Categories
ইউরোপ

নিশিথ সূর্যের দেশে

হাবিব রহমানঃঅনিন্দ সুন্দর প্রকৃতি আর ছবির চেয়েও সুন্দর দেশ নরওয়ে।দেশটির উন্নত জীবন যাপন ,অসাধারণ জীব বৈচিত্র ,সমৃদ্ধ ইতিহাস আর সংস্কৃতি সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে টানে।নরওয়েকে বলা হয় নিশিথ সূর্যের দেশ।অর্থাৎ মধ্যরাতেও এখানে সূর্যের দেখা মেলে। মধ্যরাতের সূর্য হচ্ছে এমন একটা ঘটনা যখন টানা ২৪ ঘন্টাই সূর্য দিগন্ত রেখার উপর ঝুলে থাকে।অর্থাৎ ঐ সকল অন্চল সমূহ ২৪ ঘন্টাই সূর্যের আলো পায়।আর এই সময়টা হচ্ছে ১৯ এপ্রিল থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত।তবে মধ্য রাতের সূর্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায় ২১ জুন তারিখে। আবার একইভাবে সূর্য যখন দিগন্ত রেখার নীচে অবস্হান করে তখন এই অন্চল সমুহে ২৪ ঘন্টাই রাতের অন্ধকার থাকে।তবে এটাকে ঠিক অন্ধকার না বলে বলা যায় গোধূলির আলো ।
নিশি রাতে সূর্য দেখা যায় কেন বিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।তাদের মতে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তন করছে।এই আবর্তনের সময় পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ২৩.৫ ডিগ্রী হেলে থাকে।কখনো হেলে থাকে উত্তর গোলার্ধের দিকে ।কখনো বা দক্ষিন গোলার্ধের দিকে।যখন যে গোলার্ধ সূর্যের দিকে থাকে কখন সে গোলার্ধে সূর্যরশ্মি খাড়াভাবে পড়ে এবং দীর্ঘ সময় সূর্যের আলো পাওয়া যায়। ফলে দিন বড় হয় আর রাত ছোট হয়।অক্ষাংশ যত বেশী হয় দিন তত বড় হয়।বেশী অক্ষাংশে অবস্হিত জায়গাগুলোতে গ্রীস্মকালে সূর্য অস্ত যায়না। তখন মেরু থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্হিত জায়গা গুলোতে কয়েকসপ্তাহ পর্যন্ত টানা সূর্যাস্ত ঘটেনা।আর মেরু অন্চলে সূর্য ডুবেনা ৬মাস।উত্তর মেরুতে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর টানা ছয়মাস দিন থাকে।আর এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধে টানা ছয়মাস থাকে রাত।অর্থাৎ দক্ষিণ গোলার্ধে যখন দিন তখন উত্তর গোলার্ধে রাত।আর এই আশ্চর্য ঘটনার কারণ একটাই তা হলে পৃথিবীর হেলে থাকা।
নরওয়ে ছাড়াও উত্তর গোলার্ধের আরো কয়েকটি দেশ যেমন সুইডেন,ফিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডেও এই একই ঘটনা ঘটে থাকে।তবে নরওয়ের বেশীরভাগ অন্চল উত্তর গোলার্ধের অন্তরভুক্ত বিধায় এই দেশটিতে সূর্যের আলো সবচেয়ে বেশী সময় ধরে পাওয়া যায়।যেজন্য নরওয়ে ই নিশিথ সূর্যের দেশ হিসেবে পরিচিত।তবে নিশি রাতের সূর্য দেখা ছাড়াও এই দেশটির রয়েছে বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,চমতকার সুন্দর সমুদ্রখাড়ি যা ফিয়র্ড নামে পরিচিত।রাতের আকাশজুড়ে বর্ণিল আলোর খেলা বা অরোরা বোরিয়ালিস ।আছে অবিশ্বাস্য সুন্দর সুউচ্চ পর্বত শ্রেনী ।আছে হাজার হাজার নয়নাভিরাম হ্রদ।সেসব হ্রদের পাড়ে ছবির মত সুন্দর জেলেদের গ্রাম আর সবুজের সমারোহ।এসব হ্রদে পাওয়া যায় ইউরোপের সবচেয়ে সুস্বাদু স্যামন মাছ।এছাড়া নরওয়ে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয় এর রয়েছে বর্নিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,নজরকারা স্কান্ডিনেভিয়ান স্হাপত্য ।আর এসব দেখার জন্য প্রতি বছর সারা বিশ্বের পর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে।এই যেমন নিউইয়র্ক থেকে আমি ছুটে এসেছি এই নিশিথ সূর্যের দেশটি ঘুরে দেখার জন্য।
আমি নরওয়ে ভ্রমনের জন্য জুলাই মাসটাকেই বেছে নিয়েছি।এতে এক ঢিলে অনেক পাখী মারা যাবে। নিশিথ রাতের সূর্যতো দেখা যাবেই একই সাথে উপভোগ করা যাবে নরওয়ের গ্রীস্মকালটাকেও।এ দেশের গ্রীস্মকালটা হয় দারুন সুন্দর।কড়া রোদে বরফ গলে হিমবাহ হয়ে যায়।পাহাড়ি ঝর্নারা গান গায়।রঙ বে রঙের ফুল ফুটে রঙিন হয়ে উঠে প্রকৃতি।
নিউইয়র্কের জেএফ কে বিমান বন্দর থেকে ৭ ঘন্টা ১৫ মিনিট ওড়ে নর্স আটলান্টিক এয়ারওয়েজের বিমানটি পাখা নামালো নরওয়ের গাডারমেনন বিমানবন্দরে ।ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলি ভ্রমনে আমেরিকান পাসপোর্টধারীদের জন্য কোন ভিসার প্রয়োজন হয়না।শুধুমাত্র পাসপোর্ট কন্ট্রোলে ইমিগ্রেশন অফিসারকে একটু দেখা দিয়ে পাসপোর্টে একটা এন্ট্রি সিল নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলাম বাইরে।
আজকাল বিদেশ ভ্রমন তেমন কঠিন নয়।বিশেষ করে ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে। সবাই যেন সাহায্যের জন্য মুখিয়ে থাকে।প্রতিটা দেশের বিমান বন্দর থেকে মেইন সিটিতে যাবার জন্য ট্রেন বাসের ব্যবস্হা আছে।এতে খরচ লাগে কম।আর টেক্সিতো আছেই।
ইনফরমেশন বুথ আছে প্রতিটি এয়ারপোর্টে। তাদের জিজ্ঞেস করলেই বা ঠিকানা দেখালেই সহজে কিভাবে যাওয়া যাবে পরামর্শ দেয়।ট্রেনের টিকিট কাউন্টারেও লোক থাকে সাহায্যের জন্য।
এয়ারপোর্টের ইনফরমেশন সেন্টারে আমার হোটেলের ঠিকানা দেখাতেই বলে দিলো ট্রেন বাসে দুটোতেই যাওয়া সম্ভব।গাড়ী থেকে নেমে ৫মিনিট হাঁটলেই হোটেল।
গাডারমেনন এয়ার পোর্ট থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলোর দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। দ্রুতগতির ট্রেনে অসলো পোঁছতে সময় লাগে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিট ।তাই ট্রেনেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। চমতকার ট্রেন।রাস্তার দু ধারের সবুজ প্রকৃতি, মাঝে মাঝে গম ও আলুর ক্ষেত ,পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তা দেখতে দেখতে কখন যে এই ৫০ কিলোমিটারে রাস্তা পেরিয়ে গেলাম টেরই পাইনি।
ট্রেন থেকে নেমে জিপিএস ফলো করেই চলে এলাম হোটেলে।
শংকায় ছিলাম সাত সকালে হোটেলে রুম পাবো কিনা।কারণ পৃথিবীর সব দেশেই চেক ইন টাইম বিকেল ৩টায়।তবে রুম খালি থাকলে এবং রিসেপসানে হ্রদয়বান কেউ থাকলে সাধারণত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। বিশেষ করে তারকা হোটেলগুলোতে রুম সাধারণত খালি থাকেই।আর এসব হোটেলের রিসেপসানে যারা থাকেন তারাও ভালো কাস্টমার কেয়ার করেন।অসলোতে আমার হোটেল ছিলো পার্ক হন বাই রেডিসন।রিসিপসানে হাজিরা দিতেই চেহারায় ক্লান্তির ছাপ আর হাতে আমেরিকান পাসপোর্ট দেখেই সম্ভবত সুন্দরী সেবিকার মায়া লাগলো।কোন কথা না বলেই রুম কার্ড দিয়ে দিলেন।সাথে এও জানালেন রেস্টুরেন্ট এখনো বন্ধ হয়নি।তাড়াতাড়ি করলে ব্রেকফাস্টটাও সেরে নিতে পারবো।
অফিসিয়াল ট্যুর শুরু হবে কাল থেকে।তাই কোন তাড়া ছিলোনা।রুমে লাগেজ রেখে হাত মুখ ধুয়ে দ্রুত নাস্তা সেরে রুমে ফিরে এলাম।দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের ক্লান্তিতে হোটেলের নরোম বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো দুচোখে ।
বিকেলের দিকে বেরোলাম শহরটা ঘুরে দেখতে। চারদিকে একটা অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ।রাস্তায় গাড়ীর হর্ন নেই।চিৎকার চেচামেচি নেই।ইউরোপের অনেক দেশ ভ্রমন করেছি।মনে হচ্ছিলো এর আগে এত নীরব দেশ আর দেখিনি।ভাবছি একটা শহর কি ভাবে এতটা নীরব আর শুনশান হয়।মনে হচ্ছিলো যেন কান পাতলে মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাবে।আগেই জেনেছিলাম নরওয়ে যেমন নীরব,শান্ত দেশ, তেমনি মানুষ ও শান্তিপ্রিয়।ঝুট –ঝামেলাহীন জীবন তাদের পছন্দ। মাত্র কয়েক লাখ লোকের বাস অসলো শহরে। মানুষও প্রকৃতি এখানে হাত ধরা ধরি করে চলে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটা জিনিষ দেখে খুবই চমত্কৃত হচ্ছিলাম।তা হলো সকল জায়গায় ইংরেজির ব্যবহার। যে কোন সাইন বা যে কোন কিছু নরওয়েজিয়ান ভাষার পরেই ইংলিশে লেখা।তাই কোনটা কিসের দোকান তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলোনা।
শৈল্পিক ও আভিজাত্যমণ্ডিত বাড়িগুলির আকৃতি ও নির্মাণশৈলী, পথের দু’পাশে সুদৃশ্য, সুসজ্জিত স্বল্প আলোকিত রেস্তরাঁগুলিও শহরের সৌন্দর্য বর্ধন করেছে অনেকাংশে। এখানকার বাসিন্দারাও পোষাক পরিচ্ছদে খুবই ফ্যাশনদুরস্ত ও পরিপাটি। সবাইকে দেখাচ্ছিলো প্রাণোচ্ছল ও খোশমেজাজি।পাথর বাঁধানো ঝকঝকে পথের দু’পাশে বিশালাকায় সুদৃশ্য গামলা আকৃতির টবে থরে থরে মরসুমি ফুল সাজানো। রাস্তায় একটু পর পর দেখা যাচ্ছিলো পুষ্পশোভিত উদ্যান।
