সকাল ৮টায় হোটেলে নাস্তা সেরে লবিতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। ৮টা ১৫ মিনিটে আমাকে নিতে এলেন এরশাদ ভাই। তিনি গত ৩৫ বছর যাবৎ মদিনায় বসবাস করেন। আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিরপুরের সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের ভগ্নিপতি। মদিনা এলেই তিনি আমার লোকাল গার্ডিয়ান। এয়ারপোর্টে রিসিভ করা, হোটেলে নিয়ে আসা, জিয়ারত সবই চলে তার তত্ত্বাবধানে। সবশেষে আমাকে মদিনা এয়ারপোর্ট বা মক্কার উদ্দেশ্যে গাড়ীতে তুলে দিয়েই তার ছুটি। আমি মদিনায় এলে তার সব কাজ বন্ধ। তার কাজ শুধুই আমাকে সময় দেয়া।

সম্প্রতি তার সাথে যুক্ত হয়েছেন আরো একজন। নাম রিয়াজুল ইসলাম, বাড়ী সিরাজগঞ্জ। হারাম শরীফের পাশেই একটি বড় হোটেলের রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজার। একবার আমি তার হোটেলে উঠেছিলাম। প্রথম পরিচয়েই তার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এখন তার হোটেলে না উঠলেও আমি মদিনায় আসলেই তিনি আমার ছায়া সঙ্গী। কাজ থেকে ছুটি নিয়ে আমার সাথে ঘুরে বেড়ান। আজও আমি তাকে হোটেল থেকে তুলে নিয়েছি।
মদিনা এলেই রসুল (সা:)-এর মাজার জিয়ারতের পর দ্বিতীয় প্রায়োরিটি হিসেবে যেখানে যাই তাহলো মসজিদুল কোবা। এটি ইসলামের তৃতীয় মসজিদ। পৃথিবীর প্রথম মসজিদ হচ্ছে বায়তুল্লাহ মসজিদুল হারাম। এরপর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস। আর তৃতীয়টি হচ্ছে মসজিদে কোবা। আর চতুর্থ মসজিদ হচ্ছে মসজিদে নববী। আল্লাহর নির্দেশে মোহাম্মদ (সা:) যখন মক্কায় হিজরত করেন তখন তিনি কোবা নামক পল্লীতে অবস্থান করেন এবং সেখানেই তিনি এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। পবিত্র কোরআনের সূরা তৌবার ১০৮ নম্বর আয়াতে এই মসজিদের কথা উল্লেখ রয়েছে। মসজিদটি মদিনা শরীফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে অবস্থিত। এর দূরত্ব মসজিদে নববী থেকে ৫ কিলোমিটার। রসুল (সা:) এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি নিজের ঘরে ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করে মসজিদে কোবায় আগমণ করে নামাজ আদায় করেন তিনি একটি ওমরাহর সমপরিমান সওয়াব পাবেন। আর সেজন্যই রসুল (সা:) এর সময় থেকেই মসজিদে কোবায় গমন করা মদিনাবাসীদের অভ্যাসে পরিণত হয়।
মসজিদে কোবায় আমরা দু’ রাকাত নামাজ আদায় করে রওনা হলাম মসজিদে কেবলাতাইনের দিকে। গাড়ীতে উঠেই আমার গাইড এরশাদউল্লাহ মসজিদে কেবলাতাইনের কিছু তথ্য দিলেন। এই মসজিদে নামাজ পড়ার সময় মুহাম্মদ (সা:)-এর কাছে কিবলা পরিবর্তনের ওহি আসে। মহানবী (সা:) মদিনায় হিজরত করার পর প্রায় ১৬ মাস বায়তুল মোকাদ্দেসের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। মুসলমানদের কিবলা বায়তুল মোকাদ্দেসের দিকে হওয়ার কারণে ইহুদীরা এই বলে অপপ্রচার চালাতে