তায়েফের বণি সাকিফ গোত্রের বিবি হালিমার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন শিশু নবী (সা:)। এই শহরের একটি পাহাড়ে তিনি ছাগল চড়াতেন। তায়েফ-কে বলা হয় ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সৌদী বাদশা ফয়সল এবং বা বাদশা খালেদের আমলে শীতকালীন রাজধানীর মর্যাদা পায় তায়েফ। রবি শস্য ও ফলফলাদি বিশেষ করে আঙ্গুরের জন্য তায়েফ বিখ্যাত। তায়েফে উৎপাদিত শাকসবজি সমগ্র সৌদি আরবের চাহিদার ৩০ ভাগ পূরণ করে থাকে।
সুন্দর এবং মনোরম শহর তায়েফ। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের শহর তায়েফ। চমৎকার একটি সাজানো-গুছানো শহর। চারদিকে সবুজের হাতছানি। ক্ষেত ভরা ফসল, খেজুর গাছের ঘন বন। আর এই শহরবাসীর প্রস্তর আঘাতেই আমাদের প্রিয় নবীজীর (সা:) শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলো। তাঁর উপর চালিয়েছিলো নানা নির্যাতন। এছাড়াও নানা কারণে ইতিহাসে তায়েফ শহরটি আলোচিত। এই তায়েফের বণি সাকিফ গোত্রের বিবি হালিমার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন শিশু নবী (সা:)। এই শহরের একটি পাহাড়ে তিনি ছাগল চড়াতেন। তায়েফ-কে বলা হয় ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সৌদী বাদশা ফয়সল এবং বা বাদশা খালেদের আমলে শীতকালীন রাজধানীর মর্যাদা পায় তায়েফ। রবি শস্য ও ফলফলাদি বিশেষ করে আঙ্গুরের জন্য তায়েফ বিখ্যাত। তায়েফে উৎপাদিত শাকসবজি সমগ্র সৌদি আরবের চাহিদার ৩০ ভাগ পূরণ করে থাকে।
এসব নানা কারণে তায়েফ শহরটি দেখার শখ ছিলো বহুদিনের। তাই এবার আমার সৌদি আরব ভ্রমণের সময় মক্কা-মদিনার পাশাপাশি তায়েফ শহরটিও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। গত দু’দিন আমি বাংলাদেশী গাড়ী চালক জসিমের সাথে পবিত্র মক্কা নগরীর আশেপাশে ঘুরে বেরিয়েছি। তার সাথে আমার চুক্তি হয়েছিলো আজ সে আমাকে তায়েফ নিয়ে যাবে। কথামতো সকাল ৮টায় সে আমাকে তুলে নিলো হোটেল থেকে।
গাড়ী চলছে পাহাড় ঘেষা আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে গভীর খাদ। এসব পাহাড়ী পথে চলাচলের অভিজ্ঞতা আমার অনেক। ভারতের দার্জেলিং, সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালা, স্পেনের পাহাড়ীগ্রাম রুপিত সহ এমনি অনেক পাহাড়ী এলাকা ভ্রমণ করেছি। তাই উঁচু পাহাড়-কে সঙ্গী করে আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলা আমার জন্য সমস্যা হচ্ছিলো না।
জসিম জানালো, তায়েফের রাস্তার আশেপাশে গড়ে উঠেছে অনেক অবকাশ কেন্দ্র। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে ক্যাবল কার। পর্যটকরা এসব ক্যাবল কারে চরে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। পাহাড়ী রাস্থায় ঘুরে ঘুরে গাড়ী উপরে উঠছিলো। মূল শহরের কাছাকাছি পৌঁছতেই গাড়ী গো গো করে থেমে গেলো। জসিম বেরিয়ে গিয়ে বনেটটা উঠিয়ে দেখলো ইঞ্জিনটা গরম হয়ে গেছে। আধা ঘন্টার মতো বিশ্রাম নিতে হবে। ইঞ্জিনটা একটু ঠান্ডা হলে আবার রওনা দেবো।
গাড়ী থেকে নেমেই দেখলাম। অল্প দূরেই রাস্তার পাশে সারি সারি ফলের দোকান। আমি এগিয়ে গেলাম। পরে জেনেছিলাম জায়গাটির নাম ওকাজ। দেখলাম প্রতিটি দোকানেই বাংলাদেশী কর্মচারী। তারা গল্প গুজবে মত্ত। আঙ্গুর কমলা ছাড়াও বাংলাদেশী বড়ই, বড় বড় কলা, ডালিম, শরিফা সহ নানা পরিচিত ফল চোখে পড়ছিলো। ডালিমের খোঁসা ছাড়িয়ে রসে ভরা দানাগুলো প্যাকেট করে রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য। লোভ সামলাতে না পেরে দুই প্যাকেট কিনলাম। একজন বাংলাদেশী কিছু আঙ্গুর প্যাকেট করে দিয়ে বললেন- ‘গাড়ীতে বসে খাবেন। তায়েফের আঙ্গুর খুব মিষ্টি।’ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ীর কাছে এসে দেখলাম তখনো ইঞ্জিনের মর্জি ভালো হয়নি। জসিম জানালো- আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন উটওয়ালা এলো। রকমারী সাজে সজ্জিত উটটি। পর্যটকরা উটের উপর উঠে ছবি তোলে আর আশপাশের এলাকা ঘুরে বেড়ায়। আমিও দরদাম করে আধা ঘন্টার জন্য একটি উট ভাড়া করলাম।
