Categories
মধ্যপ্রাচ্য

মক্কার মিসফালাহ যেন এক খন্ড বাংলাদেশ

মিসফালাহয় আখের রস
মিসফালাহয় আখের রস

মক্কার এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মসজিদ। রাসুল (সা:) এবং তার সাহাবীদের বিভিন্ন স্মৃতি ঘেরা স্থানে এসব মসজিদ গড়ে উঠেছে। আমরা গত তিনদিন ধরে সে সব স্মৃতিময় জায়গা চষে বেড়াচ্ছি। আমরা শুধুমাত্র দর্শক তাই কোথায় যাব বা কি দেখবো তা দেখার দ্বায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি আমাদের স্থানীয় গাইড তারিকের উপর। তার কথামত সকাল আটটায় হোটেল লবিতে অপেক্ষা করছিলাম। সময় মত সে এসে পৌছালে আমরা গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।
একটু পরেই গাড়ী এসে থামলো মসজিদে নামেরার সামনে। এটি মক্কা থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে মক্কা- মদীনা রোডের আলহিজরা এলাকায় তানঈম নামক স্থানে অবস্থিত। এজন্য এটাকে মসজিদে তানঈমও বলা হয়। মসজিদটি ইসলামী শিল্প নৈপুন্যের এক অনুপম নিদর্শন। বিশাল এই মসজিদের দুটি মিনার ও একটি গম্বুজ অনেক দূর থেকে দেখা যায়। বিবি আয়েশা (রা:) এর এই মসজিদ ঘিরে রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। হিজরী ১১ সনে রাসুল (স:) বিদায়ী হজ্ব করতে আসেন মক্কায়। তাঁর সফর সঙ্গী হন বিবি আয়েশা। তিনিও হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর সাথে হজ্ব ও ওমরাহ এর নিয়ত করেন। কিন্তু শরীর খারাপ হওয়ায় তিনি রাসুল (সা:) এর সাথে ওমরাহ পালন করতে পারেননি। পরে তিনি বিবি আয়েশার ভাই হযরত আব্দুর রহমানের সাথে হারামের বাইরে এখান থেকে ওমরাহ এর ইহরাম বাঁধার জন্য পাঠিয়েছিলেন। পরে এখানে এই মসজিদটি তৈরি করা হয়। মসজিদ এবং মসজিদ চত্বরটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ৪০ জন ক্লিনার কাজ করেন। আর এদের সবাই বাংলাদেশী। তাদের বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ হলো। আয়েশা মসজিদে দু’ রাকাত নামাজ পড়ে আমরা আবার গাড়ীতে এসে বসলাম।
ততক্ষনে ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। সবার পেটে ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছিলো। তারিককে বললাম হেরেম শরীফ সংলগ্ন বাংলাদেশী অধ্যুষিত মিসফালায় নিয়ে যেতে। ওখানেই আমরা লাঞ্চ করবো। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে কিশোর বয়স আমার মায়ের সাথে হজ্ব করতে এসে এই মিসফালাহয় একটি বাড়ীতে উঠেছিলাম। আমাদের সৌদি মুয়াল্লিম ইব্রাহিম ওজাইমি আমাদের পরিবারের ১১জন সদস্যকে এখানেই একটি সুন্দর বাড়ীতে রেখেছিলেন। এর পরেও কয়েকবার পবিত্র মক্কায় আসা হলেও মিসফালায় আসা হয়নি। তারিক জানালো এই এলাকায় ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক হোটেল রয়েছে। এর মাঝে দুই তৃতীয়াংশ পরিচালিত হয় বাংলাদেশীদের দ্বারা। এখানে অনেকগুলি মসজিদ রয়েছে। তার অধিকাংশ বাংলাদেশী ইমাম বা মুয়াজ্জিন। আছে জামা কাপড়, জুয়েলারী জুতা সহ নানাবিধ দোকান। আছে বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট। ভর্তা ভাজি থেকে সব ধরনের বাংলাদেশী খাবার পাওয়া যায়।
মিসফালাহ অর্থ নীচু এলাকা। পাহাড় ঘেরা মক্কায় অপেক্ষাকৃত নি¤œ ভূমি হচ্ছে এই এলাকাটি। হেরেম শরীফের পাশে ইব্রাহিম খলিল সড়কটি মিসফালাহ এলাকার মধ্য দিয়ে চলে গেছে মক্কা শহরের ভেতরে। রাস্তার এক পাশে খালি জায়গায় ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর চরে বেড়াচ্ছে। অনেকে শস্য দানা কিনে ছিটিয়ে দিচ্ছে কবুতরদের খাওয়ানোর জন্য। ভীড়ের জন্য গাড়ী আস্তে আস্তে যাচ্ছিলো। চারদিকে বাংলা কথা বার্তা কানে আসছিলো। মনে হচ্ছিলোনা বিদেশে কোথাও আছি।
তারিক বল্লো চলুন খাওয়ার আগে আরো একটি বাংলাদেশী এলাকা ঘুরিয়ে আনি। জায়গাটা মিসফালাহ থেকে খুব বেশী দূরে নয়। মিনিট পাঁচেক পর গাড়ী এসে থামলো একটি এলাকায়। জায়গাটির নাম নাক্কাসা। এখানে শুধু বাংলাদেশী নয় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলমানদেরও বসবাস। তাদেরও রয়েছে নানা ধরনের ব্যবসা। এখানে বাহারী রকমের শাক শব্জী, ফল, মুরগী, মাছ কিনতে পাওয়া যায়। এখানকার রেষ্টুরেন্টগুলি লাঞ্চ, ডিনারের পাশাপাশি বিকেল থেকে ছোলা, বুট, মুড়ি, পিয়াজু, কাবাব ইত্যাদি পাওয়া যায়। নাক্কাসা এলাকায় একটু ঘুরে ফিরে আবার ফিরে এলাম মিসফালাহ এলাকায়। বড় রাস্তা থেকে ভিতরে ঢুকে গেছে ছোট বড় গলি। গলির অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রথমেই দেখে থমকে গেলাম। তারপরও এসেছি যখন খেতে হবে। শুধু খেতে নয় পরিবেশ দেখার জন্যও। নীচে কিচেনে রান্না হচ্ছে। সিড়ি বেয়ে উপরে খাবার ব্যবস্থা। প্রতিটি রেষ্টুরেন্টের সামনে লোকজন দাড়িয়ে চিৎকার করছে। আসেন ভাই আমাদের এখানে ভাত, মাছ, গরু, খাসী, উট সব মাংস আছে। বলা যায় গ্রাহকদের নিয়ে টানাটানি। সারি সারি অনেকগুলি হোটেল। এর মাঝে থেকে বাংলাদেশ নামের হোটেলটা পছন্দ হলো। নীচে রাস্তায় দাড়িয়ে যেই ছেলেটি লোক ডাকছিল গায়ে লাল গেঞ্জি। সামনে পেছনে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। বাংলা ইংরেজীতে দুই ভাষায়ই বাংলাদেশ লেখা। নীচে দাড়ানো ছেলেটা আমাদের সাথে করে ওপরে নিয়ে এলো। টেবিল খালি নেই। একটু অপেক্ষা করার পর খালি হলে আমরা বসলাম। ভেতরটাও খুব অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্ন। কোন নেপকিন নেই। কাউন্টারের পাশে বড় গোল টিস্যুর রোল। আমাদের নিউইয়র্কে দোকানের বাথরুমে যেমন থাকে। নেপকিন চাইতেই বড় রোল থেকে ছিড়ে কয়েকটুকরা সামনে এনে রাখলো। যা হোক খাবারের অর্ডার দিলাম। বিভিন্ন রকমের ভর্তা ভাজি। তারপর গরু ভুনা এবং উটের মাংস। পছন্দ করে উটের মাংস নিয়েছিলাম। ছোট ছোট টুকরো করে গরুর মাংসের মত ঝোল দিয়ে রান্না করা। আমার কাছে গরুর মাংসের মতই মনে হয়েছে। আমার সঙ্গী নিউইয়র্কের বিখ্যাত শেফ খলিল বিরিয়ানী হাউজের স্বত্ত্বাধিকারী খলিল ভাই ছিলেন। এক একটা তরকারী তার কাছে নিলে তিনি তা সাথে সাথে নাকচ করে দেন। বল্লাম, এখানের শেফরা তো আপনার মত নিউইয়র্কের বিখ্যাত কুলিনারি ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে আসেনি। তাই রান্নার মান খুঁজবেন না। খেয়ে নিন। তিনি মৃদু হেসে খাওয়া শুরু করলেন। বুঝলাম ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য সবাই খেলেও কারো তৃপ্তি হয়নি। খাওয়া শেষে চা দিতে বল্লাম। দুধ, তেজপাতা এলাচ মিশিয়ে মজাদার মশলা চা খাওয়ার কষ্ট ভুলিয়ে দিলো।
আমাদের আগেই খলিল ভাই নীচে নেমে গেলন। হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম তিনি একটা দোকানের সামনে অপেক্ষা করছেন। বললেন, আমি জানি সবারই পেটের কিছু অংশ খালি রয়ে গেছে। আমি খাঁটি আখের রস খাইয়ে সে অংশটুকু পূরণ করে দেবো। খলিল ভাই সবার জন্য আখের রস অর্ডার দিলেন। আস্ত আখ মেশিনে ঢুকিয়ে রস বের করে আইস মিশিয়ে সবাইকে পরিবেশন করল দোকানি। সবাই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে রওয়ানা দিলাম হোটেলের দিকে।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