অসলোর প্রশস্ত রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। রাস্থা ঘাট বেশ পরিচ্ছন্ন। হাঁটাপথ আর সাইকেল চালানোর আলাদা রাস্তা। রাস্তার পাশে অনেক গর্জিয়াস ভবন। সাম্প্রতিককালে তৈরি ভবনগুলিতে আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর ছাপ। রাস্তায় গাড়ি-ট্রাম পাশা পাশি চলছে।সড়ক আর রেলপথ অসলো শহরকে জালের মতো ছেয়ে রেখেছে। শহরের পুরো রেলপথ মাটির নীচে। রাস্তার পাশে একটু পর ক্যাফে-রেস্তোরা। রেস্তোরার সামনে খাবারের টেবিল সাজানো।নানা কিছিমের দোকানপাট-পোশাক, সৌন্দর্য প্রসাধনী। চার পাশে ভারি সুন্দর রকমারি স্থাপনা। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। দেখতে বড় ভাল লাগে।
একটু হাঁটতেই চোখে পড়লো জগৎবিখ্যাত নোবেল পিস সেন্টার। এই ঐতিহ্যময় ভবনের হলে বিশ্ব শান্তি নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ভবনটা তেমন আহামরি কিছু নয়।তেমন চাকচিক্য নেই।সাদামাটা এক দ্বিতল ভবন। সামনেই এর প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেলের ভাস্কর্য। ঘুরে ঘুরে কক্ষ গুলো দেখতে থাকি।কমিটি রুম,ঘোষনা কক্ষ আরো কতো কি! প্রতিবছর ১০ই ডিসেম্বর এখানে অনুষ্ঠান করে সনদ আর ট্রফি দেয়া হয়,।এখানেই আমাদের গর্ব ড.ইউনুস এসে নোবেল পুরস্কার গ্রহন করেছিলেন।মনে মনে শিহরণ অনুভব করি।
নোবেল পুরস্কারের অন্যান্য শাখার পুরস্কার দেওয়া হয় সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম থেকে। তবে আলফ্রেড নোবেল তাঁর উইলে সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিভাগ শান্তি পুরস্কারের দায়িত্ব দেন নরওয়ের সরকারকে। এর ভিত্তিতে গঠিত হয় নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। এই কমিটিই এক শ বছরের বেশি সময় ধরে অসলো থেকে শান্তি পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে আসছে।
ভবনের অকপাশে বড়সড় লবি। একপাশে টিকেট কাউন্টার আর স্যুভেনির শপ বা স্মারক বিক্রয়কেন্দ্র। টিকেট কেটে নিচতলার গ্যালারিতে ঢুকি। করিডর ধরে এগোতেই দেখা মিলল নোবেল পুরস্কারের কয়েনের। ১৮ ক্যারেটের সোনা দিয়ে তৈরি এই কয়েনকে কাচের ওপাশে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল ১৯২১ সালে নরওয়ের রাজনীতি গবেষক ক্রিশ্চিয়ান এল ল্যাংকে।
জাদুঘরের প্রাণকেন্দ্র ‘নোবেল ফিল্ড’। কাচ দিয়ে ঘেরা হলটি নীলচে আলোয় আলোকিত। ঘরজুড়ে আইপ্যাডের সমান অনেক স্ক্রিন, স্ট্যান্ডের ওপর বসানো। অন্ধকার ঘরে নীলচে আলো আর জ্বলজ্বলে স্ক্রিন মিলে অন্য রকম একটা আবহ তৈরি হয়েছে।১৯০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যাঁরা শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, তাঁদের সবার প্রোফাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। প্রত্যেকেরনিজস্ব স্ক্রিন রয়েছে। শিরিন এবাদি থেকে মালালা ইউসুফজাই। নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দালাই লামা থেকে বারাক ওবামা। নানা দেশের পর্যটক রয়েছেন ঘরটিতে, সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তবে নিজের দেশের নোবেল লরিয়েটদের সামনেই বেশি সময় ব্যয় করছেন। ড. ইউনূসের স্ক্রিনের সামনে আমরাও বেশ কিছুক্ষণ থাকলাম। ইউনূসের ছবি, তাঁর নোবেল পাওয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আর নানা উক্তি দেখানো হচ্ছে।
নোবেল হল থেকে বের হয়ে গেলাম ‘দ্য ওয়াল পেপার’ নামের দেয়ালটি। এই দেয়ালে পাঁচটি বড় বড় ইন্টার-অ্যাকটিভ স্ক্রিন রয়েছে। নোবেল লরিয়েটদের বিস্তারিত জীবনী ও কাজের বিবরণ এখানে দেওয়া আছে। ভিডিও, এনিমেশনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁদের অবদান তুলে ধরা হয়। এই দেয়াল ধরে একটু সামনে গেলে ‘নোবেল চেম্বার’। এই চেম্বারের ইন্টার-অ্যাকটিভ স্ক্রিনে পাওয়া যাবে আলফ্রেড নোবেলের বর্ণিল জীবনকাহিনি।
দোতলা দেখা শেষ করে নিচে নামলাম। স্যুভেনিরের খোঁজে ঢুঁ মারলাম টকটকে লাল রং করা স্যুভেনির শপে। বিশ্বের নানা প্রান্তে তৈরি হস্তশিল্প বিক্রি হচ্ছে। আরো আছে নোবেল লরিয়েটদের ওপর লেখা বই, তাঁদের ছবি সহ পোস্টকার্ড, উক্তি ইত্যাদি। ভীড়ের মাঝ থেকে খুঁজে আমাদের ড.ইউনুসের ছবি সম্বলিত পোস্টকার্ড খুঁজে বের করে বেশ কয়েকটা কিনলাম।এসব বিক্রির অর্থ দাতব্য কাজে ব্যয় করা হয়। নোবেল কয়েনের আদলে তৈরি কয়েন চকোলেট পাওয়া যায় এখানে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য Akershus castle. ক্যাসেলে ঢুকার পথেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংলিন ডি রুজভেল্ট এর মুর্তি।তিনি একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি চার চারবার ক্ষমতায় ছিলেন।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেয়া এ’প্রসিডেন্টকে জর্জ ওয়াশিংটন ও আব্রাহাম লিংকনের পর সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারি রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নীচে পাথরে খোদাই করা তথ্য থেকে জানা যায় এখানে তিনি ১৯৫০ সালে এসেছিলেন।
কিছু দূর হেঁটেই পৌঁছে গেলাম সমুদ্রের ধারে অসলোর বিখ্যাত ন্যাশনাল অপেরা হাউস। এটি অসলো শহরের একটা বড় আকর্ষণ।অসলো ফিয়র্ডের মাথার কাছে অবস্থিত এই ভবনটি মুলত বানানোই হয়েছে অপেরা এবং ব্যালে ড্যান্সের জন্য। ভিতরটা খুব কারুকার্যময় আর চমৎকার করে সাজানো।ভেতরে ঢুকার জন্য কোন ফি নেই।পর্যটকরা চাইলেই ভবনের ছাদে গিয়ে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।আগাগোড়া পাথরে নির্মিত অপেরা হাউসকে পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোয় ভারী স্নিগ্ধ, মনোরম দেখাচ্ছিলো।সামনের বিস্তীর্ণ ঢালু চাতাল, সবটাই মসৃণ ধূসর হলদেটে পাথরে মোড়া। বহু মানুষ বৈকালিক ভ্রমণের জন্য এখানে আসেন ও সময় কাটান সমুদ্রের মুক্ত, নির্মল বাতাসকে সঙ্গী করে। নিবিড় ঘন নীল পর্বতমালা দিয়ে তিন দিক বেষ্টিত সমুদ্র। ছোট ছোট উজ্জ্বল রঙের পালতোলা নৌকার দল আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে পাহাড়ঘেরা সমুদ্রবক্ষকে। পর্যটকদের কাছে নরওয়ের বিশেষ আকর্ষণ পাহাড় ও সমুদ্রের এই সঙ্গম।
ঢুঁ মারলাম জাতীয় আর্ট গ্যালারিতে।এখানে মূলত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিল্পীদের চিত্র কর্ম রাখা আছে॥তবে পশ্চিম ইউরোপের কালজয়ী স্রষ্টাদের চিত্রও দেখা গেল বেশ কিছু। পাবলো পিকাসোর জন্য একটি পৃথক কক্ষ বরাদ্দ রয়েছে। পিকাসোর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর ভাবনা, অনুভূতি, উপলব্ধি প্রতিফলিত হয়েছে এ সব চিত্রে।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগছিলো।পাশেই একটা ক্যাফের সাইন দেখে ভেতরে ঢুকলাম।ছোট্ট ক্যাফের প্রায় সবগুলি টেবিলেই লোকজন বসা।হঠাৎ এক পাশের টেবিলে একজনের চোখে চোখ পড় লো।প্রথম দেখাতেই বুঝলাম তিনি একজন বাংলাদেশী।আমাকে হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন।পাশের একচি চেয়ার টেনে আনলেন আমার বসার জন্য।পরিচয় দিয়ে বল্লেন,ঢাকা মানিকগন্জে তার বাড়ী।ইউনিভার্সিটি অব অসলোতে তিনি পড়া শোনা করছেন।বিদেশে বাংগালী মাত্রই স্বজন একথাটা তিনি আরো একবার প্রমান করলেন।
তিনিই আমার জন্য কফির অর্ডার দিলেন।কফি পান করতে করতে অনেক কথা চলে তাঁর সাথে।জানালেন অনেক বাংলাদেশী ছাত্র এখানে পড়াশোনা করেন।১৮১১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় টি নরওয়ের অন্যতম সেরা এবং প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ।এতে ৮টি ফ্যাকাল্টির অধীনে অনেকগুলি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে।ইংরেজীতে মাস্টার্সে প্রায় ৭০ টি কোর্স বা প্রোগ্রাম রয়েছে।পিএইচডির জন্য রয়েছে ৮টি স্টাডি প্রাগ্রাম।
ইতোমধ্যে দুজনেরই কফি পান শেষ হলে আমরা একসাথেই ক্যাফে থেকে বেরোলাম।আমার কোন আপত্তি না শুনে তিনি আমাকে হোটেল পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন
Categories
ইউরোপ