পাহাড়ী রাস্তায় চলার সময় দেখলাম কোথাও উট আবার কোথাও দুম্বার সারি। ব্যবসায়ীরা উটে করে মাল পরিবহণ করছে। অনেক বানরও চোখে পড়লো রাস্তার পাশে। পথচারীরা পাশের দোকান থেকে কলা কিনে এনে তাদের খাওয়াচ্ছে। উট ভ্রমণ শেষ করে গাড়ীর কাছে আসতেই জসিম জানালো- গাড়ী রেডি। এরপর অল্প সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম তায়েফ শহরের প্রাণ কেন্দ্রে। মক্কা থেকে ১২০ কিলোমিটার তূরত্বে তায়েফ শহরে পাহাড়ী পথে সময় লেগেছে দেড় ঘন্টার মতো। শহরটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত।
জসিম প্রথমে আমাকে নিয়ে গেলো বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:) এর মাজারে। মাজারটি চারদিকে দেয়ার দিয়ে বেষ্টন করা। খাদেম জানালো- বেষ্টনীর ভিতর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:) সহ আরো বেশ কয়েকজন সাহাবীর কবর রয়েছে। মাজারের কাছে যাওয়া অথবা কবর স্পর্শ করা সৌদি সরকার বেদাত বলে মনে করে। তাই কবরের চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। দেয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করে চলে এলাম পাশের মসজিদে। এটা তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ। এর নামকরণ করা হয়েছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:)-এর নামে। এটা মসজিদে ইবনে আব্বাস নামে পরিচিত। মসজিদের পাশে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। এতে আছে অনেক মুল্যবান কিতাব-এর সংগ্রহ। আছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:)-এর হাতে লেখা পবিত্র কোরআনের কপি সহ বিভিন্ন সময়ে পাথর ও কাগজে লিখিত পবিত্র কোরআনের প্রাচীন কপি।
এরপর আমরা এলাম ওয়াদি মিটনা নামক একটি স্থানে। পথভ্রষ্ট কিছু তায়েফবাসী এখানেই রসুল (সা:) এবং তাঁর পালিত পুত্র হারেসা বিন জায়েদকে পাথর ছুড়ে রক্তাক্ত করে। এই নিপীড়নের স্থানটি দেখে অজান্তেই চোখ অশ্রসজল হয়ে উঠে। এক বর্ণনায় আছে- তায়েফবাসীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে রক্তাক্ত রাসুল (সা:) ওয়াদি মিটনার পাশে এক আঙ্গুর বাগানে আশ্রয় নেন। তখন সেখানে ফেরেস্তা জিবরাইল এসে বলেন- হে আল্লাহর রাসুল (সা:) মহান আল্লাহপাক আপনার প্রতি তায়েফবাসীর অত্যাচার দেখেছেন। এই পাহাড়ের রক্ষক ফেরেস্তারা আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছেন। আপনি যা বলবেন, তারা তাই করবেন। আপনি হুকুম দিনে দুই পাশের পাহাড় একত্রিত করে তায়েফবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে। এই কথা শুনার পর পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত মহামানব ফরিয়াদ করে বলেন, হে আল্লাহ! এরা বুঝে না। এরা যদি ধ্বংস হয়ে যায়, আমি কাদের কাছে তোমার বাণী প্রচার করবো! ঐতিহাসিকরা বলেন- এই দোয়া পৃথিবীর মহামানবদের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ আবেদন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এখানে কারো বিরুদ্ধে বিদ্বেষ কিংবা অভিযোগ তুলে ধরা হয়নি। কারো ধ্বংস কামনা না করে ক্ষমার মহত্ত দেখানো হয়েছে।
জসিমের আহ্বানে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। কেনো জানি বার বার ১৪০০ বছরের আগেকার এই ঘটনাটি মনে পড়ে হৃদয়কে পীড়া দিচ্ছিলো। গাড়ী এসে থামলো একটি পাহাড়ের ঢালে। আমাদের একটু হেঁটে উপরে উঠতে হবে। এখানেই ছিলো সেই বুড়ির বাড়ী। যে কিনা রাসুল (সা:) এর পথের উপর কাঁটা বিছিয়ে রাখতো। ছোট ছোট দুটি কক্ষ নিয়ে পাথরের তৈরী একটি ঘর। আমরা সেখানে ছবি তুলে আবার গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। এরপর গাড়ী এসে থামলো হযরত আলী (রা:) মসজিদের সামনে। একটি মিনার সহ ছোট একটি মসজিদ। যেখানে ১০/১২জন মুসল্লী নামাজ পড়তে পারেন। জানা যায়, হযরত আলী (রা:)-এর খেলাফতকালে তিনি এই মসজিদে বসে জনগণের অভাব-অভিযোগ শুনতেন এবং খেলাফত পরিচালনা করতেন।
এবার আমাদের মক্কা ফিরে যাওয়ার পালা। আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য মিকাত জিল মাহরাম। এখানে গিয়ে গোসল বা অজু করে এহরাম পড়ে মক্কায় গিয়ে ওমরাহ করতে হবে। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী কাজ করছেন। তারাই অজু এবং গোসলখানার স্থান দেখিয়ে দিলেন। গোসল করে এহরামের কাপড় পরিধান করে মসজিদে দুই রাকাত নামাজ পড়ে জসিমের সাথে রওনা হলাম মক্কার পথে।