আজকের প্রোগ্রাম ছিলো সিডনি সিটি ট্যুর। যে দেশেই যাই চেস্টা করি যে সিটি টাকে কেন্দ্র করে ট্যুর প্রোগ্রামটা আবর্তিত হয় সে সিটিটাকে নিজের মত করে ঘুরে দেখতে ।আর তা সহজ হয় কোন সিটি ট্যুর বুক করলে।।আর এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।৮ঘন্টার এই ট্যুরটি বুক করেই এসেছিলাম নিউইয়র্ক থেকে।অবশ্য এজন্য গাঁট থেকে খসাতে হয়েছে কড়কড়ে ১১৯টি ইউ এস ডলার।এই প্যাকেজের সাথে আছে দুই কোর্সের লান্চ,হোটেল থেকে পিক আপ আর সাথে থাকবে লোকাল প্রফেশনাল গাইড।তিনি এই সময় সীমার মধ্যে শহরের বেস্ট লুক আউটগুলি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবেন।
হোটেলে নাস্তা সেরে অপেক্ষা করছিলাম লবিতে।কাঁটায় কাঁটায় ৮ টায় গাইড এসে তুলে নিলো গাড়ীতে।ট্যুর কোম্পানি একটাই।তবে আজকের গাইড একজন স্বর্ণকেশী মহিলা।চলেন বলনে চৌকশ।গাইডরা সাধারনত যে রকম হয়।গাড়ীতে উঠতেই জানালেন আজকের দর্শনীয় তালিকার প্রথমেই আছে চিড়িয়াখানা দেখা।জীবনে চিড়িয়াখানাতো কম দেখিনি।সেই ঢাকা জু থেকে শুরু।আমার বসবাস নিউইয়র্কের বিখ্যাত ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানার পাশে।আর দেশে দেশে ঘুরে অনেক চিড়িয়াখানা দেখেছি।অস্ট্রেলিয়ায় এসে চিড়িয়াখানার দেখার আগ্রহ আমার তালিকায় ছিলোনা।তবে সিটি ট্যুরের তালিকায় চিড়িয়াখানা যে থাকবে তাতো আর আমার জানা ছিলোনা।কথায় বলেনা-পরেছি মোঘলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।তাই অগ্যতা গাইডের ট্যুর সূচিই মেনে নিতে হলো।তবে মনের কোনে সুপ্ত একটা বাসনা ছিলো ক্যাঙ্গারু আর কোয়ালা দেখা।অস্ট্রেলিয়ায় পথ চলতে দু একটা ক্যাঙ্গারু লাফাতে লাফাতে রাস্তা পার হতে দেখেছি।দেখা হয়েছে দু একটা কোয়ালার সাথেও।তবে চিড়িয়াখানার পরিবেশে আরো ভালোভাবে তাদের দেখার সূযোগ হবে এই শান্তনাটা মনে পুষে নিলাম।
গাড়ীতে বসতেই গাইড তার চাকুরি বাঁচানো লেকচার শুরু করলো।চাকুরি বাঁচানো বলছি এজন্য যে,এটা করেই সে তার জীবিকা নির্বাহ করে।তার কোম্পানি এজন্য তাকে অর্থ প্রদান করে।লেকচার দিয়ে মন ভরাতে হবে তার ক্লায়েন্টদের।ক্লায়েন্টদের মন না ভরলে তার কোম্পানীর মালিকের পকেট ভরবেনা।মালিকের পকেট না ভরলে তার পকেটও শুন্য থাকবে।ভাবছিলাম সিটে বসে ঝিমুবো আর এক কান দিয়ে তার কথা শুনবো।কিন্তু তার উপায় নেই।বাসের ইনটেরিয়র লাউড স্পীকারে গাইডের কথাগুলো কানের পর্দায় এসে ধাক্কা দিচ্ছিল।তবে খারাপ লাগছিলোনা তার কথা গুলো।একে তো সুন্দরী মেয়ে ।তারউপর মানুষকে আকৃস্ট করার ক্ষমতা রাখেসে।