রুপিট একটি গ্রামের নাম

হাবিব রহমানঃ নিউইয়র্ক থেকে স্পেনের বার্সিলোনায় উড়ে এসেছি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তরভুক্ত একটি ছোট্ট দেশ এ্যান্ডোরাঘুরে দেখবো বলে। দেশটি উত্তর থেকে দক্ষিনে ম্বায় মাত্র ২৫ কিলোমিটার ।আর পশ্চিম থেকে পূর্বে  ৩০ কিলোমিটার। এটিফ্রান্স এবং স্পেনের সীমান্তে অবস্হিত।পুরো দেশটির সব স্ হাপনাতে মিশে আছে ফরাসী এবং স্পেনীয় স্হাপত্যের নিদর্শন।এটিএকচি ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের দেশ।যেখানে জনসংখ্যা কঠোর নিয়মের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে।এন্ডোরা খুব শান্ত একটি দেশ।অপরাধ নেই । হৈহল্লা নেই । বিক্ষোভ মিছিল নেই। দেশটি স্কি রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত।সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ,মৃদু জলবায়ু সারা বছরবিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষন করে।

পিরোনিজ পর্বতমালার উপত্যকায় গড়ে ওঠা এ্যান্ডোরাতে কোনো এয়ারপোর্ট নেই। ফ্রান্স বা স্পেনে নেমে সড়ক পথে দেশটিতেআসতে হয় ।তবে স্পেনের গিরোনা-কস্টা ব্রাভা এয়ারপোর্টই দেশটি থেকে কাছে।আমি  নেমেছি স্পেনের বার্সিলোনা এয়ারপোর্টে।এখানকার একটি ট্যুর কোম্পানীর সাথে চুক্তি করে এসেছি তারা সড়ক পথে আমাকে এন্ডোরা ঘুরিয়ে আনবে।

বার্সিলোনায় ট্যুর কোম্পানীর অফিসের সামনে থেকে সকাল ৭টায় বাস ছাড়ার কথা।এখন শীতের সময়।সকাল ৭টা মানে খুবভোর সকাল।আমি সব জায়গায় সময়ের আগেই পৌছে যাই।এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।ট্যুর কোম্পানীর অফিসের সামনেযখন পৌঁছলাম তখনো অন্ধকার কাটেনি।অফিসের দরজাও খুলেনি।অফিসটা বড়রাস্তা থেকে একটু ভিতরে একটা গলিরভেতরে। কেমন যেন একটা নীরব এলাকা।রাস্তা দিয়ে তখনো তেমন লোক চলাচল শুরু হয়নি ।আমাকে একা দাড়িয়ে থাকতেদেখে হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামলো।দুজন নারী পুলিশ বেরিয়ে এসে জানতে চাইলো এই সাত সকালে কি করছিআমি এখানে।সামনে ট্যুর কোন্পানীর অফিসটা দেখিয়ে বল্লাম ওখান থেকে আমি এন্ডোরা ভ্রমনে যাবো। পুলিশ জানালোজায়গাটা তেমন ভালো নয়।ড্রাগ এডিক্টরা এখানে ঘোরাফের করে।সুযোগ পেলে তারা লোকজনের জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। তারাপরামর্শ দিলো  মোড়ের কোনায় একটা ক্যাফে আছে সেখানে গিয়ে বসতে।বাস ছাড়ার সময় এখানে চলে আসতে বলে তারা চলেগেলো।

পুলিশের পরামর্শমত  ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম।সময় কাটানোর জন্য গরম রফি এবং হালকা নাস্তার অর্ডার দিলাম।খেয়ে দেয়েসময়ের একটু আগেই পৌছে গেলাম ট্যুরিস্ট অফিসে।ততক্ষণে কর্ম চন্চল হয়ে উঠেছে অফিসটা।অনেক পর্যটক এসে ভীড় করেছেঅফিসে। বিভিন্ন জায়গায় তাদের ডেস্টিনেশন।

কাউন্টারে আমার টিকিটটি দেখালে কর্তব্যরত একজন  তরুনি খুব হাসিমুখেই দুঃসংবাদটি দিলেন।জানালেন এন্ডোরা যাবারপথে পাহাড়ি রাস্তায় ধ্বস নামার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্হা  অচল হয়ে আছে কাল থেকে।আজও কোন বাস ছেড়ে যাবেনা  এ্যানডোরার উদ্দেশ্যে।তবে সাথে আর একটা সু সংবাদ দিলো যে চাইলে এই একই টিকিটে আমি স্পেনের একটি  বিখ্যাতপাহাড়ি গ্রাম রুপিট ভ্রমনে যেতে পারি।পাহাড়ের চুড়ায় অবস্হিত মধ্যযুগের এই গ্রামটি দেখতে সারা বিশ্বের পর্যটকরা এসে ভীড়করেন।

যদিও আমি এ্যান্ডোরা ভ্রমনের উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলাম।তবে রুপিট সম্পর্কে আমার জানা ছিলো।এটি একটি সেরা পর্যটন  গ্রাম।জাতিসংঘ পরিচালিত ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেসান যে সেরা গ্রামের তালিকা তৈরি করেছে রুপিট তার একটি।বিশ্বজুড়েএ রকম ৩২ টি গ্রামের তালিকা করেছে সংস্হাটি।প্রতিটি দেশকে বিবেচনার জন্য তিনটি গ্রামের নাম জমা দিতে বলা হয়েছিলো।কিন্তু স্পেনের নাম দেয়া তিনটি গ্রামের মধ্যে তিনটিই তালিকায় চলে এসেছে।এর একটি  হলো রুপিট।

মুখে অপ্রসন্ন ভাব দেখালেও রুপিট  ভ্রমনে আমার আগ্রহের কমতি ছিলোনা।তাই দ্রুত গিয়ে বাসে চেপে বসলাম।পরে দেখেছি এসূযোগ মিস করলে বিরাট একটা ভুল হতো।একটা চমতকার অভিজ্ঞতা থেকে বন্চিত হতাম।

শহরের ভিড় ছেড়ে গাড়ি মোটরওয়েতে পড়লো,।পেরিয়ে যাচ্ছিলাম একের পর এক গ্রাম, প্রান্তর, ফসলের মাঠ। ইউরোপের সবদেশের কান্ট্রিসাইড ই ছবির মত সুন্দর।দিগন্তবিস্তৃত মাঠ বা ফসলের ক্ষেত, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দুটো ঘরবাড়ি, মাঝে মধ্যেব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরঝিরে নদী, চরে বেড়ানো ভেড়ার দল, কখনো দেখতে পাওয়া যায় বহুদূরের কোনো গির্জারচুড়া…..। শহরের কেন্দ্র থেকে একটু বাইরে গেলেই সবুজ আর সবুজ এবং দূরে দূরে সাজানো লোকালয়। বেশ প্রশস্ত আয়তনেলোকজন বসতি নির্মাণ করে। সবুজ বৃক্ষরাশি আর লতা গুল্ম সবকিছু যেন মিলেমিশে একাকার এখানে। 

গাড়ি ক্রমেই একে বেকে চলছে পাহাড়ি রাস্তায় ।আস্তেআস্তেঘুর্ ঘুরে  উপরে উঠছে।রাস্তাটি অনেকটা জলপাইগুড়ি থেকেদার্জিলিং যাবার রাস্তার মতো।কখনো চুলের কাঁটার মত বাঁক।দুটো গাড়ি কোন ক্রমে পাশ কাটাতে পারে।নীচে গভীর খাত।একটুএদিক ওদিক হলেই পপাত ধরনী তল।

গাইড জানালো রুপিট নামের ছোট্ট এই পাহাডি গ্রামটি মধ্যযুগে গড়ে উঠেছে।এটি সমতল খেকে ৮২২ মিটার উচুতে অবস্হিত।রুপিট একটি ল্যাটিন শব্দ।যার অর্থ রক বা পাথর।গ্রামের একমাত্র চার্চটি পাথর দিয়ে তৈরি  হয়েছে ১০ম শতকে।বাড়ি ঘরগুলোপাথর দিয়ে নির্মিত।রাস্তা গুলোও পাথরদিয়ে তৈরি।স্পেন সরকার গ্রামের সেই পুরনো ঐতিহ্যটা ধরে রেখেছে। অধিবাসী অল্পসংখ্যক হলেও তাদের জন্য সব নাগরিক সুয়োগ সুবিধা যেমন হাসাপাতাল,বিদ্যুৎ ব্যবস্হা,আধুনিক রাস্তা ঘাট সব তৈরি করেদিয়েছে।