নবীর স্মৃতি আর সৌন্দর্য্যরে শহর তায়েফ

তায়েফের বণি সাকিফ গোত্রের বিবি হালিমার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন শিশু নবী (সা:)। এই শহরের একটি পাহাড়ে তিনি ছাগল চড়াতেন। তায়েফ-কে বলা হয় ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সৌদী বাদশা ফয়সল এবং বা বাদশা খালেদের আমলে শীতকালীন রাজধানীর মর্যাদা পায় তায়েফ। রবি শস্য ও ফলফলাদি বিশেষ করে আঙ্গুরের জন্য তায়েফ বিখ্যাত। তায়েফে উৎপাদিত শাকসবজি সমগ্র সৌদি আরবের চাহিদার ৩০ ভাগ পূরণ করে থাকে।

 

সুন্দর এবং মনোরম শহর তায়েফ। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের শহর তায়েফ। চমৎকার একটি সাজানো-গুছানো শহর। চারদিকে সবুজের হাতছানি। ক্ষেত ভরা ফসল, খেজুর গাছের ঘন বন। আর এই শহরবাসীর প্রস্তর আঘাতেই আমাদের প্রিয় নবীজীর (সা:) শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলো। তাঁর উপর চালিয়েছিলো নানা নির্যাতন। এছাড়াও নানা কারণে ইতিহাসে তায়েফ শহরটি আলোচিত। এই তায়েফের বণি সাকিফ গোত্রের বিবি হালিমার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন শিশু নবী (সা:)। এই শহরের একটি পাহাড়ে তিনি ছাগল চড়াতেন। তায়েফ-কে বলা হয় ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সৌদী বাদশা ফয়সল এবং বা বাদশা খালেদের আমলে শীতকালীন রাজধানীর মর্যাদা পায় তায়েফ। রবি শস্য ও ফলফলাদি বিশেষ করে আঙ্গুরের জন্য তায়েফ বিখ্যাত। তায়েফে উৎপাদিত শাকসবজি সমগ্র সৌদি আরবের চাহিদার ৩০ ভাগ পূরণ করে থাকে।
এসব নানা কারণে তায়েফ শহরটি দেখার শখ ছিলো বহুদিনের। তাই এবার আমার সৌদি আরব ভ্রমণের সময় মক্কা-মদিনার পাশাপাশি তায়েফ শহরটিও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। গত দু’দিন আমি বাংলাদেশী গাড়ী চালক জসিমের সাথে পবিত্র মক্কা নগরীর আশেপাশে ঘুরে বেরিয়েছি। তার সাথে আমার চুক্তি হয়েছিলো আজ সে আমাকে তায়েফ নিয়ে যাবে। কথামতো সকাল ৮টায় সে আমাকে তুলে নিলো হোটেল থেকে।
গাড়ী চলছে পাহাড় ঘেষা আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে গভীর খাদ। এসব পাহাড়ী পথে চলাচলের অভিজ্ঞতা আমার অনেক। ভারতের দার্জেলিং, সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালা, স্পেনের পাহাড়ীগ্রাম রুপিত সহ এমনি অনেক পাহাড়ী এলাকা ভ্রমণ করেছি। তাই উঁচু পাহাড়-কে সঙ্গী করে আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলা আমার জন্য সমস্যা হচ্ছিলো না।
জসিম জানালো, তায়েফের রাস্তার আশেপাশে গড়ে উঠেছে অনেক অবকাশ কেন্দ্র। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে ক্যাবল কার। পর্যটকরা এসব ক্যাবল কারে চরে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। পাহাড়ী রাস্থায় ঘুরে ঘুরে গাড়ী উপরে উঠছিলো। মূল শহরের কাছাকাছি পৌঁছতেই গাড়ী গো গো করে থেমে গেলো। জসিম বেরিয়ে গিয়ে বনেটটা উঠিয়ে দেখলো ইঞ্জিনটা গরম হয়ে গেছে। আধা ঘন্টার মতো বিশ্রাম নিতে হবে। ইঞ্জিনটা একটু ঠান্ডা হলে আবার রওনা দেবো।
গাড়ী থেকে নেমেই দেখলাম। অল্প দূরেই রাস্তার পাশে সারি সারি ফলের দোকান। আমি এগিয়ে গেলাম। পরে জেনেছিলাম জায়গাটির নাম ওকাজ। দেখলাম প্রতিটি দোকানেই বাংলাদেশী কর্মচারী। তারা গল্প গুজবে মত্ত। আঙ্গুর কমলা ছাড়াও বাংলাদেশী বড়ই, বড় বড় কলা, ডালিম, শরিফা সহ নানা পরিচিত ফল চোখে পড়ছিলো। ডালিমের খোঁসা ছাড়িয়ে রসে ভরা দানাগুলো প্যাকেট করে রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য। লোভ সামলাতে না পেরে দুই প্যাকেট কিনলাম। একজন বাংলাদেশী কিছু আঙ্গুর প্যাকেট করে দিয়ে বললেন- ‘গাড়ীতে বসে খাবেন। তায়েফের আঙ্গুর খুব মিষ্টি।’ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ীর কাছে এসে দেখলাম তখনো ইঞ্জিনের মর্জি ভালো হয়নি। জসিম জানালো- আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন উটওয়ালা এলো। রকমারী সাজে সজ্জিত উটটি। পর্যটকরা উটের উপর উঠে ছবি তোলে আর আশপাশের এলাকা ঘুরে বেড়ায়। আমিও দরদাম করে আধা ঘন্টার জন্য একটি উট ভাড়া করলাম।
পাহাড়ী রাস্তায় চলার সময় দেখলাম কোথাও উট আবার কোথাও দুম্বার সারি। ব্যবসায়ীরা উটে করে মাল পরিবহণ করছে। অনেক বানরও চোখে পড়লো রাস্তার পাশে। পথচারীরা পাশের দোকান থেকে কলা কিনে এনে তাদের খাওয়াচ্ছে। উট ভ্রমণ শেষ করে গাড়ীর কাছে আসতেই জসিম জানালো- গাড়ী রেডি। এরপর অল্প সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম তায়েফ শহরের প্রাণ কেন্দ্রে। মক্কা থেকে ১২০ কিলোমিটার তূরত্বে তায়েফ শহরে পাহাড়ী পথে সময় লেগেছে দেড় ঘন্টার মতো। শহরটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত।
জসিম প্রথমে আমাকে নিয়ে গেলো বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:) এর মাজারে। মাজারটি চারদিকে দেয়ার দিয়ে বেষ্টন করা। খাদেম জানালো- বেষ্টনীর ভিতর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:) সহ আরো বেশ কয়েকজন সাহাবীর কবর রয়েছে। মাজারের কাছে যাওয়া অথবা কবর স্পর্শ করা সৌদি সরকার বেদাত বলে মনে করে। তাই কবরের চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। দেয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করে চলে এলাম পাশের মসজিদে। এটা তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ। এর নামকরণ করা হয়েছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:)-এর নামে। এটা মসজিদে ইবনে আব্বাস নামে পরিচিত। মসজিদের পাশে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। এতে আছে অনেক মুল্যবান কিতাব-এর সংগ্রহ। আছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:)-এর হাতে লেখা পবিত্র কোরআনের কপি সহ বিভিন্ন সময়ে পাথর ও কাগজে লিখিত পবিত্র কোরআনের প্রাচীন কপি।
এরপর আমরা এলাম ওয়াদি মিটনা নামক একটি স্থানে। পথভ্রষ্ট কিছু তায়েফবাসী এখানেই রসুল (সা:) এবং তাঁর পালিত পুত্র হারেসা বিন জায়েদকে পাথর ছুড়ে রক্তাক্ত করে। এই নিপীড়নের স্থানটি দেখে অজান্তেই চোখ অশ্রসজল হয়ে উঠে। এক বর্ণনায় আছে- তায়েফবাসীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে রক্তাক্ত রাসুল (সা:) ওয়াদি মিটনার পাশে এক আঙ্গুর বাগানে আশ্রয় নেন। তখন সেখানে ফেরেস্তা জিবরাইল এসে বলেন- হে আল্লাহর রাসুল (সা:) মহান আল্লাহপাক আপনার প্রতি তায়েফবাসীর অত্যাচার দেখেছেন। এই পাহাড়ের রক্ষক ফেরেস্তারা আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছেন। আপনি যা বলবেন, তারা তাই করবেন। আপনি হুকুম দিনে দুই পাশের পাহাড় একত্রিত করে তায়েফবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে। এই কথা শুনার পর পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত মহামানব ফরিয়াদ করে বলেন, হে আল্লাহ! এরা বুঝে না। এরা যদি ধ্বংস হয়ে যায়, আমি কাদের কাছে তোমার বাণী প্রচার করবো! ঐতিহাসিকরা বলেন- এই দোয়া পৃথিবীর মহামানবদের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ আবেদন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এখানে কারো বিরুদ্ধে বিদ্বেষ কিংবা অভিযোগ তুলে ধরা হয়নি। কারো ধ্বংস কামনা না করে ক্ষমার মহত্ত দেখানো হয়েছে।
জসিমের আহ্বানে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। কেনো জানি বার বার ১৪০০ বছরের আগেকার এই ঘটনাটি মনে পড়ে হৃদয়কে পীড়া দিচ্ছিলো। গাড়ী এসে থামলো একটি পাহাড়ের ঢালে। আমাদের একটু হেঁটে উপরে উঠতে হবে। এখানেই ছিলো সেই বুড়ির বাড়ী। যে কিনা রাসুল (সা:) এর পথের উপর কাঁটা বিছিয়ে রাখতো। ছোট ছোট দুটি কক্ষ নিয়ে পাথরের তৈরী একটি ঘর। আমরা সেখানে ছবি তুলে আবার গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। এরপর গাড়ী এসে থামলো হযরত আলী (রা:) মসজিদের সামনে। একটি মিনার সহ ছোট একটি মসজিদ। যেখানে ১০/১২জন মুসল্লী নামাজ পড়তে পারেন। জানা যায়, হযরত আলী (রা:)-এর খেলাফতকালে তিনি এই মসজিদে বসে জনগণের অভাব-অভিযোগ শুনতেন এবং খেলাফত পরিচালনা করতেন।
এবার আমাদের মক্কা ফিরে যাওয়ার পালা। আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য মিকাত জিল মাহরাম। এখানে গিয়ে গোসল বা অজু করে এহরাম পড়ে মক্কায় গিয়ে ওমরাহ করতে হবে। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী কাজ করছেন। তারাই অজু এবং গোসলখানার স্থান দেখিয়ে দিলেন। গোসল করে এহরামের কাপড় পরিধান করে মসজিদে দুই রাকাত নামাজ পড়ে জসিমের সাথে রওনা হলাম মক্কার পথে।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