থাকলো যে, আমাদের ও মুসলমানদের কেবলা এক ও অভিন্ন, অতএব ধর্মের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের উচিৎ আমাদের অনুসরণ করা। এসব কারণে হুজুর (সা:) এর হৃদয়ে সুপ্ত বাসনা ছিলো কাবা যদি মুসলমানদের কিবলা হতো? হিজরী দ্বিতীয় সনের শাবান মাসে তিনি আসরের নামাজ আদায়েরর জন্য মসজিদে আসেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকাতের মাঝামাঝি সময়ে আল্লাহর হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর ইচ্ছা বাস্তবায়নে জিরাইল (আ:) মহান আল্লাহর বাণী নিয়ে অবতীর্ণ হন। এই বাণীতে কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়। এই ঘটনাটি সুরা বাকারার ১৪৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। দুই রাকাত বায়তুল মোক্কাদ্দেস-এর দিকে আর দুই রাকাত কাবা শরীফের দিকে ফিরে আদায় করেছিলেন বিধায় এই মসজিদটি ইতিহাসে মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কেবলা বিশিষ্ট মসজিদ নামে সুপরিচিত। রসুল (সা:) এর যুগ থেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই মসজিদে দুটি মেহরাব বা ইমামের দাঁড়ানোর স্থান ছিলো। পরে সংস্কারের সময় বায়তুল মোক্কাদ্দেস মুখী মেহরাবটি ভেঙ্গে ফেলা হয়।
আমরা গাড়ী থেকে নেমে অজু করে মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলাম। ঐতিহ্যবাহী আরবীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই ঐতিহাসিক মসজিদে মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা ২ হাজার। মসজিদটির আয়াতন ৩,৯২০ স্কয়ার মিটার। মসজিদটিতে ২টি গুম্বুজ ও ২টি মিনার রয়েছে। উল্লেখ্য, হিজরী ২৩ খ্রীষ্টাব্দে বনিসালামা অঞ্চলে খালিদ বিন অলিদ সড়ক সংলগ্ন এই মসজিদটি রসুল (সা:) সাহাবা একরামদের নিয়ে নির্মাণ করেন। অতপর: খলিফা ইবনে আব্দুল আজিজ ১০০ হিজরীতে মসজিদটি পুন: নির্মাণ করেন। এরপরেও কয়েকবার মসজিদটির সংস্কার কাজ করা হয়।
এরপর আমরা গেলাম একটি কুপ দেখতে। এটির নাম বীর-এ ওসমান। আরবীতে বীর অর্থ কুপ। অর্থাৎ ওসমান (রা:)-এর কুপ। এ নিয়ে একটি কাহিনী আছে। একজন ইহুদীর একটি কুপ ছিলো। সে এই কুপ থেকে মুসলমানদের পানি পান করতে দিতো না। এটা জানার পর হযরত ওসমান (রা:) এই কুপটি খরিদ করে মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্য ওয়াকফ করে দেন। তবে দু:খজনক ঘটনা ছিলো যে হযরত ওসমানের খেলাফতের শেষ দিকে একসময় বিদ্রোহীরা মদিনায় তাঁর বাসভবন ঘেরাও করে খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। সেই ঘেরাও অবস্থায় তিনি একদিন জানালা দিয়ে মাথা বের করে মদিনাবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- রাসুল (সা:)-এর নির্দেশে আমি এই কুপটি ক্রয় করে সর্ব সাধারণের জন্য ওয়াকফ করেছিলাম। আজ সেই কুপের পানি থেকে তোমরা আমাকে বঞ্চিত করেছো। আজ আমি পানির অভাবে ময়লা পানি দিয়ে ইফতার করছি।