একসময় আমাদের বাস এসে থামলো গ্রামের প্রবেশ মুখে।গ্রামের বাইরে থাকবে বাস।শুরুতেই একটা হ্যাঙ্গিং ব্রীজ ।নীচে কলকল রবে হয়ে চলেছে স্ফটিক স্বচ্ছ রুপিট নদী।এটা পেরিয়ে ঢুকতে হবে গ্রামে।এই নিরাপত্তা ব্যবস্হা সেই প্রাচীন কাল খেকে যাএখনো অটুট আছে।তবে ব্রীজটি নতুন করে নির্মিত হয়েছে ১৯৪৫ সালে।রাতের বেলা ব্রীজটি উঠিয়ে দিলে অবাঞ্ছিত কেউ ঢুকতেপারবেনা গ্রামে।

প্রকৃতি কন্যা রুপিট যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো এক অন্য রকম মুগ্ধতা নিয়ে।শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ।গ্রামটিকেদেখে মনে হচ্ছিলো প্রকৃতি যেন তার সকলসৌন্দর্য উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে ।রুপিটকে ভালো লেগে গেলো প্রথম দেখায়।

নিচের দিকে তাকালে ভালো করে কিছু চোখে পড়ে না। ধাপে ধাপে উঠে এসেছে পাহাড়। মেঘ আর কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে  কোথাওকোথাও সবুজ প্রকৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ।

একটু হেটে আমরা আসলাম একটা পাহাড়ি ঝর্না দেখতে।প্রকৃতির কোলে ঝর্নাটি যেন একটা অন্য রুপ নিয়ে চোখে ধরা দিলো।পাহাড়ের বুক চিরে আছড়ে পড়ছে প্রবহমান জলধারা। গুঁড়ি গুঁড়ি জলকনা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি হচ্ছে কুয়াশারআভা। স্রোতধারার শীতল কলতানে নিক্কন ধ্বনির উচ্ছ্বাস ছড়িয়েছে চারপাশ। যেন সবুজ অরণ্যের প্রাণের ছোয়ার পরশ এঁকেছেকেউ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব নৈসর্গিক একটা আবহ সৃস্টি করেছে চারপাশে।গাইড একটু সময় দিলে ঝর্নার জলে পা ভিজিয়েবসে রইলাম কিছুক্ষণ।

গোটা গ্রামটাই পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু ভরা মৌসুম নয় বলে তত ভিড় জমেনি। ঝর্নার জলে পা ভিজিয়ে বসে থেকেবেশ ভালোই  লাগছিলো।কিছু জলচর পাখির ডানা ঝাপটানো আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই।সবাই যেনকেমন একটা মৌনতায় মগ্ন।

রুপিট থেকে  অনেকগুলি  হাইকিং স্পট চলে গেছে জঙ্গলের ভিতরে।গাইডের নেতৃত্বে ঘন্টাখানিক হাইকিং করে সবাই ফিরেএলাম একটি রেস্টুরেন্টে ।প্রত্যেকেই নিজ নিজ পছন্দমত খাবার অর্ডার দিলো।আমি আগেই গাইডকে বলে রেখেছিলাম যে মাংসজাতীয় কিছু খাবোনা।সেজন্য গাইড আমার জন্য অর্ডার করলো টরটিলা দে পটাটা নামের একটি খাবার।এটাকে বলা যায়আলুর অমলেট।সাথে সালাদের মত পেঁয়াজের কুচি এবং অ্যাসপারাগাস আর এক বাটি নুডল স্যুপ।পরে এক কাপ গরম কফিখেয়ে সমাপ্তি।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছিলো ধীর লয়ে।

আমরা বাসে গিয়ে বসলাম।বাস ছুটে চল্লো পাহাড়ি পথ ধরে বার্সিলোনার পথে।

Categories
অষ্ট্রেলিয়া

ঘুরে দেখা ক্যানবেরা

হাবিব রহমান: গাড়ী ছুটে চলছে ক্যানবেরার রাজপথ ধরে।সূর্য তখন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের ব্লাক মাউন্টেনের আড়ালে।গাইড জানালো আমাদের আরো অনেক কিছুই দেখার বাকী।জাতীয় গ্রন্থাগার,বিজ্ঞান প্রযুক্তি যাদুঘর হাইকোর্ট সহ আরো নানা আকর্ষনীয় স্হাপনা।আজ যতগুলি দেখা যায় তা দেখে বাকীগুলো আগামীকাল।আসলে বিদেশে গেলে সময় সংক্ষেপের জন্য সব কিছু ঠিক মত দেখা যায়না বলে আক্ষেপ থেকেই যায়।
পথ চলতে চলতে গাড়ীর জানালা দিয়ে দেখছিলাম ঝকঝকে দোকানপাঠ,টলটলে পানির লেক,সবুজে ছাওয়া পার্ক ,কর্মব্যস্ত মানুষ ইত্যাদি।

গাড়ী এসে থামলো ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে।এটি নির্মিত হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নিহত সৈন্যদের স্মরণে।এটি স্মৃতিসৌধ,যাদুঘর ,চিত্র প্রদর্শনী এবং গবেষণা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত।১৯৪১ সালে যাদুঘরটি উদ্ধোধন করা হয়।স্মৃতিসৌধে আছে যুদ্ধে ব্যবহ্রত বিভিন্ন অস্র্র শস্রের প্রদর্শনী,নানা করুন এবং ভয়াবহ ইতিহাসের নমুনা।এটিতে ঢুকার জন্য কোন প্রবেশমূল্য নেই।
গাইড জানায়,প্রতিবছর এখানে পালিত হয় “ আনজাক ডে”।আনজাক অর্থ”The Australian & New zeland Army Corps এর সংক্ষিপ্তরুপ((ANZAC)প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৫ সালের ২৫এপ্রিল তুরস্কের গালিপোলিতে অবতরন করে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সেনাবাহিনী।এই দিনটিতে স্মরণ করা হয় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের যোদ্ধাদের যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।তাদের জন্য এখানে স্মরন সভা,প্যারেড ,ইত্যাদি আয়োজন করা হয়।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের(১৯১৪-১৯১৮) শুরু এবং সমাপ্তির ১০০ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে গত চার বছর ধরে সমগ্র অস্ট্রেলিয়ায় আনজাক দিবস পালন করা হয় আড়ম্বরতার সাথে।সূর্যোদয়ের আগে খুব ভোরে অস্ট্রেলিয়ানরা এই ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে এসে সমবেত হয়।শোক সংগীত গায় এবং প্রার্থনা করে।এ সময়ে তারা পুস্প স্তবক অর্পণ করে ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে।সূর্যোদয়ের পর মার্চ ও প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়।
গাইড খুব আবেগের সাথে বলে-প্রত্যেক জাতির নিজেদের একটি গল্প থাকে।আর আনজাক ডে হলো আমাদের গল্প।

এরপর আমরা এলাম মাউন্ট এ্যান্সলি।উপরে উঠে পশ্চিমে তাকাতেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম।দূরে ব্লাক মাউন্টেনের দিকে কিং এডোয়ার্ড ট্যারেস, শেষ মাথায় পুরনো সংসদ ভবন, দু পাশে টলটলে পানির লেক-যা শুধু চোখই জুড়ায় না মনও ভরিয়ে দেয়।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো।এবার ফেরার পালা।কাল ফিরে যাবো নিউইয়র্কে।সাথে নিয়ে যাবো অজস্র স্মৃতি ।আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের চেয়ে ৫২ গুন বড় দেশ এই অস্ট্রেলিয়া।কিন্তু জনসংখ্যা মাত্র আড়াই কোটি।চমৎকার সুন্দর এই দেশটিতে হয়তো আবার কোনদিন আসা হবে। হয়তো বা না।ততদিন ভালো থেকো অস্ট্রেলিয়া।আপাতত বিদায়।