আরাফাতের মাঠ-একটি নাম একটি ইতিহাস

আরাফাত শব্দটি আরবী। এর অর্থ জানা, চেনা, পরিচয় ইত্যাদি। আরাফাত ময়দানের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে বেশী যে মতবাদটি প্রচলিত তা হলো- বেহেস্ত থেকে পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর বাবা আদম ও মা হাওয়া পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা একে অপরকে খুঁজতে খুঁজতে এসে এই প্রান্তরে এসে মিলিত হন। এজন্য এর অন্য নাম আরাফাত বা মিলনস্থল।

আরাফাতের মাঠে দর্শনার্থীদের জন্য বাংলায় নির্দেশনা
আরাফাতের মাঠে দর্শনার্থীদের জন্য বাংলায় নির্দেশনা

আজ আমরা এসেছি ঐতিহাসিক আরাফাত প্রান্তরে। এই জায়গাটি মক্কা নগরী থেকে ২২ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর পূর্ব প্রান্ত তায়েফের সুউচ্চ পর্বতমালায় ঘেরা। বছরে মাত্র একদিন ৯ জিলহজ্জ হাজী সাহেবানরা হজ্বের সর্বপ্রধান অনুষ্ঠানে এখানে এসে সমবেত হন। আরাফাত ময়দানটি ১০ দশমিক ৪ কিলোমিটার বিস্তৃত। ময়দানটি তিনদিক দিয়ে পাহাড় বেস্টিত। এর দক্ষিণ পাশ দিয়ে রয়েছে মক্কা, হাদাহ তায়েফ রিং রোড। সড়কের দক্ষিণ পাশে সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উম্মুল কুরআ বিশ্ববিদ্যালয়। এই আরাফাতের মাঠে হাজী সাহেবগণ মধ্যাহ্নের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। সেদিন তাদের পরনে থাকে দুই প্রস্থ সেলাইবিহীন পোশাক। মুখে লাব্বায়েক ধ্বনি। আকুল হৃদয়ে সেদিন তারা রাব্বুল আলামিন-কে বলেন- আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোন শরীক নেই। সব প্রশংসা এবং নিয়ামত তোমার-ই এবং সব সা¤্রাজ্যই তোমার।
আরাফাত শব্দটি আরবী। এর অর্থ জানা, চেনা, পরিচয় ইত্যাদি। আরাফাত ময়দানের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে বেশী যে মতবাদটি প্রচলিত তা হলো- বেহেস্ত থেকে পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর বাবা আদম ও মা হাওয়া পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা একে অপরকে খুঁজতে খুঁজতে এসে এই প্রান্তরে এসে মিলিত হন। এজন্য এর অন্য নাম আরাফাত বা মিলনস্থল। অন্য একটি মতে আরাফাত শব্দটি আরাফ ধাতু থেকে এসেছে। এর অর্থ সুগন্ধি। কারণ আরাফাত প্রান্তর খোলামেলা এবং সুঘ্রানে ভরপুর। অপরদিকে মিনা হলো সেই জায়গা যেখানে ময়লা আবর্জনা ও কোরবানীর পশুর রক্ত জমা হয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ বলেছেন- যখন কোন ব্যক্তি ধৈর্যশীল ও আল্লাহ ভীরু হয় তখন তাকে বলা হয় আরেফ, ধৈর্য্যশীল ও আল্লাহ ভীড়– ব্যক্তি। ৯ জিলহজ্ব জোহরের পরে প্রচন্ড রৌদ্র তাপের মধ্যে হাজী সাহেবানরা যখন এই মাঠে তাবুর মাঝে অপেক্ষা করেন তখন তারা দু:খ-কষ্ট ও অসুবিধাসমূহ পরম ধৈর্য্যরে সাথে মোকাবেলা করেন। এখানে তারা অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল, ন¤্র, বিনয় ও আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এইজন্য দিনটিকে আরাফা এবং প্রান্তটিকে আরাফাত বলা হয়।
প্রান্তরটির নামকরণ নিয়ে আরেকটি মতবাদ রয়েছে তাহলো- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মোমিন মুসলমানগণ একে অপরকে খুঁজতে থাকেন। এজন্য এই প্রান্তরটিকে আরাফাত প্রান্তর বলে আখ্যায়িত করা হয়। অন্য একটি বর্ণনায় আছে- এই ময়দানে জিবরাইল (আ:) হযরত ইব্রাহীম (সা:)-কে হজ্বের বিধিবিধান শিক্ষা দেয়ার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন- হাল আরাফতা। অর্থাৎ আপনি কি বুঝতে পেরেছেন। হযরত ইব্ররাইম (আ:) বলেন হাঁ। এরপর থেকেই এই ময়দানের নাম হয়েছে আরাফা। এই আরাফাতে উপস্থিত না হলে জ্ব পূর্ণ হবে না। তাই হজ্বে এসে যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন তাদেরও অ্যাম্বুলেন্স করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হয় স্বল্প সময়ের জন্য।
এই ময়দানে এসে বারবার শিহরিত হচ্ছিলাম। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে কিশোর বয়সে মায়ের হাত ধরে এই আরাফাতের মাঠে এসেছিলাম। অদেখা পৃথিবীর এক আনন্দ খুঁজছিলো সেদিন আমার চোখ। আজ পরিণত বয়সে এসে নতুন করে যেনো সব আবিষ্কার করছিলাম। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে এই ময়দানে রাসুল (সা:) লক্ষাধিক সাহাবীকে সামনে রেখে বিদায় হজ্বের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ময়দানেই ইসলামের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে কোরআনের আয়াত নাজিল হয়েছিলো।
এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে এলাম জাবালে রহমতে। জাবাল অর্থ পাহাড়। জাবালে রহমত হলো রহমতের পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে একটি সাইনবোর্ডে বিভিন্ন ভাষায় দিক নির্দেশনা রয়েছে। কি করা যাবে বা কি করা যাবে না, দর্শনাথীরা যেনো বেদাতে অংশ না নেন তার নির্দেশনা। বাংলা-তেও এই সাইনবোর্ড দেখে ভালো লাগলো। পাহাড়ে উঠার জন্য সিঁড়ি তৈরী করা হয়েছে। সিঁড়িগুলো বেশ প্রশস্থ। পাহাড়ের উপরে একটি সাদা রং এর পিলার। আরাফাতের মাঠের চারিদিকে যেহেতু পহাড় তাই জাবালে রহমত চিহ্নিত করার জন্য এই পিলার তৈরী করা হয়েছে। এই পাহাড়ের পাদদেশে রাসুল (সা:) হজের খুৎবা ও বিদায় হজ্বের ভাষণ দিয়েছিলেন। জাবালে রহমতের আশেপাশে প্রচুর পুলিশের দেখা পেলাম। তারা দর্শনার্থীদের নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। যেনো পিলারটি জড়িয়ে না ধরেন, পিলারে যেনো চুমু না খান ইত্যাদি। রহমতের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য, স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সর্বপরি দেশের জন্য দোয়া করে নীচে নেমে এলাম।
মক্কায় আমার গাইড হিসেবে কাজ করেন সিলেটের তারিফ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করেন এবং জিয়ারতের কাজ করেন। তিনি যেসব জায়গা চিনেন তা গতানুগতিক। আমি যতবার যাই হোম ওয়ার্ক করে তাকে নিত্য-নতুন জায়গার হদিস দিতে বলি। তিনি তা খুঁজে বের করে রাখেন এবং পরের বার এলে আমাকে সেখানে নিয়ে যান। গতবার এসে তার কাছে নহরে জোবায়দার খোঁজ জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এটা তার জানা না থাকায় বলেছিলেন- তিনি খুঁজে রাখবেন এবং পরেরবার নিয়ে যাবেন। এবার আরাফাতের মাঠে আসলে তিনি জানান যে, নহরে জোবায়দার খোঁজ তিনি পেয়েছেন এবং আরাফাত মাঠের এক পাশে এখনো তার চিহ্ন রয়েছে। জাবালে রহমত দেখা শেষ করে তার সাথে আমরা নহরে জোবায়দা দেখতে গেলাম।
নহরে জোবায়দা নিয়ে একটি কাহিনী রয়েছে। বেগম জোবায়দা ছিলেন বাগদাদের খলিফা হারুন-অর রশীদের স্ত্রী। একদিন রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য লোক এসে তার সাথে দৈহিক মিলন করে পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এই স্বপ্ন দেখে তিনি ঘৃণা, লজ্জা এবং চিন্তায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি তার বিশ্বস্ত বাদীকে সা¤্রাজ্যের প্রধান কাজীর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে পাঠালেন। বাদী বেগম জোবায়দার আদেশ অনুযায়ী স্বপ্নটি নিজে দেখেছে বলে উল্লেখ করে। কাজী সাহেব তখন তাকে বললেন- এই স্বপ্নটি তুমি কখনো দেখতে পারো না। যে দেখেছে তার নাম বলো, নাহলে এর ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না। অগত্যা বাদী ফিরে গিয়ে বেগম সাহেবার অনুমতি নিয়ে এসে তার নাম জানালেন। অতপর কাজী সাহেব বললেন যে, বেগম সাহেবা দ্বারা এমন একটি মহৎ কাজ সাধিত হবে যা দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের লোক উপকৃত হবেন। পরবর্তীকালে বেগম জোবায়দা হজ্বের সময় হাজীদের কষ্ট দূর করার জন্য মক্কা শরীফ থেকে মদিনা শরীফ পর্যন্ত বিরাট একটি খাল খনন করে দিয়েছিলেন যা নহরে জোবায়দা নামে পরিচতি ছিলো। আব্বাসীয় খেলাফত পর্যন্ত এই নহরটির অস্তিত্ব ছিলো। কালের বিবর্তনে সে নহরটি আজ আর নেই। কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে। নহরে জোবায়দার একটি অংশ রয়েছে মসজিদে নামিরার পাশে। কিছু অংশ আরাফাত প্রান্তরে। আমরা তারিফের সাথে নহরে জোবায়দার কিছু অংশ দেখে আবার বাসের কাছে ফিরে এলাম।

