Categories
ইউরোপ

অপরূপ আইসল্যান্ড

আইসল্যান্ডে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন। দিনে রাতে ঠাসা ট্যুর প্রোগ্রাম। সকাল ৯টা থেকে শুরু হবে গ্রান্ড গোল্ডেন সার্কেল ট্যুর যা শেষ হবে বিকাল ৫ায়। আগ্নেয়গিরির ক্রেটার, হট স্প্রিং, গাইজার, জলপ্রপাতসহ আরো নানা কিছু আছে দর্শনীয় তালিকায়। আর রাতের বেলায় নর্দান লাইটস ট্যুর।
সকাল ৮.৩০ মিনিটে সবাই হোটেলের লবিতে গিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। ট্যুর গাইড আমাদের তুলে নিলো কাঁটায় কাঁটায় ৯টায়।
বিরাট বাস। পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ উঠেছে এই বাসে। সবাই মিলে সারাদিন ঘুরে দেখবো আইসল্যান্ড। আমাদের সুদর্শন চটপেেট গাইডের নাম জন পোরসন। জন নামে ডাকলেই হবে জানালো সে। উচ্চারণ সহজ। আরো কয়েকটা হোটেল ঘুরে সবাইকে বাসে উঠিয়ে শুরু হলো যাত্রা।
টিপিক্যাল ট্যুর গাইডের মত শুরু হলো তার বক্তৃতা। প্রথমেই আইসল্যান্ডের ইতিহাস জানালো। দ্বীপটির প্রায় ১১ শতাংশ হিমবাহ দ্বারা আবৃত। দ্বীপের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা পশু চারণের জন্য ব্যবহার করা হয়। আর মাত্র ১ শতাংশ এলাকায় হয় কৃষিকাজ। ৯০০ খ্রীষ্টাব্দে দ্বীপটিতে মানুষ বসতির আগে দ্বীপটির প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ বৃক্ষ আচ্ছাদিত ছিলো। বর্তমানে কেবল কিছু বার্চ গাছের জঙ্গল ছাড়া আর তেমন কোন বনভূমি অবশিষ্ট নেই।
আরো কিছু মজার তথ্য দিলো গাইড জন। তা হলো আইসল্যান্ডে কোন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী কিংবা বিমান বাহিনী নেই। দেশটির পুলিশ নিজেদের সাথে কোন অস্ত্র রাখেনা। কারণ এখানে অপরাধ খুবই কম হয়। তাছাড়া দেশটি এতটাই পরিষ্কার যে সেখানে কোন মশা নেই। দেশটিতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও নেই। আইসল্যান্ডের মানুষ আইসক্রীম খেতে ভীষণ পছন্দ করে। এতটাই পছন্দ করে যে, তারা কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও আইসক্রীম খেয়ে থাকে। জাতিসংঘের প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুযায়ী আইসল্যান্ড বিশে^র মধ্যে তৃতীয় সুখী দেশ।
বাস প্রথমে এসে থামলো একটি চার্চের সামনে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে একটা জিনিস আমি দেখেছি সে সব দেশে প্রতিটি ট্যুর প্রোগ্রামে চার্চ দর্শন অন্তর্ভূক্ত থাকে। চার্চগুলোর যেমন রয়েছে ইতিহাস তেমনি আছে নান্দনিক স্থাপত্য। তাই সেগুলো দর্শনীয় তালিকায় পড়ে।
আমাদের যে চার্চটি দেখাতে নিয়ে আসা হলো তার নাম হলগ্রিমিস্কিকা চার্চ। লুথারর্ণ সম্প্রদায়ের এই চার্চটি আইসল্যান্ডের সবচেয়ে বড় চার্চ এবং দেশটির সবচেয়ে লম্বা স্থাপত্য। এর অবস্থান রিকজাভিকের একেবারে মধ্যভাগে। তাই দেখা যায় যে কোন অংশ থেকে। গাইড জানায় ৪১ বছর সময় নিয়ে এই চার্চটি তৈরি করা হয়। পাথরের তৈরি লম্বা লম্বা কলাম একটি আর একটির সাথে লাগানো। দুই পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট কলাম এবং ধীরে ধীরে মাঝপথে উঁচু লম্বা কলাম একসাথে হয়ে দেয়াল আকৃতির একটা উঁচু পাহাড়ের রূপ ধারণ করেছে। চার্চটির নামকরণ করা হয়েছে আইসল্যান্ডের কবি Hallgrimur Petursson এর নামে।
বাস ছুটে যাচ্ছিলো মসৃন পথ ধরে। রাস্তায় দুধারের মাঠে কালো কুচকুচে এবড়ো থেবড়ো পাথর। গাইড জানালো এগুলি আগ্নেয়গিরির লাভা গলে এই কালো পাথরে পরিণত হয়েছে। এই পাথুরে জমিতে কোন ফসল উৎপন্ন হয় না। এক ধরনের গুল্ম জাতীয় ঘাস দেখা গেলো এখানে সেখানে। স্থানীয় ভাষায় এগুলোকে বলা হয় ‘মস’। আর এগুলি ঘোড়ার প্রিয় খাবার। মাঝে মাঝেই ঘোড়ার পালের দেখা মিললো এসব জমিতে। অনেক সময় দাড়িয়ে থাকা ঘোড়াগুলোকে স্টাচু বলে ভ্রম হয়।
আমরা চার্চ দেখে রের হতেই হুড়মুড় করে শুরু হলো বৃষ্টি। অথচ হোটেল থেকে যখন আমরা বাসে উঠি তখন আকাশ ছিলো নির্মেঘ, সমগ্র আকাশে ছিল ছোট ছোট সাদা ভেলার ছড়াছড়ি। অবশ্য আমি এবং আমার গ্রুপের পূর্ব প্রস্তুতি ছিলো আগে থেকেই। সবাইকে ছাতা সাথে রাখতে আগেই বলে দিয়েছিলাম। আইসল্যান্ড আসার আগে আমি হোম ওয়ার্ক করে এসেছিলাম। তাতে জেনেছি এখানের আবহাওয়া ক্ষনে ক্ষনে পাল্টে যায়। মুহূর্তে মুহূর্তে চলে রোদ বৃষ্টির খেলা। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে কৌতুক প্রচলিত আছে তা হলো “আবহাওয়া তোমার পছন্দ না হলে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো”। অর্থাৎ আইসল্যান্ড এমনই একটা জায়গা যেখানে সূর্যের তাপে ত্বক পুড়ে যাবে আবার একটু পরেই ঝমঝম বৃষ্টি আপনার গা ভিজিয়ে দিবে।