Categories
অষ্ট্রেলিয়া

ক্যানবেরার পথে

চমৎকার সুন্দর পিচঢালা রাস্তা দিয়ে দিয়ে ছুটে চলছে আমাদের বাস অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার দিকে। কখনো দুধারে দিগন্ত বিস্তৃত খালি মাঠ।কখনো বা দুধারে অরণ্য । মাঝে মাঝে সাইন দিয়ে ক্যাঙ্গারুর ছবি আঁকা।অর্থাৎ এখান দিয়ে ক্যাঙ্গারু রাস্তা পারাপার হয়।ড্রাইভারের সাবধানে গাড়ী চালাতে হবে।গাড়ীর নীচে ক্যাঙ্গারু চাপা পড়লে জরিমানা গুনতে হবে।
গাইডের মাইকের শব্দে চমক ভাংলো। জানালো আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই ক্যানবেরা সিটিতে পৌঁছে যাবো। এই সূযোগে ক্যানবেরার কিছু তথ্য আমাদের জানাতে চায়।আজকাল টিপিকাল গাইডদের এই বক্তৃতা আর কেউ শুনতে চায়না ।কারণ গুগল ঘাটলে সহজেই সব তথ্য মেলে।তার পরও গাইডকে তার ডিউটি করতেই হয়।কেউ শুনুন বা না শুনুক।
পশ্চিমে ব্লাক মাউন্টেইন আর পূর্বে মাউন্ট অ্যান্সলি এই দুই পাহাড়ের মাঝে গড়ে উঠেছে ক্যানবেরা শহর।এখানে একসময় মেষপালকদের একটি ক্ষুদ্র বসতি ছিল, যার নাম ছিল “ক্যানবেরি”।নামটি সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী অধিবাসীদের মুখের এনগুন্নাওয়াল ভাষার একটি শব্দ “কামবেরা” থেকে এসেছে, যার সম্ভাব্য একটি অর্থ হল “সম্মেলন স্থল”। কারো মতে অর অর্থ দুই স্তনের মাঝখানের স্হান।এই নামটিই পরে বিবর্তিত হয়ে ১৮৩৬ সালে “ক্যানবেরা” নামটির উৎপত্তি হয় বলে ধারণা করা হয়।
এখানে রাজধানী স্হাপন নিয়ে চমৎকার একটি গল্প শোনালো গাইড।
উনিশ শতকের সূচনালগ্ন।দক্ষিণ গোলার্ধের বিশাল দ্বীপটির পৃথক পৃথক ভুখন্ডের প্রশাসকরা একমত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়া নামের একটি ফেডারেল রাস্ট্র গঠন করবেন।গোল বেঁধেছে রাজধানী নিয়ে।বৃহত্তর দুটি শহর মেলবোর্ন এবং সিডনি তাদের কেউই এই সুযোগ ছাড়তে রাজী নয়।তারা চাইছেন তাদের ওখানেই হবে রাজধানী।অবশেষে মিমাংসা হলো দুটোর কোনটিতেই নয় রাজধানী হবে দুই নগরীর মাঝামাঝি কোন একটা স্হানে।আর এভাবেই ক্যানবেরা রাজধানীর মর্যাদা পায়।নিস্তরঙ্গ এই মফস্বল শহরটিকে সুনিদৃস্ট স্বাপত্যপরিকল্পনায় গড়ে তোলা হয় একটি আধুনিক নগর হিসাবে।
শহরটি সমুদ্র উপকূল থেকে বেশ দূরে। গ্রীস্মে সাধারণত গরম এবং শীতকালে বেশ ঠান্ডা হয়।ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর হলেও হৈ হল্লার দিক থেকে অন্যান্য শহরের চেয়ে একটু কম।সন্ধ্যার পর অধিকাংশ পানশালার বাতি নিভে যায় শুধু শনিবার ছাড়া।তবে শহর জুড়ে রয়েছে অনেক পার্ক আর লেক।সবুজের সমারোহ ঘিরে রেখেছে পুরো শহরটিকে।এর পরিপাটি রুপচি সহজেই মন কাড়ে।রাজধানী শহর বলে ক্যানবেরার বেশীরভাগ লোক চাকুরিজীবি।৮-৪টা অফিস করে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম ।তাই বেশীরভাগ দোকানপাট সন্ধার পর পরই বন্ধ হয়ে যায়।এখানে দর্শনীয় স্হান হলো পার্লামেন্ট হাউজ,ওয়ার মেমোরিয়াল,ন্যাশনাল মিউজিয়াম ইত্যাদি।
আমাদের গাড়ী এসে থামলো ক্যানবেরা শহরের কাছাকাছি অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে।প্রবেশ পথেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত উজ্জল রঙচঙে আর্চযুক্ত গেট।এখানে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী মানুষ এবং তাদের সংস্কৃতির অনেক পরিচয় রাখা আছে।ফাস্ট অস্ট্রেলিয়ান নামের একটি গ্যালারিতে আদিবাসিদের নানান স্মৃতিচিহ্ন রয়েছেঁ।তাদের বাসগৃহের মডেল,আদিবাসী শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম, প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, ইত্যাদি।
দ্য গার্ডেন অবঅস্ট্রেলিয়ানড্রিমস নামের একটি চত্বরে ম্যাপের উপর হেটে হেটে চিনে নেয়া যায় দেশটির বিভিন্ন অন্চল ।এখানে প্রতিটি অন্চলের নাম,তার ভু প্রকৃতি আর কৃস্টি সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় লেখা রয়েছে।
২০০১ সালের ১১ মার্চ মিউজিয়ামটি উদ্ধোধন হয়।৬৬০০ বর্গমিটারের এই মিউজিয়ামটিতে অনেকগুলি ভবন রয়েছে।সবগুলো গ্যালারিই উজ্জল আলোয় আলোকিত।ভেতরে ঢুকার জন্য কোন ফি দিতে হয়না।ভিডিও করা নিশিদ্ধ।তবে এর ভেতরে কোন প্রদর্শনী হলে সেজন্য টিকিট কাটতে হয়।
আমরা ইতোমধ্যে ক্যানবেরা শহরে এসে পৌছে গেছি।সাজানো গোছানো শহর।প্রশস্ত বাঁকবিহীন সড়ক,ঝকঝকে দোকানপাঠ।শহরের বুক চিড়ে বয়ে চলেছে লেক হারালে গ্রিফিন এর ঘন নীল শান্ত আর নিস্তরঙ্গ জলধারা।অন্য দশটি আধুনিক ইউরোপীয় শহরের মতোই।গাইড আশে পাশে বড় বড়ভবনগুলির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।এ ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ ছিলোনা। কেননা এগুলি বেশীরভাগই সরকারী অফিস আদালত।তবে একটা জিনিষ আমার নজর কাড়লো। তাহলো রাস্তার এখানে সেখানে ময়ুরের ছড়াছড়ি।ক্যাঙ্গারু দেখার জন্য এদিক সেদিক তাকালেও তা চোখে পড়ছিলোনা।
এ ব্যাপারে গাইডের দৃস্টি আকর্ষন করলে সে জানালো,ময়ুর দেখতে আকর্ষনীয় হলেও এই পাখিটি এখন সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে ক্যানবেরা শহরে।প্রচুর ময়ুরের বিচরণ এখানে।তারা সড়কে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেজন্য চালকদের গাড়ী চালাতে সমস্যা হচ্ছে।ময়ুরগুলি যখন তখন ঢুকে পড়ছে মানুষের বাড়ী ঘরে।খাদ্য শব্জী খেয়ে ফেলছে।ডিম পাড়ার মৌসুমে তাদের ডাকে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন শহরের বাসিন্দারা।বলা যায় ক্যানবেরা শহরের বাসিন্দারা বিপাকে আছেন এই পাখীটিকে নিয়ে।
গাইড জানায় দুই শতাব্দী আগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরাপোষার জন্য ময়ুর নিয়ে এসেছিলো এখানে ।এখন তা বংশ বৃদ্ধি হয়েএই শহরের বাসিন্দা হয়ে গেছে।মানুষ এই পাখিটিকে নিয়ে অতিষ্ঠ।অনেকে শহরে নিদৃস্ট পরিমান পাখী রেখে অতিরিক্তগুলি মেরে ফেলার জন্য দাবী জানাচ্ছেন।
গাইড জানালো শুধু সমৃদ্ধশালী শহর নয় বসবাসকারী শহর হিসাবেও ক্যানবেরা বিশ্বে শীর্ষ স্হানীয়।সবদিক বিবেচনায় এই শহরটি পৃথিবীর বসবাস উপযোগী সর্বোত্তম স্হান হিসাবে বিবেচিত হয়েছে বেশ কয়েকবার।আয় নিরাপত্তা ,শিক্ষা কর্ম স্বাস্হ্য এবং পরিবেশ ইত্যাদি এসব বিষয় এ ব্যাপারে বিবেচনা করা হয়।
আমাদের গাড়ী এসে থামলো রাজধানী ক্যানবেরার প্রাণকেন্দ্র অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট হাউজের সামনে।পার্লামেন্ট হাউজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শহরের বিভিন্ন স্হাপনা।এর সামনে দাঁড়ালে পুরনো পার্লামেন্ট হাউজ এবং ওয়ার মেমোরিয়াল চোখে পড়ে।আমাদের দেশের সংসদ ভবনের মত এখানে ঢুকার জন্য কোন নিয়মকানুনের কড়াকড়ির নেই।সাথে থাকা ব্যাগটি স্কান করিয়ে সহজেই ঢুকে পরা যায় ভিতরে।দেখতে পারেন সব কিছুই।পার্লামেন্টে দুটি কক্ষ রয়েছে।একটি হলো হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ ।অপরটি উচ্চ কক্ষ সিনেট।হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের চেম্বার সবুজ রংঙ্গের আর সিনেট চেম্বারের রং লাল।হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভে সদস্যসংখ্য ১৫০ জন আর আপার হাউজে ৭৫ জন সদস্য রয়েছেন।এক একটি স্টেটের জন্য ১২ জন সদস্য কাজ করে থাকেন।প্রধান মন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের অফিস মিনিস্ট্রিয়াল উইং হাউজে।
গাইড জানালো অস্ট্রেলিয়ার শিশুদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার জন্য বিভিন্ন স্টেট থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা হয় এখানে।এটা তাদের স্কুলের লেখা পড়ার একটি অংশ।
পারলামেন্ট ভবনে স্পিকার বসেন মাঝখানে উপরের একটি চেয়ারে।তার সামনে রাখা ছোট টেবিলের একটিতে বসেন প্রধানমন্ত্রী ।আর অপরটিতে বিরোধীদের নেতা।দোতালার আসনে আমন্ত্রিত দর্শকদের বসার ব্যবস্হা রয়েছে।
আমরা বেশ সময় নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনটি ঘুরে ঘুরে দেখে এসে বসলাম বাসে।গাইড আমাদের নিয়ে যাবে অন্যকোন দর্শনীয় গন্তব্যে।
Categories
অষ্ট্রেলিয়া

সিডনি- সিটি অব সী গাল

সারা বিশ্বের লোকরা সিডনিকে নানা রকম নামে আখ্যায়িত করে। সুইট সিডনি,হানি সিডনি, ফানি সিডনি বা আরো কতো রকম নামে। আমি এর নামকরণ করেছি ‘সিটি অব সী গাল’।কারণ সিডনিকে ঘিরে রেখেছে সাগর। আর শহরটির এখানে সেখানে উড়াউড়ি করে সী গাল। অন্য পাখীতো আছেই।সিডনি বন্দর ও পোতাশ্রয় হচ্ছে প্রাকৃতিক।শহরের বিভিন্ন অংশে প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন অংশ ডালপালা মেলেছে।ফলে শহরের সর্বত্র প্রশান্ত মহাসাগরের দেখা মেলে।সাগরের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়।শহরের প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে কমপক্ষে ৩০ টির মতো সৈকত রয়েছে।প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য কে সাজিয়ে অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসীরা যে অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতেই পুরো পৃথিবীর মানুষ ছুটে আসে সিডনিতে ।যেমন এসেছি আমি।
পৃথিবীর বহু দেশে বহু সাগর মহাসাগরের সাথে আমার দেখাহয়েছে।ছুটে গিয়েছি সে সব বীচে।কিন্তু এই প্রশান্ত মহাসাগরকে আমি একটা অন্যরকম সমীহ করি।এর নীল জল বা অন্য রকম ঢেউ ই শুধু এর কারণ নয়।এই সমুদ্রতীর পৃথিবীর মোট স্হলভূমিকে ঢেকে দিতে পারে।যার অতল গহ্বরে ডুবে যেতে পারে মাউন্ট এভারেস্ট।তাছাড়া প্রায় ১০ থেকে ১১ হাজার বছর আগে প্রাচীন পৃথিবীতে আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে এক মহাদেশের অবস্থান ছিল। যার নাম ছিলো আটলান্টিস। আয়তনে এশিয়া মাইনর ও লিবিয়ার মিলিত আয়তনের চেয়েও বড় ছিল মহাদেশটি। সবচেয়ে বড় কথা, জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নত, সভ্য আর ক্ষমতাশালী এক জাতির বসবাস ছিল আটলান্টিসে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে সে সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল মহাদেশটি। শোনা যায়, প্রশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনী থাকার কারণে আটলান্টিসের শাসকেরা বর্তমানের ইউরোপ আর আফ্রিকা পর্যন্ত তাঁদের শাসনক্ষমতা বিস্তৃত করেছিলেন।হঠাৎ এক ভুমিকম্পে দ্বীপটি তলিয়ে যায় আটলান্টিকের গর্ভে।আটলান্টিস সমুদ্রগর্ভে ডুবে যাওয়ার কিছু ভূ-প্রাকৃতিক প্রমাণও পাওয়া যায়। কারণ, গড়পড়তা প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব আগে একটি বড় ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে একটি দ্বীপের অর্ধেক সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার প্রমাণ আছে। এ প্রমাণ হাতে নিয়ে গবেষকেরা হারানো আটলান্টিসের খোঁজে চষে ফেলেছেন আটলান্টিক মহাসাগর। তবে সবই বৃথা। এখন পর্যন্ত এর টিকিটিরও খোঁজ পাওয়া যায়নি।তবু বিজ্ঞানীরা হাল না ছেড়ে এখনো সাগরতলে আটলান্টিস খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের দৃঢ় আশা, হারানো আটলান্টিস একদিন না একদিন খুঁজে পাওয়া যাবেই যাবে।
তাই একে সমীহ না করলে কি চলে।!
আজ একটু আগেই নাস্তা শেষ করে লবিতে বসে অপেক্ষা করছিলাম গাইডের জন্য ।বেশ সময় হাতে আছে।রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে পারতাম। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম যদি ঘুমিয়ে পড়ি।কারণ ক্রমাগত জার্নিতে শরীরটা বেশ টায়ার্ড।তাই রুমে গিয়ে বিশ্রাম্র নিয়ে রিস্কটা নিতে মন চাইছিলনা।
আজ কয়েকদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে ঘুরে দেখে বার বার মনে হচ্ছিলো সব গুলো শহরই যেন বেশী বেশী সাজানো।সব কিছু যেন ঝকঝকে ছকছকে।শহরগুলো প্লান করে তৈরি।বৃস্টি হচ্ছে ,রাস্তায় কাদা নেই।বৃস্টির পর যেন আরো উজ্জল মনে হয় শহর।উইন্টারে প্রচুর শীত পড়ে অথচ স্নো পরে কম।বড়বড় সিটি ছাড়া হাই রাইজ ভবন খুব কম।পাহাড়ি এলাকা বলে এই শহরের পথ ঘাটবেশ উঁচু নীচু। শহরের মানুষের মাঝে রয়েছে এক অদ্ভুত শৃঙ্খলাবোধ।রয়েছে মার্জিত আচরণ আর একে অপরকে সহযোগীতা করার প্রবনতা।মেলবোর্নে আমার এক বন্ধু বলেছিলো অস্ট্রেলিয়ায় মাথা পিছু আয় বেশী।তবে দেশটি খুবই এক্সপেন্সিভ।তিনি মজা করে বলেছিলেন -সিডনি গেলে কিডনি বন্ধক রাখতে হয়।অর্থাৎ সারা বিশ্বের মধ্যেখরুচে শহর সিডনি। টোকিও বা সিঙ্গাপুরের পরেই এর স্হান।এই কয়েকদিন সিডনি ঘুরতে গিয়ে নিজেই তার প্রমান পেয়েছি।
কাঁটায় কাঁটায় ৮ টায় এসে গাইড আমাদের তুলে নিঁলো।আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য মাদাম তুসোর যাদুঘর। মাদাম তুশোর মূল জাদুঘরটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। তবে অন্যান্য দেশের মত সিডনিতেও এর একটি শাখা রয়েছে। আর এই জাদুঘরটিও কম আকর্ষণীয় নয়।মিউজিয়ামে ঢুকতেই চোখে পড়ে অস্ট্রেলিয়া নামের সুন্দর দেশটির আবিস্কারক ক্যাপ্টেন কুকের মোমের মুর্তি।পুরো কক্ষ জুড়ে জাহাজের মোটা দড়ি পাল ইত্যাদি।গাইড জানালো মাদাম তুশোর জাদুঘরের পৃথিবী বিখ্যাত অনেক কিছু সিডনির জাদুঘরেও দেখা যায়। খেলাধূলা, চলচ্চিত্র, সঙ্গীতের অনেক বিখ্যাত বিষয়ের সঙ্গে এসব বিষয়ের পৃথিবীবিখ্যাত তারকাদেরও এখানে দেখা যায়। এখানে যেমন রয়েছে গান্ধীর বিখ্যাত মোমের মূর্তির সঙ্গে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, অসামান্য চলচ্চিত্রকার আলফ্রেড হিচকক তেমনি চোখ ফেরানো যায়না এমন সুন্দরী ও চলচ্চিত্র তারকা মেরিলিন মনেরো। কিন্তু মোমের এ জাদুঘরটি অষ্ট্রেলীয় বৈশিষ্টেও উজ্জ্বল। প্রথমেই রাজনীতির কথা বলা যায়। দুজন ব্যাক্তিত্বের কথা বিশেষভাবে প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার। এঁদের মধ্যে প্রথম আবার স্যার হেনরি পার্কস। অষ্ট্রেলীয় রাজনীতিতে তাঁকে প্রায়ই এই ফেডারেশনের স্থপতি বলা হয়।
তুশোর জাদুঘরে অন্তর্ভুক্ত আরেকজন রাজনীতিবিদ হচ্ছেন বব হ্বক ।তিনি ছিলেন লেবার দলের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালরে আইন ও শ্রম বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেন।
তুসোর যাদুঘর দেখে বের হলে গাইড ঘোষণা দিলো আমাদের এখনকার গন্তব্য হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর ক্যানবেরা।অন্য কয়েকটা হোটেল থেকেও কয়েকজন যাত্রী তুললো গাইড।তারপর রওয়ানা দিলো সিডনির উদ্দেশ্যে।
সিডনি থেকে ক্যানবেরা র রাস্তাটা চোখে পড়ার মত।একেবারে সোঝা ।আঁকাবাঁকা নয়।রাস্তায় একবার চা খাওয়ার বিরতি।তারপর সোঝা ক্যানবেরা।
ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর। প্রশাসনিকভাবে এটি অস্ট্রেলীয় রাজধানী অঞ্চলের উত্তর অংশটি গঠন করেছে। ক্যানবেরা একটি আধুনিক ও দ্রুত প্রসারমান শহর। আর্থ-ভৌগোলিকভাবে শহরটি অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বভাগে, অস্ট্রেলীয় আল্পস পর্বতমালার পাদদেশে, একটি সমতল কৃষিপ্রধান অঞ্চলে) তীরে অবস্থিত। সিডনি শহর থেকে ২৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও মেলবোর্ন থেকে ৬৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত শহরটি অস্ট্রেলিয়ার এই দুই প্রধানতম নগরীর মধ্যবর্তী একটি জায়গায় অবস্থিত। জনসংখ্যার বিচারে এটি অস্ট্রেলিয়ার ৮ম বৃহত্তম শহর ও অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরভাগের বৃহত্তম শহর; এখানে প্রায় ৪ লক্ষ লোক বাস করে।
রাস্তায় একটু পর পর স্পিড নির্দেশিকা।এতে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে রাস্তায় স্পিড ক্যামেরা আছে।গাইড জানালো এই ক্যামেরাগুলো হাইওয়েতে ঢোকা এবং বাহির হওয়ার সময় রেকর্ড রাখে।তারপর অতিক্রান্ত দূরত্বকে ভাগ গিয়ে গড়স্পিড বের করে।নির্ধারিত স্পীডের বেশী হলে ডাকে ফাইনের টিকিট পাঠিয়ে দেয়া হয়।
রাস্তার দু পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। হাইওয়ের দুপাশে বিশাল বিশাল মাঠ।বিশাল দেশটির তুলনায় জনসংখ্যা কম তাই অনেক জমিই অনাবাদী পড়ে আছে।কোথাও কোথাও মাঠে ভেড়া ও গরুর পাল চরছে। দু–একটি ঘোড়া দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছে। বাসের ভেতর থেকে মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন দুই হাত মেলে তার সবটুকু দিয়ে সাজিয়েছে এই অপরূপ দেশটাকে।