 

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

মক্কার স্মৃতিময় স্থান

মক্কায় মসজিদে নামিরা
মক্কায় মসজিদে নামিরা

বিশ্ব মুসলিমের মহা সম্মিলন এবং অসখ্য নবী ও রাসুল (সা:)-দের স্মৃতি বিজরিত আরাফাতের ময়দান ছেড়ে যেতে মন চাচ্ছিলো না। তারপরও যেতে হয়। তালিকার দর্শণীয় অনেক স্থান তখনো দেখার বাকী। তাই আস্তে আস্তে গিয়ে তারিফের গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। এক পর্যায়ে গাড়ী এসে থামলো আরাফাত ময়দানের শেষ সীমানায় মসজিদে নামিরার সামনে।
হজ্ব করতে আসা প্রত্যেকের কাছে মসজিদে নামিরা একটি পরিচিত নাম। আরাফা ময়দানের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত এই মসজিদ থেকেই হজ্বের খুৎবা দেয়া হয়। মসজিদের পশ্চিম পাশে ছোট একটি পাহাড় রয়েছে। যার নাম নামিরা। এই পাহাড়ের নামানুসারেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে। মসজিদে নামিরার আয়তন ১ লাখ ১০ হাজার বর্গমিটার। এখানে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। হজ্বের সময় ছাড়া বছরের অন্য সময় এই এলাকায় শুধু দর্শনার্থী ছাড়া স্থানীয় কেউ থাকে না। তাই মসজিদটি বেশীর ভাগ সময় বন্ধ থাকে।
বিদায় হজ্বের সময় এখানেই রসুল (সা:) এর তাবু স্থাপন করা হয়েছিলো। এখান থেকেই তিনি হজ্বের খুৎবা প্রদান এবং নামাজে ইমামতি করেন। যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে হজ্বের খুৎবা প্রদান এবং ইমামতি করেন ঠিক সেই জায়গাতেই হিজরীর দ্বিতীয় শতকে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানেও এই মসজিদ থেকে হজ্বের খুৎবা দেয়া হয়। স্থানীয় সময় অনুসারে সাধারণত: খুৎবা শুরু হয় দুপুর ১২টা ১৬ মিনিটে এবং শেষ হয় ১টা ১৬ মিনিটে। সৌদী আরবের রাজকীয় মুফতি এই খুৎবা প্রদান করে থাকেন। হজ্বের খুৎবা শেষে এখান থেকেই জোহরের আজান হয় এবং একই আজানে দুই একামতে জোহর ও আসরের কসর দুই রাকাত নামাজ আদায় করা হয়। এই স্থানেই ফেরেস্তা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-কে হজ্বের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিয়েছিলেন। মসজিদে নামিরা খুবই দৃষ্টি নন্দন। এটাতে রয়েছে ৬০ মিটার উচু ছয়টি মিনার, তিনটি গুম্ভুজ, ১০টি প্রধান প্রবেশদ্বার এবং ৬৪টি দরজা। এই মসজিদটির কাছেই রয়েছে জাবালে রহমত হাসপাতাল। যেখানে আরাফাতের দিনে অসুস্থ হাজীদের জরুরী স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়।
আমরা যখন মসজিদে নামিরার কাছে গিয়ে নামলাম তখন এটি বন্ধ ছিলো। মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে মুনাজাত করে আবার গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। একটু পড়ে গাড়ী এসে থামলো মসজিদে খায়েফের সামনে। এই জায়গাটি মিনায় অবস্থিত এবং মক্কা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে। সওর পাহাড়ের বিপরীত দিকে পাহাড়ের অদূরে অবস্থিত এই মসজিদের উচু মিনারগুলো দূর থেকেই চোখে পড়ে। পাহাড়ের চেয়ে নীচে এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উঁচু স্থান-কে আরবী পরিভাষায় খায়েফ বলা হয়। আবার দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যাকাসম ভূমিকেও খায়েফ বলে আরবরা। জানা যায় নবী করীম (সা:) এখানে ৭০জন নবী নামাজ আদায় করেছেন এবং তাঁরা এখানেই সমাহিত। এই মসজিদে ৩০ হাজার মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটির চারকোনায় ৪টি সুউচ্চ মিনার এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। মসজিদের সামনে স্থাপিত সাইনবোর্ডে অনেকগুলো ভাষায় মসজিদের নাম লেখা রয়েছে। এরমধ্যে বাংলা ভাষাও একটি।
এরপর আমরা এলাম আরো একটি ঐতিহাসিক স্থান মুজদালিফায়। এর অর্থ মিলিত হওয়া, কাছে আসা, নৈকট্য হাসিল করা ইত্যাদি। স্থানটি আরাফাত ও মিনার মাঝামাঝিতে অবস্থিত একটি উপত্যকা। আদি পিতা হযরত আদম (আ:) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়া (আ:) এর আরাফাত প্রান্তরে প্রথম সাক্ষাতের পর তারা মুজদালিফাতে রাত্রি যাপন করেন। ৯ জিলহজ্ব সূর্যাস্তের পর হাজী সাহেবানরা আরাফাতের মাঠ থেকে এই মুজদালিফায় আগমন করেন এবং এখানে এসে এশার ওয়াক্তে মাগরিব ও এশার নামাজ পর পর একত্রে আদায় করেন। ইসলামী সাম্যের সবচেয়ে সেরা দৃষ্টান্ত এই মুজদালিফা। নীচে খালি মাঠ, উপরে খোলা আকাশ, খালি মাথা, খোলা পা, কাফনের কাপড় পরিহিত সাম্যের এরচেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। এখান থেকে বুটের দানার আকার পাথর সংগ্রহ করে পরদিন মিনায় গিয়ে শয়তানকে মারতে হয়।
হজ্বের সময় যেসব স্থানে যেতে হয় আমরা তারিফের সাথে সেই জায়গাগুলোই ভ্রমণ করছিলাম। আরাফাত, মুজদালিফার পর আমরা এলাম মিনায়। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। এর আয়তন ২০ বর্গ কিলোমিটার। হজ্বের সময় ১১ ও ১২ জিলহজ্ব হাজী সাহেবানরা এখানে অবস্থান করেন এবং প্রতিদিন তিনটি শয়তানের প্রতীক স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করেন। হজ্বের প্রধান করনীয় বিষয়গুলো পালন করতে হয় আরাফাত মুজদালিফায় এবং মিনায়। অন্য দুটি স্থানের মতো এই মিনারও ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) স্বপ্নে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কোরবানী করার জন্য আদিষ্ট হয়ে প্রিয়তম পুত্র নবী হযরত ইসমাইল (আ:)-কে কোরবানী করার সিদ্ধান্ত নেন। পুত্রকে নিয়ে তিনি এই মিনায় পৌছে শয়তান তিন স্থানে তাদের আল্লাহর হুকুম পালন করা থেকে নিবৃত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। এমন অবস্থায় তারা পাথর মেরে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন। তারপর এই মিনার-ই এক স্থানে পুত্র ইসমাইল (আ:)-এর গলায় ছুড়ি চালিয়ে দিলে আল্লাহর তরফ থেকে তা করতে নিষেধ করা হয়। এবং এটা যে পরীক্ষা ছিলো তা ঘোষিত হয়। এরপর পুত্রের পরিবর্তে একটি বেহেস্তী দুম্বা কোরবানী দেন হযরত ইব্রাহীম (আ:)। পিতা-পুত্রের সেই ত্যাগের ঘটনা স্মরণে প্রতি বছর হাজীরা মিনায় পাথর নিক্ষেপ ও কোরবানী করে থাকেন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) নবী হযরত ইসমাইল (আ:)-কে যে স্থানে কোরবানী করতে চেয়েছিলেন, সে জায়গাটি চিহ্নিত থাকলেও চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া থাকায় কাছে যাওয়া হয়নি। মিনায় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীর সাক্ষাৎ পেলাম, যারা এখানে কাজ করেন। প্রচন্ড রৌদ্রে পুড়ে তাদের চেহারা ছাই বর্ণ ধারণ করে আসে দেখে খুবই কষ্ট লাগলো।
মিনা থেকে আমরা এলাম মসজিদে জ্বীন দেখতে। এটিও একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে জ্বীনরা এখানে রাসুল (সা:)-এর কাছে ইমান এনেছিলো। এই মসজিদটি মসজিদে জীন নামে পরিচিত। ইতিহাসে আছে একদিন এখানে মহানবী (সা:) নামাজ আদায়কালে আকাশ পথে যাওয়ার সময় একদল জ্বীন কোরআনের অভিনবত্ত্ব ও সুমধুর সুরে আকৃষ্ট হয়ে থমকে যায় এবং এই ঘটনা তারা তাদের জাতির কাছে তুলে ধরে। অতপর তারা এই মসজিদের স্থানে এসে ঈমান এনে ইসলাম গ্রহণ করে।
মসজিদে জীন জিয়ারত শেষে আমরা এলাম জান্নাতুল মোয়াল্লা কবর স্থানে। এটি মসজিদুল হারাম থেকে অল্প দূরত্বে অবস্থিত। এখানে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর দাদা আবু মুত্তালিব, চাচা আবু তালিব, তাঁর প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজা, বড় ছেলে কাসিম, ইসলামের প্রথম শহীদ সোমাইয়া সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কবর রয়েছে। জান্নতুল মোয়াল্লা মক্কার সবচেয়ে বড় কবরস্থান। মোয়াল্লা শব্দের অর্থ হচ্ছে উঁচু। এই কবর স্থানটি একটি উঁচু স্থানে অবস্থিত বলে এটাকে মোয়াল্লা বলা হয়।
সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে সবাই ছিলাম ক্লান্ত। তাই গাইড তারিফ-কে বললাম সেদিনের মতো জিয়ারতে বিরতি দিয়ে হোটেলে পৌছে দিতে।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