গুলফস জলপ্রপাত
গুলফস জলপ্রপাত

এরপর বাস এসে যেখানে থামলো তার নাম ‘বিয়ার নারফেল’। এখানে আছে একটি গরম পানির ঝর্ণা যা থেকে সব সময় বুদ বুদ উঠছে। একটু পরেই এই গরম পানি উঠে আছে অনেক উচ্চতায়। প্রাকৃতিক এই উষ্ণ প্রবাহকে ইংরেজীতে বলে গাইজার।
বাসে উঠার পর গাইড ঘোষণা দিলো আমাদের পরবর্তী স্টপেজ হবে এটা জলপ্রপাত। আমি নায়াগ্রার দেশের মানুষ। এছাড়াও সুইজারল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনেক সুন্দর সুন্দর জলপ্রপাত দেখেছি। তাই তেমন কোন আগ্রহ ছিলো না জলপ্রপাত দেখার। কিন্তু গাইডের পীড়াপীড়িতে নামলাম। জলপ্রপাতের তীরে এসে বুঝতে পারলাম, না আসলে অনেক মিস করতাম।
প্রপাতটির নাম ‘গুলফস’। অর্থাৎ সোনালী জলপ্রপাত। সূর্যের আলোর প্রতিফলনে জলপ্রপাতটিকে সোনালী রং এর মনে হচ্ছিলো। প্রপাতে জল আসছে আইসল্যান্ডের অগণিত হিমবাহের জল গলে। প্রপাতের গর্জন, কুয়াশার মত জলের কণা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল।
দুপুরে বাস থামলো একটা মলের সামনে। লাঞ্চের পর কিছুটা ফ্রি সময় কেনাকাটার জন্য। আইসল্যান্ডের ভেড়ার মাংস খুব বিখ্যাত। আমার গ্রুপের প্রায় সবাই ভেড়ার মাংসের স্যুপ এবং পাউরুটির অর্ডার দিলো। হালাল হারাম বিবেচনায় আমি বিদেশে সাধারণত মাংস খাই না। তাই সামুদ্রিক মাছের স্যান্ডউইচ অর্ডার দিলাম। এর পরে স্থানীয় খাবার ‘স্কীর’। এটা হলো ঘন দই এবং খেতে খুব সুস্বাদু।
খাওয়া দাওয়া এবং কিছু কেনাকাটার পর গাইড আমাদের নিয়ে এলো ‘থিংভেলি ন্যাশনাল পার্কে’। অপূর্ব সৌন্দর্য্য মন্ডিত এই পার্ক। গাঢ় নীল রংয়ের একটা লেক রয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। গাইড জানালো পৃথিবীর উপরের স্তরটা অনেকগুলো প্লেট ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে জোড়া লাগালে যেমন হয় অনেকটা সেরকম। এই প্লেটগুলোকে বলে ‘টেকটনিক প্লেট’। এই প্লেটগুলি যখন এদিক ওদিক নড়াচড়া করে তখনই হয় ভূমিকম্প। এই রকম দুটো প্লেট সেখানে জোড়া লেগেছে। তার ঠিক উপরে বসে আছে আইসল্যান্ড দেশটা আর প্রতিবছর এই প্লেটগুলো বাইরের দিকে এক ইঞ্চি করে সরে যাচ্ছে। আর মাঝের সেই ফাটল ভরে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির লাভা জমে যাওয়া পাথরে। থিংভেলী ন্যাশনাল পার্কের এক জায়গায় দু’দিকের প্লেটের সেই ফাটল দেখালো গাইড। এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে যেন কুয়াশায় ঘিরে আসছে চারদিক। শীতও পড়ছে জাঁকিয়ে। হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতে আবার বেরোতে হবে সুমেরু প্রভা বা অরোরা বোরিয়ালিস দেখার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *