ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ার অঙ্গরাজ্য ছয়টি।যেমন ,তাসমানিয়া,ভিক্টোরিয়া,নিউসা উথওয়েলস,কুইন্সল্যান্ড, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া ।এবারকার ভ্রমনে ইতোমধ্যে আমি ভিক্টোরিয়া এবং কুইন্সলান্ড ঘুরে এসেছি।বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দেখে আজ বিকেলে এসে পৌচেছি সিডনি।হ্যামিল্টন আইল্যান্ড এয়ারপোর্ট থেকে সিডনি পৌছাতে সরাসরি ফ্লাইটে সময় লেগেছে মাত্র আড়াই ঘন্টা ।আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম এয়ারপোর্ট থেকেই ট্রেনে সিডনি বিজন্যাস ডিস্ট্রিক্ট এলাকায় আমার হোটেল সিডনহিলটনের খুব কাছেই নামা যায়।আসলেই তা হলো ।ট্রেন থেকে নামতেই চোখে পড়লো সিডনি হিলটনের সাইন।ট্যাক্সি নিতে হলোনা।সুটকেস ঠেলে নিজেই পৌছে গেলাম হোটেলে।
হিলটন আমার প্রিয় হোটেলের একটি।শুধু সেবার মানের জন্য নয়।অন্য কারণেও এই হোটেলটির প্রতি আমার দুর্বলতা রয়েছে। আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশী হলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।বসবাস করি নিউইয়র্কে।এই হোটেলের প্রধান কার্যালয় আমার পাশের স্টেট ভার্জিনিয়ার ম্যাকলিনে।যেজন্য বিদেশে কোথাও গেলে এই হোটেলটিকে আমার আপনজনের মত মনে হয়।
হিলটন হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টস, সংক্ষেপ ‘ব্র্যান্ড’ নাম হিলটন আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন। ১৯১৯ সালে কোনার্ড হিলটন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বব্যাপী চার হাজার ৮৭৫টি শাখা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এসব হোটেলের রুমসংখ্যা সাত লাখ ৯৬ হাজার ৪৪০টি।
হোটেলে লাগেজ রেখে বের হলাম লান্চ করার জন্য।যদিও সকালে আমি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ হোটেল থেকে পেট পুরে নাস্তা করেই বিমানে উঠেছিলাম।তারপর বিমানেও আতিথেয়তার কমতি ছিলোনা।তারপরও খেতে বের হবার অন্য কারণ ছিলো।তাহলো আমি বিশ্বের যেখানেই যাই সেখানে রিভলভিং রেস্টুরেন্ট পেলে তার খাবার টেস্ট করতে ভুলিনা।সিডনিতে আমার হোটেল বুক করার সময়ই জেনেছিলাম এর পাশেই আছে ‘সিডনি টাওয়ার আই’।এটি বিশ্বের সাতটি উঁচু টাওয়ারের একটি।এটি সিডনি সিটির শুধু অন্যতম সৌন্দর্য ই নয় এর অবজারভেশন টাওয়ার থেকে পুরো সিডনি শহরটি দেখা যায়।৩৬০ ফুট উচ্চতার এই টাওয়ারটিতে রয়েছে একচি ঘুর্নায়মান রেস্টুরেন্ট।এখান থেকে সূর্যাস্তও দেখা যায়।
হোটেলে ঢোকার সময়েই বাইরে থেকে টাওয়ারের চূড়া চোখে পড়েছিলো।নীচে সুন্দরী রিসেপসানিস্টকে টাওয়ারে যেতে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে বল্লে জানালো হোটেল থেকে বের হয়ে ডান দিকে মোড় নিলেই সিডনি টাওয়ার ।একেবারেই হাঁটা দূরত্ব-ট্যাক্সির প্রয়োজন নেই।তার কথামতই সামান্য হেঁটেই দেখা মিল্লো টাওয়ারের ।
টাওয়ার ভবনে একটি বিরাট মল।মলে ঢুকতে কোন ফি দিতে হয়না।তবে টাওয়ারে উঠতে বড়দের ২৬ আর টিনেজ হলে ১৪ অস্ট্রেলিয়ান ডলার দিয়ে টিকিট কাটতে হয়।