অনিন্দ সৌন্দর্যের মক্কা

ক’দিনের ইউরোপ সফরে শরীর ও মন ক্লান্তিতে অবসন্ন ছিলো। তাই মক্কায় হোটেলের বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই হারিয়ে গেলাম ঘুমের গভীরে। এক সময় ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি বেলা ১০টা বাজতে চলেছে। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে রওনা দিলাম রেষ্টুরেন্টের দিকে। বিদেশ যাত্রার সময় যখনই হোটেল বুকিং দেই সাথে ব্রেকফাস্ট অন্তর্ভূক্ত রাখি। এতে খরচ একটু বেশী হলেও সময় বাঁচে। তবে হোটেলের ব্রেকফাস্ট খেতে হলে সময়মতো হাজিরা দিতে হয়।
৫টি ভবন নিয়ে আমার বিশাল হোটেলটিতে ৪৭৬টি ডিপ্লোমেটিক রুম, ১২০টি এক্সিকিউটিভ স্যুট, ৬০টি রয়েল স্যুট, একেকটা ভবনে একেক ধরনের রেষ্টুরেন্ট। কোনটা এশিয়ান, কোনটা মরোক্কান, কোনটায় বা মধ্যপ্রাচীয় দেশের খাবার। রুম থেকে বেরিয়েই সাইন চোখে পড়লো এশিয়ান রেষ্টুরেন্টের। সময় থাকলে হয়তো খুঁজে পেতে অন্য দেশীয় খাবারের স্বাদ নিতাম। কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য খোঁজাখুঁজিতে না গিয়ে এশিয়ান রেষ্টুরেন্টেই রওনা হলাম। রেষ্টুরেন্ট এখনো খোলা আছে কিনা জানতে চাইলে একজন ওয়েটার খাটি বাংলায় জবাব দিলো সমস্যা নেই। তারা আমাকে বুফে খাবার দেখিয়ে দিলো। বিশাল আয়োজন। রেষ্টুরেন্টে বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, ভারতীয় এবং বার্মার সব স্টাফ। এই শিফটের ম্যানেজার একজন পাকিস্তানী। কিচেনেও কয়েকজন বাংলাদেশী কাজ করেন। বুফের বাইরে কিচেন থেকে বিশেষ কোন খাবার বানিয়ে আনবে কিনা জানতে চাইলে আমি তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিলাম হেরেম শরীফের দিকে।
হোটেলের শ্যাটল প্রতি ১৫ মিনিট পরপর হেরেম শরীফের দিকে ছেড়ে যায়। আমি উঠতে না উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো। যাত্রীদের প্রায় সবাই এহরাম পড়া, মুখে তালবিয়া (লাব্বায়েল আল্লাহুমা লাব্বায়েক…….)। অল্পক্ষণেই পৌছে গেলাম হেরেম শরীফের গেটে। এক্সেলেটর দিয়ে একটু উপরে উঠলেই হেরেম শরীফ চত্ত্বর। তারপর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই পবিত্র কাবা শরীফ। সারা দুনিয়ার মুসলামানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান এই বায়তুল্লাহ। চোখের সামনে কাবাঘর দেখে অজান্তেই দুগন্ড বেয়ে অশ্রু নেমে এলো। আমি কি সৌভাগ্যবান! দ্বিতীয়বারের মতো এই পবিত্র ঘর জিয়ারত করার সৌভাগ্য হলো।
মক্কায় জাবালে নূরতারপর তাওয়াফ শুরু হলো। কাবা শরীফের যে কোনায় হাযরে আসওয়াদ ঠিক সেই কোনা বরাবর নীল দাগ থেকে তাওয়াফ শুরু হয় এবং কাবা ঘরের চতুরদিক ঘুরে আবার সেই নীল দাগ স্পর্শ করলে তাওয়াফ সম্পন্ন হয়। কোন সময় হাত দিয়ে পবিত্র কাবাঘর ধরে, কখনো মাকামে ইব্রাহীম ছুঁয়ে, কখনো হাযরে আসওয়াদ বা কালো পাথরকে দূর থেকে চুমু খেয়ে ৭ বার তাওয়াফ সম্পন্ন করলাম।
তাওয়াফের পর মাকামে ইব্রাহীমের পাশে দু’রাকাত নামাজ পড়ার নিয়ম। কিন্তু এতই ভীড় ছিলো যে, একটু দূরে নামাজ আদায় করে সাঈ করতে গেলাম। সাঈ হচ্ছে সাফা এবং মারুয়া পাহাড় দু’টির মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় পর্যন্ত আসা-যাওয়া করা। দু’বার যাওয়ার পর আমি আর পারছিলাম না। বয়স যে হয়েছে তা টের পাচ্ছিলাম। যাদের হাটতে অসুবিধা হয়, তাদের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে। ৭৫ রিয়াল দিয়ে একটা হুইল চেয়ার ভাড়া করে সাঈ শেষ করলাম। পরের দিন অবশ্য ৫০ রিয়ালেই হুইল চেয়ার ভাড়া পেয়েছিলাম। বুঝলাম এখানেও দরদাম চলে।
সাঈ সমাপ্ত করে চুল কেটে পেট ভরে জমজমের পানি পান করে ফিরে এলাম হোটেলে, বিকেলে জিয়ারতের জন্য বের হতে হবে। হোটেলের বাংলাদেশী রুম সার্ভিস আসাদ একজন বাংলাদেশী ড্রাইভারকে ঠিক করে দিলেন, যিনি আমাকে মক্কার আশেপাশের দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখাবেন। দেশী ভাই হিসেবে খুবই আন্তরিকভাবে আমাকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গেলেন।
বর্তমানে বায়তুল্লাহর সীমানা প্রাচীরের মধ্যেই রয়েছে আবু জেহালের বসতবাড়ী। যে বাড়িটিকে সৌদি সরকার এখন গণ টয়লেটে পরিণত করেছে। মসজিদে হারামের আনুমানিক ৫০ মিটার দূরে আব্দুল মুত্তালিবের বাড়ী। যেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা:)। বর্তমানে এই বাড়িটিকে লাইব্রেরীতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। শহরের মধ্যভাগে রয়েছে মক্কা মিউজিয়াম। যেখানে আছে আদি কাবা ঘরের নমুনা। সৌদি আরবের আদি পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রাচীন ধাতব মুদ্রা, জমজমের কুপ থেকে পানি উত্তোলনের পুরানো যন্ত্রপাতি, পুরান আমলের হাতে লেখা পবিত্র কোরআন শরীফের কপি ইত্যাদি। এরপর আমরা গেলাম জাবালে নূরের পাদদেশে। এখানেই পবিত্র কোরআন নাজেলের শুভ সূচনা শুরু হয়। সূরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াত এখানেই নাজিল হয়। ওহি নাজেল হওয়ার আগে হুজুর (সা:) এই জাবালে পাহাড়েই ধ্যানে বসতেন। বিবি খাদিজা প্রতিদিন সেখানে গিয়ে তাঁর খাবার দিয়ে আসতেন। ৫৬৫ মিটার উচ্চতার এই পাহাড়ে উঠতে সময় লাগে সোয়া ঘন্টার মতো। ভাবলে অবাক হতে হয় যে বিবি খাদিজার মতো একজন নারী প্রতিদিন কিভাবে এই পাহাড়ে আরোহণ করতেন।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য জাবালে সওর। সময়ের অভাবে উপরে উঠা হয়নি। যদিও তরুণ বয়সে হজ্ব করার সময় আমি একবার এই পাহাড়ে আরোহণ করেছিলাম। জাবালে সউর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর স্মৃতি বিজরিত স্থান। মক্কা থেকে মদিনায় হিযরতের সময় তিনি এবং হযরত আবু বকর এখানে তিনদিন অপেক্ষা করেছিলেন। শত্রুরা খুঁজতে খুঁজতে এই গুহার সামনে এসে ফিরে যায়। আল্লাহর হুকুমে এই গুহা মুখে মাকরসা জাল বুনে শত্রুদের বিভ্রান্ত করেছিলো।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আরাফা প্রান্তর।
মহানবীর (সা:) বিদায় হজের ভাষণের স্থানমক্কা শরীফ থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে এই প্রান্তরটি অবস্থিত। এবং পবিত্র বায়তুল্লাহ থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। বাবা আদম (আ:) এবং মা হাওয়ার দুনিয়াতে প্রথম মিলনের স্থান এটা। এখানেই তাদের দোয়া কবুল এবং গুনাহ মাফ হয়। হযরত ইব্রাহীম (আ:) এবং বহু নবী ও তাঁদের অনুসারীরা এই ময়দানে এসে কান্নাকাটি করেছেন। এই আরাফা মাঠের পাশেই জাবালে রহমতের অবস্থান। জাবালে রহমতের উপর দাঁড়িয়েই নবীজি তার বিদায়ী হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। হজের সময় এখানেই হাজীরা জমায়েত হন।
আরাফা মাঠের পাশেই মসজিদে নামিরা। হিজরী শতাব্দীর দ্বিতীয় মধ্যভাগে এটি নির্মিত হয়। হজের সময় ব্যতিত লোকজন এখানে খুব একটা থাকে না। তাই এই সময়টা খুব নিরব এবং সুনসান মনে হলো। আরাফার দিনে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এখানেই নামাজে ইমামতি করতেন। এরপর আমরা এলাম মসজিদে খায়েফ-এ। এটা মিনায় অবস্থিত। অধিকাংশ ইসলামী চিন্তাবীদদের মতে এই মসজিদে ৭০জন নবী নামাজ আদায় করেছেন। হজুর (সা:) এই মসজিদে বিদায়ী হজের নামাজ আদায় করেন। এরপর আমরা এলাম মসজিদে জীন পরিদর্শনে। এখানে জীনরা হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর কন্ঠে পবিত্র কোরআন শুনে ঈমান আনে। এখানেই পবিত্র কোরআনের অন্যতম সুরা জীন অবতীর্ণ হয়। মক্কা ফিরার পথে আমরা এলাম জান্নাতুল মাওয়ায়। এটা মক্কা শরীফের একটা বিখ্যাত কবর স্থান। এখানেই হাজার হাজার সাহাবী সমাহিত হয়েছেন। রাসুল (সা:) এর প্রথম বিবি হযরত খাদিজা (রা:) এর কবরও এখানেই।
আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য আল কিসওয়া ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরিতেই কাবার গিলাফ তৈরী করা হয়। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে বাদশাহ আব্দুল আজীজের নির্দেশে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