সিডনির গুনপনার বর্ননা করছিলো সে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিকে বলা হয় ‘সিটি অব কালারস’। সত্যিকার অর্থেই সিডনি রঙের শহর। সারা বছর জুড়েই কোন না কোন উৎসব লেগে থাকে আর তার সাথে তাল মিলিয়ে বদলে যায় শহরের রং। এছাড়াও প্রকৃতির পরিক্রমায় ঋতু বদলের সাথে সাথেও বদল হয় শহরের রংও।বড়বড় উৎসবগুলোর মধ্যে প্রতিবছর ২৬শে জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়া ডে, ফেব্রুয়ারি মাসে চাইনিজ নিউ ইয়ার, মে জুন মাস জুড়ে চলে ভিভিড ফেস্টিভ্যাল, সেপ্টেম্বরে বন্ডাই সমুদ্র সৈকতে ‘ফেস্টিভ্যাল অব উন্ডস’ আর অক্টোবর মাসে আছে হ্যালোইন আর প্রায় পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়েই চলে ক্রিসমাস। তবে সিডনির সবচেয়ে বড় ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে ‘নিউ ইয়ার’ কে বরণ করে নেয়ার চোখ ধাঁধানো আতশবাজি। এছাড়াও বাঙালিদের রয়েছে সারা বছর জুড়েই বিভিন্ন ধরণের মেলা ও উৎসব। এভাবেই সারা বছর জুড়েই সিডনির মানুষ ব্যস্ত রাখে নিজেদের। অস্ট্রেলিয়া ডে এবং চাইনিজ নিউ ইয়ারের পর মে জুনের সবচেয়ে বড় ফেস্টিভ্যাল ছিলো ভিভিড। ঋতু পরিক্রমায় জুন মাস থেকে অস্ট্রেলিয়াতে শীতকাল শুরু হয় তাই তখন শহরটা নিস্তেজ হয়ে পরে। ব্যবসা বাণিজ্যেও কিছুটা মন্দা ভাব পরিলক্ষিত হয়। সেই মন্দা ভাব কাটাতেই মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাসব্যাপী আয়োজন করা হয় এই ফেস্টিভ্যালের। সারা সিডনি বৈদ্যুতিক বিভিন্ন বর্ণের আলোয় সেজে উঠে। সিডনির অপেরা হাউসের দেয়ালে এবং ছাদে খেলা করে বিভিন্ন বর্ণের আলো। তার পাশেই রাতের রয়াল বোটানি গার্ডেন যেন জীবন্ত হয়ে উঠে বিভিন্ন প্রকারের আলোর ঝলকানিতে। তরঙ্গা জু’তে আলো দিয়ে বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি বানানো হয়। ডার্লিং হারবারে বর্ণিল পোশাক পরে হেটে যায় ছয় মিটার উঁচু মেরি ডাইন।
ভিভিড শো দেখতে দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করে সিডনি শহরে। রাতের পুরো সিডনি শহর যেন প্রাণ ফিরে পায়। পায়ে পায়ে মানুষ একটা প্রদর্শনী থেকে অন্য একটা প্রদর্শনীতে ঘুরে বেড়ায়।আলোর এই ঝলকানি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে বাচ্চারা। কিছু সময়ের জন্য হলেও বাচ্চারা যেন রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যায়। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে দশটা অবধি চলে এই প্রদর্শনী। সিডনি হারবারের ছোট বড় জাহাজগুলোও সাজে বিভিন্ন রঙে। অনেকেই জাহাজে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। ট্রেনে বাসে অনেক মানুষ আসা যাওয়া করে। খাবার দোকানগুলোতে থাকে লম্বা লাইন।