৩৬০ ফুট উচ্চতার টাওয়ারে উঠতে সময় লাগলো মাত্র ৫ মিনিট।খাওয়ার আগে গেলাম অবজারভেশন টাওয়ারে।কাঁচের জানালা দিয়ে খালি চোখে দেখলাম সিডনি হারবার,অপেরা হাউজ,বোটানি বে,ও প্রশান্ত মহাসাগর।অছাড়া একটু পর পর লাগানো আছে বাইনাকুলার।এতে চোখ রেখে দেখা গেল অদূরের ফুটবল ক্রিকেট স্টেডিয়াম,মাদাম তুসোর যাদুঘর, সিডনি যাদুঘর সহ আরো অনেক স্হাপনা।
এরপর খেতে গেলাম ঘুর্নায়মান টাওয়ার রেস্টুরেন্টে।এটা লেভেল ফোরে।নাম -৩৬০ বার এন্ড ডাইনিং।বুফে খাবারের দাম ৯৫ অস্ট্রেলিয়ান ডলার।যে কোন দেশের বুফেতে সে দেশের সব রকম খাবার টেস্ট করা যায়।তা ছাড়া যেহেতু চয়েস অনেক থাকে সেজন্য হালাল হারামের ভয় থাকেনা।এখানেও তার ব্যতিক্রম ছিলোনা।তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিলো আনিত মহাদেশীয় অন্যান্য খাবারের সাথে সাদা ভাতের সাথে ছিলো ঘন ডাল।নানা খাবারে উদরপুর্তি করে খাওয়া হলো।
খাওয়ার মাঝখানে এলো ফটো গ্রাফার।আমার চেহারা দেখেই বাংলায় কথা বল্লো।নাম বল্লো আজিম।বাংলাদেশের সিলেটের ছেলে।ইচ্ছে না থাকলেও দেশী ভাই বলে ফটো রাজী হলাম।বল্লাম একটু পর আসতে।খাওয়া শেষ হলে ছবি তুলবো।
খাওয়া শেষে কফি খাচ্ছি এমন সময় এলো আজিম।ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন অ্যাংগেল থেকে ছবি তুল্লো।আমাকে বসিয়ে রেখেই ছবি গুলো প্রিন্ট করে একটা এলবাম বানিয়ে নিয়ে এলো।অনেক গুলো ছবি কোনটার ব্যাকগ্রাউন্ডে সিডনি হারবার,কোনটার সিডনি অপেরা আরো নানা ভিউ।বুঝলাম দেশী ভাই বলে আদর শুধু যত্ন করে ছবিই তুলেনি মনযোগ দিয়ে প্রিন্ট ও করেছে।পেমেন্ট করে নীচে নামার জন্য বের হলাম।আজিম বল্লো একটু অপেক্ষা করতে।আজ তার ডিউটি শেষ।আমার সাথে সেও নীচে নামবে।টাওয়ারের অন্যান্য ফ্লোর গুলোও সে ঘুরে দেখাবে।
আজিম জানালো আমি ইচ্ছে করলে এখানে টাওয়ার সিনেমা হলে ছবি দেখতে পারি।এটার একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে।পাঁচ মিনিটের ছবিতে যখন যে দৃশ্য আসে সে অনুভূতি সৃস্টির জন্য সে পরিবেশ তৈরি করা হয়।পানির দৃশ্য দেখালে দর্শকদের পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হয়।আবার আগুনের দৃশ্যে হলের ভেতরে ধোঁয়া ছড়ানো হয়।ইত্যাদি।টিকিটের সঙ্গে ফোর ডি চশমা দেয়া হয়।সময় নেই বলে সিনেমা দেখা থেকে বিরত থাকলাম।তা ছাড়া সিনেমা দেখার চাইতে আজিমের সাথে ঘুরে দেখা আমার কাছে বেশী আকর্ষনীয় ছিলো।
আজিম জানালো সেদিনের মত তার কাজ শেষ।বাসায় যাবে।সে ব্যাচেলর মানুষ।একাই থাকে।কোন তাড়া নেই।আমি চাইলে সে আমাকে সঙ্গ দিতে পারে।শুনে খুশী হলাম।দেশী ভাইকে নিয়ে ঘুরতে পারলে অনেক দেখা এবং জানা যাবে।বিজন্যাস ডিস্ট্রিক্ট দিয়ে যাচ্ছিলাম পায়ে হেঁটে।সুপ্রশস্ত রাস্তা।এলিভেটেড হাইওয়ে।মনোরেল,সাবওয়ে সবই সবই আছে।রাস্তায় রিক্সা বা স্কুটার কিছুই নেই।ট্যাক্সি এবং বাস চলছে রাস্তায়।আজিম জানালো নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানি সিডনি সবচেয়ে প্রাচীন এবং ব্যস্ত শহর।পাহাড়কেটে তৈরি এই শহরকে ঘিরে রয়েছে মনোরেল।পাহাড়ী এলাকা বলে এখানকার পথঘাট বেশ উঁচু নীচু।এমনিতেই এই শহরে বিভিন্ন জাতির বসবাস।তারপর সারা বছর সারা বিশ্ব থেকে আসা পর্যটকরা শহরটিকে আরো বর্ণময় করে তুলে।
