব নাগরিক সুয়োগ সুবিধা যেমন হাসাপাতাল,বিদ্যুৎ ব্যবস্হা,আধুনিক রাস্তা ঘাট সব তৈরি করেদিয়েছে।
একসময় আমাদের বাস এসে থামলো গ্রামের প্রবেশ মুখে।গ্রামের বাইরে থাকবে বাস।শুরুতেই একটা হ্যাঙ্গিং ব্রীজ ।নীচে কলকল রবে হয়ে চলেছে স্ফটিক স্বচ্ছ রুপিট নদী।এটা পেরিয়ে ঢুকতে হবে গ্রামে।এই নিরাপত্তা ব্যবস্হা সেই প্রাচীন কাল খেকে যাএখনো অটুট আছে।তবে ব্রীজটি নতুন করে নির্মিত হয়েছে ১৯৪৫ সালে।রাতের বেলা ব্রীজটি উঠিয়ে দিলে অবাঞ্ছিত কেউ ঢুকতেপারবেনা গ্রামে।
প্রকৃতি কন্যা রুপিট যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো এক অন্য রকম মুগ্ধতা নিয়ে।শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ।গ্রামটিকেদেখে মনে হচ্ছিলো প্রকৃতি যেন তার সকলসৌন্দর্য উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে ।রুপিটকে ভালো লেগে গেলো প্রথম দেখায়।
নিচের দিকে তাকালে ভালো করে কিছু চোখে পড়ে না। ধাপে ধাপে উঠে এসেছে পাহাড়। মেঘ আর কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে কোথাওকোথাও সবুজ প্রকৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ।
একটু হেটে আমরা আসলাম একটা পাহাড়ি ঝর্না দেখতে।প্রকৃতির কোলে ঝর্নাটি যেন একটা অন্য রুপ নিয়ে চোখে ধরা দিলো।পাহাড়ের বুক চিরে আছড়ে পড়ছে প্রবহমান জলধারা। গুঁড়ি গুঁড়ি জলকনা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি হচ্ছে কুয়াশারআভা। স্রোতধারার শীতল কলতানে নিক্কন ধ্বনির উচ্ছ্বাস ছড়িয়েছে চারপাশ। যেন সবুজ অরণ্যের প্রাণের ছোয়ার পরশ এঁকেছেকেউ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব নৈসর্গিক একটা আবহ সৃস্টি করেছে চারপাশে।গাইড একটু সময় দিলে ঝর্নার জলে পা ভিজিয়েবসে রইলাম কিছুক্ষণ।
গোটা গ্রামটাই পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু ভরা মৌসুম নয় বলে তত ভিড় জমেনি। ঝর্নার জলে পা ভিজিয়ে বসে থেকেবেশ ভালোই লাগছিলো।কিছু জলচর পাখির ডানা ঝাপটানো আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই।সবাই যেনকেমন একটা মৌনতায় মগ্ন।
রুপিট থেকে অনেকগুলি হাইকিং স্পট চলে গেছে জঙ্গলের ভিতরে।গাইডের নেতৃত্বে ঘন্টাখানিক হাইকিং করে সবাই ফিরেএলাম একটি রেস্টুরেন্টে ।প্রত্যেকেই নিজ নিজ পছন্দমত খাবার অর্ডার দিলো।আমি আগেই গাইডকে বলে রেখেছিলাম যে মাংসজাতীয় কিছু খাবোনা।সেজন্য গাইড আমার জন্য অর্ডার করলো টরটিলা দে পটাটা নামের একটি খাবার।এটাকে বলা যায়আলুর অমলেট।সাথে সালাদের মত পেঁয়াজের কুচি এবং অ্যাসপারাগাস আর এক বাটি নুডল স্যুপ।পরে এক কাপ গরম কফিখেয়ে সমাপ্তি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছিলো ধীর লয়ে।
আমরা বাসে গিয়ে বসলাম।বাস ছুটে চল্লো পাহাড়ি পথ ধরে বার্সিলোনার পথে।