বীর এ ওসমান কুপটি এখন দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি খেজুর বাগানের ভিতরে। দর্শনার্থী প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। আমরা গেটের কাছে দাঁড়ালে ভিতর থেকে একজন লোক এসে গেট খুলে দিয়ে জানালেন- যদিও ভিতরে ঢুকার অনুমতি নেই, তিনি একজন বাংলাদেশী হিসেবে আপনাদেরকে অল্প কিছুক্ষণের জন্য সুযোগ দিচ্ছি। তিনি দ্রুত আমাদেরকে নিয়ে কুপটি দেখিয়ে নিয়ে ফিরে এলেন।
এরপর আমরা গেলাম হযরত সালমান ফার্সীর খেজুর বাগান দেখতে। তিনি ছিলেন রাসুল (সা:)-এর অন্যতম সম্মানিত সাহাবী। এই সালমান ফার্সীর পরামর্শ ও বুদ্ধিতেই খন্দক যুদ্ধে পরীখা খননের মাধ্যমে মুসলিমরা শত্রু পক্ষকে পরাজিত করে। সালমান ফার্সী (রা:) ছিলেন একজন ইহুদীর ক্রীতদাস। সেজন্য স্বাধীনভাবে তাঁর হযরত (সা:)-এর সহচার্য লাভ সম্ভব হচ্ছিলো না। এমন কি বদর ও ওহুদের যুদ্ধেও তিনি শরীক হতে পারেননি। তাই হযরত (সা:) একদিন তাকে ডেকে বললেন- তাঁর ইহুদী মালিকের সাথে আলাপ করে বিনিময় প্রদানের শর্তে মুক্তিলাভের চুক্তি করার জন্য। তিনি তার মুনিবের সাথে আলাপ করলে সে দু’টি শর্ত আরোপ করলো। প্রথমত: তিন বা ৫শত খেজুর গাছ রোপণ করে দিতে হবে এবং সেই গাছে যেদিন খেজুর ফলবে সেদিন তিনি মুক্তি পাবেন। দ্বিতীয়ত: ৪০ উকিয়া অর্থাৎ ৬ সেরের অধিক পরিমান স্বর্ণ প্রদান করতে হবে। আসলেই তাঁকে মুক্তি করে দেয়ার অভিপ্রায় ছিলো না বলেই ইহুদী এই শর্ত আরোপ করেন।
হযরত সালমান ফার্সী রাসুল (সা:)-এর দরবারে এসে এই ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি হযরত আলীকে নিয়ে গেলেন ইহুদীর কাছে। ইহুদী এক কাঁদি খেজুর দিয়ে বললেন- এই খেজুর থেকে চারা উৎপন্ন করে ফল ফলাতে হবে। রাসুল (সা:) দেখলে ইহুদীর দেয়া খেজুরগুলো আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে কয়লা করে ফেলা হয়েছে যাতে চারা না গজায়। রাসুল (সা:) খেজুরের কাঁদি হাতে নিয়ে হযরত আলী (রা:)-কে জমিতে গর্ত করতে বললেন। আর সালমান ফার্সী (রা:)-কে বললেন পানি আনতে। আলী (রা:) মাটিতে গর্ত করলে রাসুল (সা:) নিজ হাতে প্রতিটি গর্তে পুড়া খেজুর বপন করলেন। আর সালমান ফার্সী (সা:)-কে নির্দেশ করলেন গর্তে পানি দিতে দিতে সামনে এগিয়ে যেতে। হুজুর আরো বললেন যে, পানি দেওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেনো পিছনে না তাকান। বাগানের শেষ প্রান্তে যাওয়ার পর তিনি পিছনে তাকিয়ে দেখলেন প্রতিটি খেজুর থেকে গাছ উৎপন্ন হয়ে খেজুর ধরে পেকে কালো বর্ণ হয়ে আছে। এই খেজুরের নাম আজুয়া। এটি সবচেয়ে দামী খেজুর এবং স্বাদের দিকে দিয়ে বেশী সুস্বাদু।
বোখারী শরীফের ৫৩৫৬ নম্বর হাদিসে বর্ণিত আছে যে, জুমুয়া ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) তাঁর পিতা থেকে শুনেছেন রাসুল (সা:) বলেছেন- যে ব্যক্তি প্রত্যহ ৭টি আজুয়া খেজুর খাবেন সেদিন তাকে কোন বিষ বা যাদু ক্ষতি করতে পারবে না।