কখন যে গাইডের বক্তৃতার সাথে একাত্ম হয়ে গেছি নিজেই টের পাইনি।ধ্যান ভাংলো গাইডের কথায়।এবার নামতে হবে।এসে পড়ছি তরঙ্গা জু’র গেটে।
জু’তে ঢোকার আগে গাইড আমাদের নিয়ে গেলো একটা গাছের কাছে।নাম বল্লো জাকারান্ডা গাছ।শীতের সময় সমস্ত পাতা ঝরিয়ে জ্যাকারান্ডা গাছগুলো থুথুড়ে বুড়োর মতো ঝিম মেরে বসে থাকে। বসন্তকাল আসলে শুরুতেই সেই শুকনো শাখাগুলোতে দেখা দেয় গাঢ় বেগুনী রঙের ফুল। এরপর একসময় ফুলগুলো ঝরে যেয়ে সমস্ত গাছটা আবার সবুজ পত্রপল্লবে ভরে উঠে।বলা হয়ে থাকে বেদনার রং নীল ।আর তাই জ্যাকারান্ডার গাঢ় বেগুনি রংটাকেও আমরা বেদনার রঙ বলতে পারি।গাইডের বর্ননাগুলো শুনে মনে হচ্ছিলো যেন একজন সাহিত্যের অধ্যাপক বক্তৃতা দিচ্ছেন।
আমাদের জু’র গেটে একটু অপেক্ষা করতে বলে গাইড টিকিট কাটতে গেলো।একটু পরেই ফিরে এসে আমাদের নিয়ে ঢুকলো চিড়িয়াখানার ভেতরে।
গাইডকে বল্লাম প্রথমেই ক্যাঙ্গারু দেখাতে।কারণ অস্ট্রেলিয়া কাঙ্গারুর দেশ হিসাবেই বিশ্বে পরিচিত।ক্যাঙ্গারুর ছবি জাতীয় প্রতীক হিসাবে চিত্রায়িত আছে এদেশের কারেন্সি (ডলার)-এর নোটে এবং বেসামরিক বিমান (কোয়ান্টাস)-এ। যেতে যেতে কাঙ্গারুর নাম করণের কাহিনী জানালো গাইড।তাহলো সর্বপ্রথম ১৭৭০ সালে একজন ব্রিটিশ নাবিক, ক্যাপটেন জেমস্ কুক, তাঁর জাহাজ নোঙ্গর করেন অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান সিডনি শহরের পাশে অবস্থিত বোটানি-বে নামক স্থানে। এখানে অবস্থানকালে ক্যাপ্টেন কুক একদিন জাহাজ থেকে নেমে আশে পাশে ঘোরাফেরা করছিলেন। হঠাৎ একটা মাঠে তিনি কিছু অদ্ভূত প্রাণী দেখতে পেলেন। ঐ রকম প্রাণী তিনি আগে কখনও দেখেননি। তাই এগিয়ে গিয়ে নিকটস্থ একজন আদিবাসিকে অঙ্গুলি নির্দেশে দেখিয়ে দিয়ে ইংরেজি ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন – তোমরা ঐ প্রাণীটিকে কি নামে ডাক? আদিবাসি উত্তর করলেন, ক্যাঙ্গারু – আদিবাসিদের ভাষায় যার অর্থ হ’ল ‘আমি তোমাকে বুঝতে পারলাম না’। আর কুক ধরে নিলেন প্রাণীটির নামই হচ্ছে ক্যাঙ্গারু। এরপর ইংরেজদের মাধ্যমে ঐ নামটিই প্রতিষ্ঠিত হয় সারা দুনিয়ায় আর অস্ট্রেলিয়া পরিচিত হয় ক্যাঙ্গারুর দেশ হিসাবে।