Categories
অষ্ট্রেলিয়া

সিডনি-সিটি অব কালার’স

আজকের প্রোগ্রাম ছিলো সিডনি সিটি ট্যুর। যে দেশেই যাই চেস্টা করি যে সিটি টাকে কেন্দ্র করে ট্যুর প্রোগ্রামটা আবর্তিত হয় সে সিটিটাকে নিজের মত করে ঘুরে দেখতে ।আর তা সহজ হয় কোন সিটি ট্যুর বুক করলে।।আর এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।৮ঘন্টার এই ট্যুরটি বুক করেই এসেছিলাম নিউইয়র্ক থেকে।অবশ্য এজন্য গাঁট থেকে খসাতে হয়েছে কড়কড়ে ১১৯টি ইউ এস ডলার।এই প্যাকেজের সাথে আছে দুই কোর্সের লান্চ,হোটেল থেকে পিক আপ আর সাথে থাকবে লোকাল প্রফেশনাল গাইড।তিনি এই সময় সীমার মধ্যে শহরের বেস্ট লুক আউটগুলি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবেন।
হোটেলে নাস্তা সেরে অপেক্ষা করছিলাম লবিতে।কাঁটায় কাঁটায় ৮ টায় গাইড এসে তুলে নিলো গাড়ীতে।ট্যুর কোম্পানি একটাই।তবে আজকের গাইড একজন স্বর্ণকেশী মহিলা।চলেন বলনে চৌকশ।গাইডরা সাধারনত যে রকম হয়।গাড়ীতে উঠতেই জানালেন আজকের দর্শনীয় তালিকার প্রথমেই আছে চিড়িয়াখানা দেখা।জীবনে চিড়িয়াখানাতো কম দেখিনি।সেই ঢাকা জু থেকে শুরু।আমার বসবাস নিউইয়র্কের বিখ্যাত ব্রঙ্কস চিড়িয়াখানার পাশে।আর দেশে দেশে ঘুরে অনেক চিড়িয়াখানা দেখেছি।অস্ট্রেলিয়ায় এসে চিড়িয়াখানার দেখার আগ্রহ আমার তালিকায় ছিলোনা।তবে সিটি ট্যুরের তালিকায় চিড়িয়াখানা যে থাকবে তাতো আর আমার জানা ছিলোনা।কথায় বলেনা-পরেছি মোঘলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।তাই অগ্যতা গাইডের ট্যুর সূচিই মেনে নিতে হলো।তবে মনের কোনে সুপ্ত একটা বাসনা ছিলো ক্যাঙ্গারু আর কোয়ালা দেখা।অস্ট্রেলিয়ায় পথ চলতে দু একটা ক্যাঙ্গারু লাফাতে লাফাতে রাস্তা পার হতে দেখেছি।দেখা হয়েছে দু একটা কোয়ালার সাথেও।তবে চিড়িয়াখানার পরিবেশে আরো ভালোভাবে তাদের দেখার সূযোগ হবে এই শান্তনাটা মনে পুষে নিলাম।
গাড়ীতে বসতেই গাইড তার চাকুরি বাঁচানো লেকচার শুরু করলো।চাকুরি বাঁচানো বলছি এজন্য যে,এটা করেই সে তার জীবিকা নির্বাহ করে।তার কোম্পানি এজন্য তাকে অর্থ প্রদান করে।লেকচার দিয়ে মন ভরাতে হবে তার ক্লায়েন্টদের।ক্লায়েন্টদের মন না ভরলে তার কোম্পানীর মালিকের পকেট ভরবেনা।মালিকের পকেট না ভরলে তার পকেটও শুন্য থাকবে।ভাবছিলাম সিটে বসে ঝিমুবো আর এক কান দিয়ে তার কথা শুনবো।কিন্তু তার উপায় নেই।বাসের ইনটেরিয়র লাউড স্পীকারে গাইডের কথাগুলো কানের পর্দায় এসে ধাক্কা দিচ্ছিল।তবে খারাপ লাগছিলোনা তার কথা গুলো।একে তো সুন্দরী মেয়ে ।তারউপর মানুষকে আকৃস্ট করার ক্ষমতা রাখেসে।সিডনির গুনপনার বর্ননা করছিলো সে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিকে বলা হয় ‘সিটি অব কালারস’। সত্যিকার অর্থেই সিডনি রঙের শহর। সারা বছর জুড়েই কোন না কোন উৎসব লেগে থাকে আর তার সাথে তাল মিলিয়ে বদলে যায় শহরের রং। এছাড়াও প্রকৃতির পরিক্রমায় ঋতু বদলের সাথে সাথেও বদল হয় শহরের রংও।বড়বড় উৎসবগুলোর মধ্যে প্রতিবছর ২৬শে জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়া ডে, ফেব্রুয়ারি মাসে চাইনিজ নিউ ইয়ার, মে জুন মাস জুড়ে চলে ভিভিড ফেস্টিভ্যাল, সেপ্টেম্বরে বন্ডাই সমুদ্র সৈকতে ‘ফেস্টিভ্যাল অব উন্ডস’ আর অক্টোবর মাসে আছে হ্যালোইন আর প্রায় পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়েই চলে ক্রিসমাস। তবে সিডনির সবচেয়ে বড় ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে ‘নিউ ইয়ার’ কে বরণ করে নেয়ার চোখ ধাঁধানো আতশবাজি। এছাড়াও বাঙালিদের রয়েছে সারা বছর জুড়েই বিভিন্ন ধরণের মেলা ও উৎসব। এভাবেই সারা বছর জুড়েই সিডনির মানুষ ব্যস্ত রাখে নিজেদের। অস্ট্রেলিয়া ডে এবং চাইনিজ নিউ ইয়ারের পর মে জুনের সবচেয়ে বড় ফেস্টিভ্যাল ছিলো ভিভিড। ঋতু পরিক্রমায় জুন মাস থেকে অস্ট্রেলিয়াতে শীতকাল শুরু হয় তাই তখন শহরটা নিস্তেজ হয়ে পরে। ব্যবসা বাণিজ্যেও কিছুটা মন্দা ভাব পরিলক্ষিত হয়। সেই মন্দা ভাব কাটাতেই মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাসব্যাপী আয়োজন করা হয় এই ফেস্টিভ্যালের। সারা সিডনি বৈদ্যুতিক বিভিন্ন বর্ণের আলোয় সেজে উঠে। সিডনির অপেরা হাউসের দেয়ালে এবং ছাদে খেলা করে বিভিন্ন বর্ণের আলো। তার পাশেই রাতের রয়াল বোটানি গার্ডেন যেন জীবন্ত হয়ে উঠে বিভিন্ন প্রকারের আলোর ঝলকানিতে। তরঙ্গা জু’তে আলো দিয়ে বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি বানানো হয়। ডার্লিং হারবারে বর্ণিল পোশাক পরে হেটে যায় ছয় মিটার উঁচু মেরি ডাইন।
ভিভিড শো দেখতে দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করে সিডনি শহরে। রাতের পুরো সিডনি শহর যেন প্রাণ ফিরে পায়। পায়ে পায়ে মানুষ একটা প্রদর্শনী থেকে অন্য একটা প্রদর্শনীতে ঘুরে বেড়ায়।আলোর এই ঝলকানি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে বাচ্চারা। কিছু সময়ের জন্য হলেও বাচ্চারা যেন রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যায়। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে দশটা অবধি চলে এই প্রদর্শনী। সিডনি হারবারের ছোট বড় জাহাজগুলোও সাজে বিভিন্ন রঙে। অনেকেই জাহাজে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। ট্রেনে বাসে অনেক মানুষ আসা যাওয়া করে। খাবার দোকানগুলোতে থাকে লম্বা লাইন।
কখন যে গাইডের বক্তৃতার সাথে একাত্ম হয়ে গেছি নিজেই টের পাইনি।ধ্যান ভাংলো গাইডের কথায়।এবার নামতে হবে।এসে পড়ছি তরঙ্গা জু’র গেটে।
জু’তে ঢোকার আগে গাইড আমাদের নিয়ে গেলো একটা গাছের কাছে।নাম বল্লো জাকারান্ডা গাছ।শীতের সময় সমস্ত পাতা ঝরিয়ে জ্যাকারান্ডা গাছগুলো থুথুড়ে বুড়োর মতো ঝিম মেরে বসে থাকে। বসন্তকাল আসলে শুরুতেই সেই শুকনো শাখাগুলোতে দেখা দেয় গাঢ় বেগুনী রঙের ফুল। এরপর একসময় ফুলগুলো ঝরে যেয়ে সমস্ত গাছটা আবার সবুজ পত্রপল্লবে ভরে উঠে।বলা হয়ে থাকে বেদনার রং নীল ।আর তাই জ্যাকারান্ডার গাঢ় বেগুনি রংটাকেও আমরা বেদনার রঙ বলতে পারি।গাইডের বর্ননাগুলো শুনে মনে হচ্ছিলো যেন একজন সাহিত্যের অধ্যাপক বক্তৃতা দিচ্ছেন।
আমাদের জু’র গেটে একটু অপেক্ষা করতে বলে গাইড টিকিট কাটতে গেলো।একটু পরেই ফিরে এসে আমাদের নিয়ে ঢুকলো চিড়িয়াখানার ভেতরে।
গাইডকে বল্লাম প্রথমেই ক্যাঙ্গারু দেখাতে।কারণ অস্ট্রেলিয়া কাঙ্গারুর দেশ হিসাবেই বিশ্বে পরিচিত।ক্যাঙ্গারুর ছবি জাতীয় প্রতীক হিসাবে চিত্রায়িত আছে এদেশের কারেন্সি (ডলার)-এর নোটে এবং বেসামরিক বিমান (কোয়ান্টাস)-এ। যেতে যেতে কাঙ্গারুর নাম করণের কাহিনী জানালো গাইড।তাহলো সর্বপ্রথম ১৭৭০ সালে একজন ব্রিটিশ নাবিক, ক্যাপটেন জেমস্ কুক, তাঁর জাহাজ নোঙ্গর করেন অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান সিডনি শহরের পাশে অবস্থিত বোটানি-বে নামক স্থানে। এখানে অবস্থানকালে ক্যাপ্টেন কুক একদিন জাহাজ থেকে নেমে আশে পাশে ঘোরাফেরা করছিলেন। হঠাৎ একটা মাঠে তিনি কিছু অদ্ভূত প্রাণী দেখতে পেলেন। ঐ রকম প্রাণী তিনি আগে কখনও দেখেননি। তাই এগিয়ে গিয়ে নিকটস্থ একজন আদিবাসিকে অঙ্গুলি নির্দেশে দেখিয়ে দিয়ে ইংরেজি ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন – তোমরা ঐ প্রাণীটিকে কি নামে ডাক? আদিবাসি উত্তর করলেন, ক্যাঙ্গারু – আদিবাসিদের ভাষায় যার অর্থ হ’ল ‘আমি তোমাকে বুঝতে পারলাম না’। আর কুক ধরে নিলেন প্রাণীটির নামই হচ্ছে ক্যাঙ্গারু। এরপর ইংরেজদের মাধ্যমে ঐ নামটিই প্রতিষ্ঠিত হয় সারা দুনিয়ায় আর অস্ট্রেলিয়া পরিচিত হয় ক্যাঙ্গারুর দেশ হিসাবে।
আমরা ক্যাঙ্গারু এলাকা দেখা শেষ করে গেলাম কোয়ালা দেখতে।এটিও একটি শান্তশিষ্ট সুন্দর প্রাণী ।যার আছে মায়াবি দুটি চোখ, মুখমন্ডলের অধিকাংশ জায়গাজুড়ে গাঢ় কালো নাক আর ধুসর রং এর নরম তুল তুলে লোম দ্বারা আবৃত শরীর। তবে চোখ দুটি সহজে দেখা যায় না কারন এরা অত্যন্ত ঘুমকাতুরে স্বভাবের এবং প্রতিদিন ১৮ ঘন্টারও বেশী সময় ঘুমিয়ে কাটায়। আরেকটি সুন্দর প্রাণী হচ্ছে পসাম, যাকে ভাসন্ত কাঠবিড়ালিও বলা হয়। কারন এরা দেখতে ঠিক কাঠবিড়ালির মত (আকারে আমাদের দেশের কাঠবিড়ালির তুলনায় ২/৩ গুণ বড়) এবং বাতাসে কিছুক্ষণ ভাসতে পারে। সাধারনতঃ ভাসতে ভাসতে এক গাছ থেকে আরেক গাছে পার হয়ে যায়। এদের শরীরের দুইদিকেই সামনের পায়ের আঙ্গুল থেকে পিছনের পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত বিস্তৃত পাতলা চামড়ার পর্দা আছে যা বাতাসে ভাসতে সহায়তা করে।
গাইড আরো একটা প্রাণী দেখালো যার নাম প্লাটিপুস ।দেখতে অনেকটা পাতিহাঁসের মত, কিন্তু গায়ে পালকের পরিবর্তে লোম আছে।আরো একটি প্রাণী দেখালো যার নাম একিড্না। এর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর গায়ে মোটা লোম এবং সজারুর মত কাঁটা আছে। শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে অথবা কোন কারনবশতঃ ভয় পেলে আত্মরক্ষার্থে এরা কুন্ডলি পাকিয়ে পড়ে থাকে। তখন চতুর্দিকে গায়ের কাঁটাগুলি খাড়া হয়ে যায় এবং শত্রুরা কোন ক্ষতি করতে চাইলে তাকে সে কাঁটা দিয়ে আঘাত করে।
ঘুরে ঘুরে জু’র ভেতরটা দেখছিলাম।একটা মিটিং প্লেস ঠিক করে গাইড আমাদের ছেড়ে দিয়েছে।একটা চটাইম ঠিক করে দিঁয়েছে ফিরে আসার জন্য।স্বাধীনভাবে কিছুটা সমঁয ঘুরতে পারার সুযোগ পেয়ে ভালোই লাগছিলো।মনে হচ্ছিলো যেন একক্ষণ মাস্টার মশাইয়ের তত্বাবধান ছিলাম।হাঁটতে গিয়ে অসাবধানত হঠাৎ একজনের গায়ে মৃদু ধাক্কা লাগলো।আমি সরি বলার আগেই তরুন বয়সের ছেলেটি এমনভাবে কুন্ঠিত হয়ে আমাকে সরি বল্লো যে মনে হলো ধাক্কাটা সেই দিলো। বল্লো,সে এখানকার স্হানীয়।আমি পর্যটক শুনে সে জানতে চাইলো কোন সাহায্য লাগবে কিনা।আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম।
ততক্ষণে গাড়ী ছাড়ার সময়হয়ে গেছে।গিয়ে দেখলাম অন্যরা সব আমার জন্য অপেক্ষা করছে।আমি বসতেই গাড়ী ছেড়ে দিলো হোটেলের উদ্দেশ্যে।বসে বসে ভাবছিলাম যে দেশটিতে দুইশত বছর আগে বৃটিশরা অপরাধীদের ফেলে আসতো আজ তাদের উত্তরসূরীরা মানুষদের সাথে কত ভদ্র আচরণ করে।পথে ঘাটে অপরিচিত মানুষকেও হাসি দিয়ে হাই,হ্যালো বলে।যদি ট্রাফিক আইন না মেনেও ভুল করে রাস্তা পার হতে চান তাহলে আপনার পেছনের গাড়ীর ড্রাইভার একটুও বিরক্ত না হয়ে গাড়ী থামিয়েআপনাকে এগিয়ে যেতে হাত ইশারা করবে।ভাবছিলাম এই দেশটি থেকেও আমাদের অনেক শেখার আছে।
Categories
অষ্ট্রেলিয়া