স্মৃতির শহর মক্কা

জেদ্দা লা মেরিডিয়ান হোটেলে লেখক
জেদ্দা লা মেরিডিয়ান হোটেলে লেখক

ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম নগরী মক্কা। এই শহরেই হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জন্ম। পৃথিবীর প্রথম মসজিদ কাবা এখানেই অবস্থিত। এই শহরের উপকন্ঠে জাবালে নূর পাহাড়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব কোরআন-এর প্রথম ওহি নাজিল হয়। ইসলমের বহু সমৃদ্ধ ইতিহাস ও হুজুর (সা:)-এর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহরটি ঘিরে। রয়েছে নবী করীম (সা:) প্রতি আবু জাহেলের অত্যাচারের করুণ চিত্র। কোরাইশ বংশধরদের আভিজাত্যের কাহিনী।
আমার নিজেরও অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে শহরটি ঘিরে। আজ থেকে ৪০ বছর আগে কিশোর বয়সে আমার মায়ের সাথে পরিবারের আরো ১১ সদস্যের সাথে সর্বকনিষ্ঠ আমি পবিত্র মক্কা নগরীতে হজ্ব করতে এসেছিলাম। আমার মায়ের হাত ধরেই ঘুরে বেড়িয়েছি এই শহরের পথে-ঘাটে। মা আজ বেঁচে নেই। সেদিন হজ্ব করতে আসা পরিবারের ১১ সদস্যের ৯ জনই হারিয়ে গেছেন মহাকালের ডাকে। আমার প্রিয় নবীজির শহর, আমার স্মৃতির শহর মক্কায় আবার ফিরে আসার আনন্দে শিহরিত হচ্ছি বারবার।
এবারে আমার ট্যুর ছিলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি দেশ নেদারল্যান্ডে। এর আগেও এদেশটি একবার ঘুরে এসেছি। কিন্তু সব দেখা হয়নি। তাই দ্বিতীয়বারের মতো এই দেশটিতে আমার পদার্পণ। রাজধানী আমটাস্টারডাম এবং ফুলের দেশ হিসেবে পরিচিত হল্যান্ড ভ্রমণ শেষে এবার আমার গন্তব্য পবিত্র মক্কা, মদিনা এবং তায়েফ।
মাত্র গত মাসেই সৌদী সরকার তার দেশের অর্থনীতিকে সমুন্নত করতে এক যুগান্তকারী ঘোষণা দিয়েছে। প্রথমবারের মতো চালু করেছে ট্যুরিষ্ট ভিসা। ফলে যেকোন ধর্মের মানুষ দেশটি ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। বিদেশী পর্যটকরা সেখানকার ইউনেস্কো ঘোষিত ৫টি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটও ঘুরে দেখার সুযোগ পাবেন।
আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বাংলা ট্যুর যেহেতু বিশ্বের ৫টি মহাদেশে গাইডেড ট্যুর অপারেট করে, তাই সৌদী সরকারের এই ঘোষণায় আগ্রহান্বিত হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এখানে আসা। তবে কাবা ঘর জিয়ারত, ওমরাহ পালন এবং নবীর (সা:) রওজায় সালাম পৌছানো অন্যতম আকর্ষণ ছিলো। পাশাপাশি মক্কা ও মদিনার বাইরেও অন্যান্য শহর দেখার প্রোগ্রামও আমার এবারের ভ্রমণে অন্তর্ভূক্ত ছিলো।
সৌদী আরব ভ্রমণে এবার আমার বাহন ছিলো ইজিপ্ট এয়ার। নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে সোজা মিশরের রাজধানী কায়রো। তারপর ওখান থেকে জেদ্দা। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকান মুসলিম দেশের অনেক এয়ারলাইন্সে ভ্রমণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু কেনো জানি আমার কাছে ইজিপ্ট এয়ার-কেই অন্য এয়ারলাইন্সের চেয়ে ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে। বিশেষ করে তাদের পরিশেষিত খাবারের স্বাদ আমার কাছে অনন্য মনে হয়। গেলোবার ইজিপ্ট এয়ারে ভ্রমণের সময় তাদের পরিবেশিত গরুর মাংসের স্বাদ আজো যেনো আমার জিভে লেগে আছে।
কায়রো এয়ারপোর্টে নেমে তাদের ট্রানজিট লাউঞ্জে কতক্ষণ অপেক্ষা করলাম। বিমানের একজন কর্মকর্তা আমাদের সাথে নিয়ে অন্য একটি টার্মিনালে নিয়ে এলেন, যেখান থেকে জেদ্দার বিমান ছাড়বে। সেই টার্মিনালে গিয়ে হজ্ব বা ওমরাহ’র একটা আবহ পেলাম। কাবা শরিফ এবং রসুল (সা:) -এর রওজা মোবারকের ছবি দেয়ালে দেয়ালে। ওজু গোছল করে এহরাম পরার সুব্যবস্থা রয়েছে।
কায়রো থেকে জেদ্দার দূরত্ব খুবই কম। মাত্র দু ঘন্টার ফ্লাইট। বিমান আকাশে উড্ডয়নের পরেই ডিনার পরিবেশন করলো। তারপর একে একে আসতে থাকলো কেক, কফি, চা। একেবারে বিমান জেদ্দা বন্দরে না নামা পর্যন্ত খাবার আসতেই লাগলো। একেবারে যেনো জামাই আদর।
এয়ারপোর্টে আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশী বিলম্ব হলো না। সম্ভবত আমেরিকান পার্সপোর্টও এর অন্যতম বড় কারণ। ইমেগ্রেশন পেরিয়ে ট্যাক্সি কাউন্টারে গেলাম। এরপোর্টের ভেতরে ট্যাক্সি কাউন্টার থেকে ট্যাক্সি নিতেই আমি সবসময় স্বাচ্ছন্দবোধ করি। তা যে দেশেই যাই না কেনো। কারণ গাড়ীতে কিছু রেখে গেলে বা ড্রাইভার কোন সমস্যা করলে কর্তৃপক্ষকে সহজেই খুঁজে বের করা যায়।
কাউন্টারের কাছাকাছি ঢুকতেই বেশ কয়েকজন ঘিরে ধরলো। এদের থেকে একজনকে বেছে নিয়ে আমার হোটেলের ঠিকানা দেখালাম। কাবাঘর সংলগ্ন হোটেল ‘লা মেরেডিয়ান’। ঠিকানা দেখে বললো ৯০ রিয়াল দিতে হবে। আমি দামাদামি না করে তাতেই রাজি হলাম। সৌদী ৯০ রিয়াল আমেরিকার ডলারে ২২ ডলারের মতো। আমস্টারডামে আমার হোটেল থেকে এয়ারপোর্টে আসতে ভাড়া দিতে হয়েছে ৭০ ইউরো। যা প্রায় ৭৮ ইউএস ডলারের সমমান। সেই হিসেবে জেদ্দা থেকে মক্কার ভাড়া এর চার ভাগের এক ভাগ।