সিডনি টাওয়ার থেকে বেরিয়ে অল্প দূরত্বে আজিম আমাকে নিয়ে গেলো চায়না টাউনে।বিশাল এলাকা নিয়ে সিডনির চায়না টাউন।তবে পৃথিবীর সব চায়না টাউনই চরিত্রগতভাবে এক।। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট,হরেকরকম চাইনিজ পন্য সামগ্রীর দোকান,ম্যাসেজ পার্লার ইত্যাদি।এসব চাইনিজ মার্কেটে ঢুকলে মনে হয় চায়নাতে আছি।চারদিকে শুধু চাইনিজ আর চাইনিজ।তাদের কিচির মিচির বাক্যালাপ।তবে ফরাসি,হিন্দী, এবং অন্যভাষার কথা বার্তাও কানে আসছিলো।পৃথিবীর সব দেশে বসবাসরত চাইনিজরা ব্যবসা বানিজ্য করে অর্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করে।আর এজন্যই বোধহয় চায়না এখন বড়অর্থনৈতিক শক্তির দেশ হতে পরিচিত হতে পেরেছে।
আজিম জানালো চায়না টাউনে চাইনিজ ছাড়াও নানান দেশের খাবার রেস্টুরেন্ট আছে।যেমন ভিয়েতনামিজ,ইতালিয়ান,,জার্মানি, মালয়েশিয়ান,ইন্দোনেশিয়ান সহ নানান দেশের খাবার।এক জায়গায় অত দেশের খাবার নাকি সিডনি তেই আছে।যা অস্ট্রেলিয়ার অন্য শহরে নেই।আমি তাকে জানালাম আমাদের নিউইয়র্কের চায়না টাউনে নানা দেশের খাবার রেস্টুরেন্ট তো আছেই।তারপরও লিটল ইতালি নামক একটি এলাকা আছে যেখানে একসাথে বহু ইতালিয়ান খাবার দোকান রয়েছে।শুনে সে খুব অবাক হলো।
আজিমের সাথে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি ডার্লিং হারবারে।সমুদ্রের একটা অংশ এখানে ভেতরে ঢুকে শান্ত শিস্ট হয়ে যেন চুপটি করে বসে আছে।পানি স্বচ্ছ এবং টলোমলো।পানিতে ভাসছে অসংখ্য প্রমোদ তরী।ভাসমান জাহাজগুলোয় কোনটায় পার্টি হচ্ছে।তীরে থেকেও হৈ হল্লা শোনা যাচ্ছে।আজিম জানালো দিনের বেলা আসলে জাহাজে করে পানি থেকে অপেরা হাউজ,হারবার ব্রীজ সহ আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করার ব্যবস্হা আছে।জাহাজেই ডিনার বা লান্চের ব্যবস্হা আছে।সিডনির অনেক বিখ্যাত দর্শনীয় স্হান এই ডার্লিং হারবারে।যেমন সিডনি হারবার ব্রীজ ,সিডনি অপেরা হাউজ, ইত্যাদি ।এগুলি ঘুরে দেখার জন্য নিউইয়র্ক থেকেই গাইডেড ট্যুর বুক করে এসেছি।তবে বাইরে থেকে অপেরা হাউজ, হারবার ব্রীজ দেখলাম।রাতের রঙ বেরঙের আলোতে অপেরা হাউজ এবং হারবার ব্রীজ দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল।
হাঁতে হাঁটতে চায়ের পিপাসা পাচ্ছিল।একটু ক্লান্তিও ভীড় করছিলো শরীরে।আর শরীরেই বা দোষ কি। গত কদিন ধরেই শরীরটাকে বিরতিহীন খাটাচ্ছি।আজিমকে বলতেই সে আমাকে অল্প দূরেই একটা কফি শপে নিয়ে গেলো। ছোট্ট দোকানটাতে মানুষের ভীড়ছিলো প্রচুর।আমাকে বাইরের একটা বেন্চে বসিয়ে আজিম কফি আনতে গেলো।কফির দাম দিতে চাইলেও সে নিলোনা।একটু পরেই কফি নিয়ে ফিরলো সে।সাথে একটা বড়সড় পিৎজা। পিৎজা দেখে যেন ক্ষিধেটা চাগিয়ে উঠলো।চারদিকে ঘুরে দেখার আনন্দে এতই মগ্ন ছিলাম যে একক্ষণ ক্ষুধা অনুভব করিনি।কে যেন বলেছিলো ক্ষুধা পেটে সৌন্দর্য উপভোগ করা কঠিন।তাই দেরী না করে খেতে বসলাম।পেট পুরে পিৎজা খেয়ে আয়েশ করে চুমুক দিলাম কফিতে।আজিম বল্লো ,অস্ট্রেলিয়ানরা কফি পাগল।মিটিং য়ে কফি,বেড়াতে গেলে কফি,আড্ডায় কফি।কফি না হলে তাদের চলেই না।
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৯ টা ছুঁই ছুঁই করছে। আজিমকে বল্লাম হোটেলে পৌছে দিতে।
-হাবিব রহমান
ADVERTISEMENT