আমরা ক্যাঙ্গারু এলাকা দেখা শেষ করে গেলাম কোয়ালা দেখতে।এটিও একটি শান্তশিষ্ট সুন্দর প্রাণী ।যার আছে মায়াবি দুটি চোখ, মুখমন্ডলের অধিকাংশ জায়গাজুড়ে গাঢ় কালো নাক আর ধুসর রং এর নরম তুল তুলে লোম দ্বারা আবৃত শরীর। তবে চোখ দুটি সহজে দেখা যায় না কারন এরা অত্যন্ত ঘুমকাতুরে স্বভাবের এবং প্রতিদিন ১৮ ঘন্টারও বেশী সময় ঘুমিয়ে কাটায়। আরেকটি সুন্দর প্রাণী হচ্ছে পসাম, যাকে ভাসন্ত কাঠবিড়ালিও বলা হয়। কারন এরা দেখতে ঠিক কাঠবিড়ালির মত (আকারে আমাদের দেশের কাঠবিড়ালির তুলনায় ২/৩ গুণ বড়) এবং বাতাসে কিছুক্ষণ ভাসতে পারে। সাধারনতঃ ভাসতে ভাসতে এক গাছ থেকে আরেক গাছে পার হয়ে যায়। এদের শরীরের দুইদিকেই সামনের পায়ের আঙ্গুল থেকে পিছনের পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত বিস্তৃত পাতলা চামড়ার পর্দা আছে যা বাতাসে ভাসতে সহায়তা করে।
গাইড আরো একটা প্রাণী দেখালো যার নাম প্লাটিপুস ।দেখতে অনেকটা পাতিহাঁসের মত, কিন্তু গায়ে পালকের পরিবর্তে লোম আছে।আরো একটি প্রাণী দেখালো যার নাম একিড্না। এর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর গায়ে মোটা লোম এবং সজারুর মত কাঁটা আছে। শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে অথবা কোন কারনবশতঃ ভয় পেলে আত্মরক্ষার্থে এরা কুন্ডলি পাকিয়ে পড়ে থাকে। তখন চতুর্দিকে গায়ের কাঁটাগুলি খাড়া হয়ে যায় এবং শত্রুরা কোন ক্ষতি করতে চাইলে তাকে সে কাঁটা দিয়ে আঘাত করে।
ঘুরে ঘুরে জু’র ভেতরটা দেখছিলাম।একটা মিটিং প্লেস ঠিক করে গাইড আমাদের ছেড়ে দিয়েছে।একটা চটাইম ঠিক করে দিঁয়েছে ফিরে আসার জন্য।স্বাধীনভাবে কিছুটা সমঁয ঘুরতে পারার সুযোগ পেয়ে ভালোই লাগছিলো।মনে হচ্ছিলো যেন একক্ষণ মাস্টার মশাইয়ের তত্বাবধান ছিলাম।হাঁটতে গিয়ে অসাবধানত হঠাৎ একজনের গায়ে মৃদু ধাক্কা লাগলো।আমি সরি বলার আগেই তরুন বয়সের ছেলেটি এমনভাবে কুন্ঠিত হয়ে আমাকে সরি বল্লো যে মনে হলো ধাক্কাটা সেই দিলো। বল্লো,সে এখানকার স্হানীয়।আমি পর্যটক শুনে সে জানতে চাইলো কোন সাহায্য লাগবে কিনা।আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম।
ততক্ষণে গাড়ী ছাড়ার সময়হয়ে গেছে।গিয়ে দেখলাম অন্যরা সব আমার জন্য অপেক্ষা করছে।আমি বসতেই গাড়ী ছেড়ে দিলো হোটেলের উদ্দেশ্যে।বসে বসে ভাবছিলাম যে দেশটিতে দুইশত বছর আগে বৃটিশরা অপরাধীদের ফেলে আসতো আজ তাদের উত্তরসূরীরা মানুষদের সাথে কত ভদ্র আচরণ করে।পথে ঘাটে অপরিচিত মানুষকেও হাসি দিয়ে হাই,হ্যালো বলে।যদি ট্রাফিক আইন না মেনেও ভুল করে রাস্তা পার হতে চান তাহলে আপনার পেছনের গাড়ীর ড্রাইভার একটুও বিরক্ত না হয়ে গাড়ী থামিয়েআপনাকে এগিয়ে যেতে হাত ইশারা করবে।ভাবছিলাম এই দেশটি থেকেও আমাদের অনেক শেখার আছে।
ADVERTISEMENT