মক্কাকাউন্টারের লোকটি আমাকে ট্যাক্সির কাছে এনে একজন ড্রাইভারের কাছে বুঝিয়ে দিলো। আরবীতে তাকে ঠিকানাও বলে দিলো। গাড়ী ছুটে চললো মক্কার দিকে। চুপচুপ এক মনে গাড়ী চালাচ্ছে ড্রাইভার। লম্বা জুব্বা আর টুপি মাথায় থাকলেও তাকে আমার ভারত উপমহাদেশের লোক বলে মনে হচ্ছিলো। ইরেজীতেই জিজ্ঞেস করলাম তার দেশ কোথায়? আমাকে অবাক করে দিয়ে বাংলায় জবাব দিলো বৃহত্তর কুমিল্লার ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় তার জন্মস্থান। সৌদীর মাটিতে পা রেখেই প্রথমে একজন বাংলাদেশীকে পেয়ে খুবই ভালো লাগলো। গল্প করতে করতে এগিয়ে চললাম। জানলাম, তিনি এর আগে মক্কার বাইরে ছোট একটি শহরের মসজিদে ইমামতি করতেন। এখন জেদ্দা এসে এই কোম্পানীর গাড়ী চালান। গল্পে গল্পে কখন যে সময় পেরিয়ে গেলো টের পাইনি। একসময় তিনি গাড়ী থামিয়ে বললেন- আমরা এসে গেছি। নেমে দেখলাম, বিশাল হোটেল। গেটে লা মেরেডিয়ান সাইন জ্বল জ্বল করছে। তার ভাড়া এবং টিপস মিটিয়ে দিয়ে বিদায় দিলাম। হোটেলের বেল বয় এসে লাগেজ উঠিয়ে নিয়ে গেলো।
উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম রিসিপসনে। লম্বা জুব্বা, টুপি, রূমাল পরা একজন ইয়ংম্যান আমাকে স্বাগত জানালো। কিন্তু কম্পিউটারে তিনি আমার বুকিং খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে আমার বুকিং রিসিট দেখতে চাইলেন। এতে আমি খুবই বিরক্ত হলাম। কারণ আমি সারা বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াই। আজ পর্যন্ত কেউই বুকিং রিসিট দেখতে চায়নি। সৌদী আরব বলেই সম্ভববত এটা প্রয়োজন। তবে বিরক্ত হলেও ব্যাগ খুলে রিসিটটা বের করে তার হাতে দিলাম। কপিটা হাতে নিয়েই তিনি এক গাল হেসে বললেন হোটেল ঠিক আছে, তবে এটা জেদ্দা লা মেরেডিয়ান। আমার বুকিং মক্কা লা মেরিডিয়ানে। যা এখান থেকে আরো ৯০ কিলোমিটার দূরে।
তার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পরলাম। নিমিষেই যেনো সারাদিনের ক্লান্তি এস ভর করলো শরীরে। রিসিপসনিষ্ট জানালেন সম্ভবত ইচ্ছে করেই ড্রাইভার আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়েছে। কারণ ঠিকানা দেখার পর তার এমন ভুল হওয়ার কথা নয়। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো একজন দেশী ভাই মধ্যরাতে আমাকে মরুভূমির একটি অচেনা জায়গায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তার ফোন নম্বরও আমি রাখিনি যে কল দেবো। তবে আমার সাথে মানি রিসিট ছিলো। ওটা হোটেলের রিসিপসনিষ্টকে দিয়ে অনুরোধ জানালাম এয়ারপোর্টে ট্যাক্সি কাউন্টারে কল দিতে। ওনি ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই একজন ফোন ধরলো। ড্রাইভার আমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়ে তখনো রিপোর্ট করেনি। কাউন্টার থেকে জানালো তারা ট্যাক্সি একটা পাঠাতে পারেন তবে মক্কায় আমার হোটেলের ঠিকানায় পৌছে দিতে আরো ২০০ রিয়াল পরিশোধ করতে হবে। আমার ভুলটা কোথায় বুঝতে পরছিলাম না। আমি তো তাদের মুখে কিছু বলিনি। আমার বুকিং রিসিট দেখিয়েছিলাম। তারপরও আমারকে কেনো মাঝপথে নামিয়ে দিলো আমারই বাংলাদেশী ভাই!
সারা বছর আমি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। এধরনের সমস্যা মোকাবেলা করার অভ্যাস আমার রয়েছে। তাই আবার অনুরোধ করে বললাম তাদের একটা ফোন করে জানাতে যে আমি ফিরে আসছি জেদ্দায়, তবে একা নয়, সৌদি পুলিশ নিয়ে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে কে সঠিক বা কে বেঠিক।
এবারের কলে যেনো মন্ত্রের মতো কাজ হলো। কাউন্টার থেকে জানালো আমাকে আসতে হবে না, তারা গাড়ী পাঠাচ্ছে। সে গাড়ী আমাকে মক্কা হোটেলে পৌছে দিলাম। আমি তখন তাদের জানাতে বললাম, তারা যেনো সেই একই ড্রাইভারকে পাঠায় যে আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়েছিলো। তারা তাতেই রাজী হলো।
আমি এবার স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম। বসলাম সোফাতে। রিসিপশন ম্যানেজার আমার জন্য খাবারের অর্ডার দিলেন। সাথে সাথেই হুকুম তামিল হলো। ওয়েটার নানা ধরনের খাবার নিয়ে এলো। আরবীয়রা যে অতিথিপরায়ণ নতুন করে তার প্রমাণ পেলাম।
একটু পরেই গাড়ী এসে পৌছালো। কিন্তু হোটেল ম্যানেজার অনুরোধ জানালো রাতটা এখানেই কাটাতে। সকালে তিনি নিজেই ড্রাইভ করে মক্কায় আমার হোটেলে পৌছে দেবেন। আমি তার বদান্যতারজন্য ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
রাগে আমার শরীর রি রি করছিলো। ড্রাইভারকে বললাম, ভাই এই মাঝরাতে একটা অচেনা-অজানা জায়গায় নামিয়ে দিতে একটুও খারাপ লাগেনি? আপনি তো দীর্ঘদিন সৌদি আরবে আছেন। আমি ওমরাহ করতে এসেছি। ৯০ মাইল দূরে থেকে কিভাবে প্রতিদিন আমি কাবাঘর জিয়ারতে যবো- এই প্রশ্নটি কি একবারো মনে উঁকি দেয়নি? আমতা আমতা করে তিনি কি যেনো বলতে চাচ্ছিলেন। তাক বললাম- কোন কথা নয় সোজা মক্কায় আমার হোটেলের দিকে গাড়ী চালান। তাকে আরো বললাম। আমি ইচ্ছে করলেই আপনার ক্ষতি করতে পারতাম। পুলিশে রিপোর্ট করলে প্রথমেই আপনি গ্রেফতার হতেন। দেশী ভাই হিসেবে আমি তা করিনি। কিন্তু আপনি দেশী ভাইয়ের মর্যাদা রক্ষা করেননি।
তার সাথে আর কোন কথা না বলে চুপচাপ গাড়ীর সীটে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। ক্লান্তিতে কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে টের পাইনি। তার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। বললো আমরা হোটেলে এসে গেছি।
এবার আর আমি ঠকতে রাজি নই। গাড়ী থেকে বেড়িয়ে তাকে বললাম কোথাও যেনো না যায়। আমি ভিতরে খোঁজ নিয়ে আসি। যদি এবারও ভুল জায়গায় নিয়ে আসে তাহলে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমা করবো না। আমি রিসিপশনে গিয়ে রুমের চাবি নিলাম। বেল বয় লাগেজ নিয়ে উপরে গেলে আমি ফিরে এসে দেখলাম আমার দেশী ভাই অবনত মস্তকে অপেক্ষা করছে। আমি তাকে শুধু যেতে বললাম। কোন কথা না বলে তিনি রওনা হলেন জেদ্দার দিকে।

Categories
আফ্রিকা

মিশরের গল্প

আমরা প্রথমে এলাম খুফু’র পিরামিড দেখতে। এর উচ্চতা ৪৮১ ফুট। খ্রীষ্ট জন্মের ২৩৬২ বছর পূর্বে এটি তৈরী করা হয়েছিলো। নির্মাণকালে এর উচ্চতা ছিলো ১৪৩ মিটার, যা এখন ক্ষয় হয়ে ১৩৭ মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। খুফু’র পিরামিডের আরেক নাম গ্রেট পিরামিড। ফারাউ শাসক খুফু’র শাসনামলে এটি নির্মাণ করা হয়। এতে রয়েছে তিনটি প্রধান প্রকোষ্ঠ। রাজা যেখানে অতিথিদের বসাতেন সেই কক্ষ বা গ্যালারির দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৮৪ মিটার। গ্র্যান্ড গ্যালারীর পাশেই ছিলো কিংস চেম্বার। যেখানে রাজা খুফু’র মৃতদেহ মমি করে রাখা হয়। এবং পাশেই ছিলো কুইন্স চেম্বার।
গাইড জানায়, প্রাচীন মিশরীয়রা মমির সাথে প্রচুর ধন-সম্পদ সঙ্গে দিতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো মৃত্যুর পর এসব প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু ৮২০ সালে খুফু’র পিরামিডে সন্ধান চালিয়ে তার মমি বা ধন-সম্পদ কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিশ্লেষকরা মনে করেন প্রাচীনকালেই চোররা মমি সহ ধন-সম্পদ সব লুট করে নিয়ে যায়। উনিশ শতকের প্রথম পর্যন্ত খুফু’র পিরামিড-ই ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা। ১৩ একর জায়গার উপর নির্মিত এই পিরামিডটা নির্মাণে এক লাখ লোকের ২০ বছর সময় লেগেছিলো। যদিও এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এই পিরামিড নির্মাণের জন্য প্রচুর পাথরের প্রয়োজন হয়। কোন কোন পাথরের ওজন ছিলো কয়েক টন। এতো ভারী ভারী পাথর কিভাবে এতা উপরে উঠানো হয়েছিলো তা ভাবলে এখনো বিস্ময় জাগে।
এবার পিরামিডের ভিতরে ঢোকার পালা। গাইড গেইট থেকেই টিকেট কিনে এনেছিলো। তারপরও আবার জানতে চাইলো- সিদ্ধান্ত পাল্টাবো কিনা। যদিও আমার হাঁটুতে ব্যথা তবুও ভিতরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সুযোগ পেয়েও পিরামিডের ভিতরটা না দেখে ফেরৎ যাবো? আবার কি কোনদিন এখানে আসতে পারবো? আর আসলেও বয়স তো থেমে থাকবে না!
প্রবেশ পথটা ছোট্ট একটা সুরঙ্গের মতো। নীচু ছাদ। একটু বেঁকে গেছে নীচের দিকে। ভিতরে অনুজ্জল একটা আলো জ্বলছিলো। সাহস সঞ্চয় করে গাইডের সাথে সামনে এগুচ্ছি। সুরঙ্গটা এক সময় ছোট্ট একটা কুঠরিতে এসে শেষ হলো। এখানে ছাদটা একটু উঁচুতে। গাইড হাত দিয়ে ডান দিকে আরেকটা সুরঙ্গ দেখালো। বললো- এটা রাণীর সমাধি। এমনিতেই দম বন্ধ লাগছিলো, তাই ওদিকে আর যাইনি। গাইড এবার নিয়ে চললো একটু ওপর দিকে আরেকটা সুরঙ্গের পথে। একটা মাঝারি আকারের ঘরে গিয়ে সুরঙ্গটা শেষ হলো। এটাতে রাখা আছে একটা কালো পাথরের কফিন। প্রচুর পর্যটক ঢুকছে পিরামিডের ভিতরে। তবুও কেমন যেনো ভয় ভয় লাগছিলো। গাইড অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাইলেও তাকে বারণ করলাম। বললাম- আর নয়, এখন ফিরে যাবো। ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে রইলাম এটুকুই যথেষ্ট।
খুফু’র পিরামিড থেকে মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এলাম। মাথাটা কেমন যেনো ঝিমঝিম করছিলো। এব্যাপারে গাইডের অভিজ্ঞতা অনেক। ব্যাগ থেকে এক বোতল পানি এগিয়ে দিলো আমার দিকে। বললো- সবটুকু খেয়ে নিন, ১০ মিনিট বসে বিশ্রাম করুন, ঝিমঝিম ভাবটা কেটে যাবে। তার কথামতো সবটুকু পানি ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম, বিশ্রামও নিলাম। একটু ভালো লাগলে ওঠে দাঁড়িয়ে গাইডকে বললাম- চলুন বাকী দুটো পিরামিড দেখে আসি।
বাইরে থেকে বাকী দুটো পিরামিড দেখে রওনা হলাম স্ফিংকস-এর মূর্তি দেখতে। পথে গাইড দেখালো শ্রমিকদের গ্রাম। ঠিক গ্রাম নয়, গ্রামের ধ্বংসাবশেষ। পিরামিড নির্মাণের জন্য পাথর বহন, স্থাপন ইত্যাদির জন্য হাজার হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন ছিলো। এছাড়াও ছিলো রান্নার জন্য বাবুর্চি, কাঠ মিস্ত্রি, জলবাহক সহ নানা রকম কাজের লোক। গাইড জানায়, শ্রমিকদের এই গ্রামটি নির্মাণ করা হয় খুফু এবং ম্যানকাউর কমপ্লেক্স-এর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।
এরপর আমরা এলাম স্ফিংকস-এর মূর্তি দেখতে। মানুষের মাথার সাথে সংযুক্ত হয়েছে সিংহের শরীর। অর্থাৎ স্ফিংকস অমিত বলশালী ও বুদ্ধিমান। গাইড জানায়, এই মূর্তিটি রাজা খুফু’র সময় নির্মিত হয়েছিলো। বর্তমানে এটির নাক ভাঙ্গা। কোন এক সময় দূর্বৃত্তের আক্রমণে তার নাকটি খোয়া গেছে। স্ফিংকসের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি পিরামিড। মনে হচ্ছিলো স্ফিংকস পিরামিড তিনটিকে পাহারা দিচ্ছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো।
পিরামিড কমপ্লেক্স থেকে বেরুনোর পর একটি বিশাল পারফিউম-এর দোকানে নিয়ে গেলো গাইড। অনেকগুলো রুম। একেক রুমে একক ধরণের পারফিউম। এটা কায়রোর সবচেয়ে বড় পারফিউম শপ। আর এগুলোতে কোন কেমিক্যাল মিশ্রিত নেই। একজন সেলসম্যানের কাছে আমাকে গছিয়ে দিয়ে সে অন্য একটি রুমে গিয়ে পত্রিকা পড়তে বসলো। এসব ধান্ধাগুলো আমার চেনা। গাইডরা যেখানে শপিং-এর জন্য নিয়ে যায়, সেখান থেকে তারা পারসেন্টেজ পায়।
সেলসম্যানটি পারফিউম-এর গুনাগুণ, কি দিয়ে কিভাবে তৈরী তার ব্যাখা দেয়া শুরু করলো। কখনো একেকটা শিশি থেকে পারফিউম বের করে হাতে মেখে দিতে লাগলো। আমার অমনোযোগিতা দেখে মনে হলো সেলসম্যান খুব আহত হলো। আর আমি তাকে জানিয়ে দিলাম এসব পারফিউম ক্রয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই।

মরুদ্যানের রেষ্টুরেন্টে লেখক
মরুদ্যানের রেষ্টুরেন্টে লেখক

ততক্ষণে খিদে পেট চোঁ চোঁ করতে শুরু করেছে। আগেই বলাছিলো মরুদ্যানের কোন রেষ্টুরেন্টে গিয়ে আমরা দুপুরের খাবার খাবো। গাইড-কে তা বলতেই আমাকে নিয়ে রওনা হলো সেখানে। একটু পড়েই বিশাল একটা বাগানবাড়ীর গেটে এসে গাড়ী থামলো। বাগানবাড়ী মানে চারিদিকে শত শত খেজুর গাছ- অর্থাৎ মরুদ্যান। গাড়ী থেকে নামতেই কয়েকজন লোক এসে ঘিরে দাঁড়ালো। একজনের হাতে বাঁশি, অন্যজনের হাতে তবলার মতো যন্ত্র। আমাকে ঘিরে তারা বাজনা শুরু করে হাঁটতে লাগলো সামনে। আমাকে নিয়ে বসালো মরুদ্যানের ভিতরে একটি রেষ্টুরেন্টে। বিশাল রেষ্টুরেন্ট, উপরে খেজুর গাছের ছানি, নীচে মানানসই চেয়ার-টেবিল পাতা। আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে বাদকদল ফিরে গেলো গেটে। গাইড বললো- এই রেষ্টুরেন্টের এটাই ঐতিহ্য।
গাইড ইব্রাহীম-ই খাবার অর্ডার দিলো। সবই স্থানীয় খাবার। প্রথমেই এলো আলু কাবলীর মতো একটা চাট। ছোট ছোট ফুলো ফুলো রুটি। হামাস আর বিফ দিয়ে বানানো সালাদ। বেগুন ভাঁজা, মিটবল। এগুলো খেতে না খেতে বিশাল খাঞ্চায় করে নিয়ে এলো হরেক রকম কাবাব আর চিকেন রোস্ট। সবশেষে কফি। লোক আমরা তিনজন, কিন্তু পরিবেশন করলো ১০ জনের খাবার। উঠতে যাবো। এমন সময় একটা ট্রেতে করে নিয়ে এলো কিছু ফল। প্রতিজনের জন্য একটি কলা একটি পাকা পেয়ারা এবং আপেল। পেট পুরো ভর্তি ছিলো। তবু অনুরোধ ফেলতে না পেরে খেলাম।
উঠার সময় সেই বাদক দল আবার এসে হাজির। বাদ্য বাজাতে বাজাতে আমাদের দিয়ে এলো গাড়ীর কাছে। একটা অদ্ভুত ভালো লাগা নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। গাড়ী ছুটে চললো নীল নদের তীরে আমাদের হোটেল নাইল রিজ কার্টনের দিকে।