হানি সিডনি ফানি সিডনি

সিডনি শহরের রাস্তাগুলো সুপ্রশস্ত।পথচারীরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে।কোন রিক্সা বা স্কুটার জাতীয় যানবাহন চোখে পড়লোনা।ট্যাক্সি এবং বাস চলছে রাস্তায়।রাস্তাগুলোর নামকরণ বৃটিশ স্টাইলে বৃটিশ ব্যক্তিদের নামে।অবশ্য বলা যায় দেশটি গোড়াপত্তন বৃটিশদের হাতেই।জেমস কুক নামে এক নাবিকআঠার শতকের শেষভাগে ভাগ্যান্বেষনে এখানে পা রাখেন। তারপর জাহাজ ভরে এখানে পাঠানো হলো কিছু অপরাধি।ক্রমশ আদিবাসীদের কাঁছ থেকে পুরো দ্বীপ দেশটি কেড়ে নিলো তারা।এরপর এখানে ক্রমশ ভীড়করতে লাগলো সারা বিশ্বের উচ্তাভিলাষী কিছু মানুষ। বলা যায় এভাবেই উদ্বাস্তুরাই দখল করে নিলো দেশটি।

অস্ট্রেলিয়ার ছয়টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানি সিডনি সবচেয়ে প্রাচীন ,বৃহত্তম এবং ব্যস্ত শহর।এটি পৃথিবীর সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে একটি । শহরটি প্রশান্ত মহাসাগরের কুল ঘেঁষে গড়ে উঠায় এর যে কোন স্হান থেকে সাগরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।শহরের বিভিন্ন অংশে প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন অংশ খাঁড়ির মধ্য দিয়ে শহরে ঢুকে পড়েছে। শহরের প্রায় ২০ কালোমিটার জুড়ে রয়েঁছে কমপক্ষে ৩০ টি সৈকত।
গতকাল দুপুরের পর সিডনি এসে স্হানীয় একজন বাংলাদেশীকে নিয়ে লক্ষ্যহীনভাবে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছি।অফিসিয়ালি সিডনি ট্যুর আজ থেকে।এজন্য অনেকগুলো গাইডেড ট্যুর বুকিং করে এসেছি নিউইয়র্ক থেকে।এরই ধারাবাহিকতায় আজকে আমার সিডনির বিখ্যাত অপেরা হাউজ ট্যুর।
কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৮ টায় গাইড এসে তুলে নিল আমার আবাসস্হল সিডনি হিলটন হোটেলের লবি থেকে।১৪ সিটের একটি লাক্সারি মার্সিডিজ হাইটপ ভ্যান।যে কয়েকটা সিট খালি ছিলো আমাদের হোটেল থেকে উঠা টুরিস্ট দিয়ে তা ভরে গেলো। গাড়ী ছুটে চল্লো সিডনি অপেরা হাউজের দিকে।
সিডনি শহরের রাস্তাগুলো সুপ্রশস্ত।পথচারীরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে।কোন রিক্সা বা স্কুটার জাতীয় যানবাহন চোখে পড়লোনা।ট্যাক্সি এবং বাস চলছে রাস্তায়।রাস্তাগুলোর নামকরণ বৃটিশ স্টাইলে বৃটিশ ব্যক্তিদের নামে।অবশ্য বলা যায় দেশটি গোড়াপত্তন বৃটিশদের হাতেই।জেমস কুক নামে এক নাবিকআঠার শতকের শেষভাগে ভাগ্যান্বেষনে এখানে পা রাখেন। তারপর জাহাজ ভরে এখানে পাঠানো হলো কিছু অপরাধি।ক্রমশ আদিবাসীদের কাঁছ থেকে পুরো দ্বীপ দেশটি কেড়ে নিলো তারা।এরপর এখানে ক্রমশ ভীড়করতে লাগলো সারা বিশ্বের উচ্তাভিলাষী কিছু মানুষ। বলা যায় এভাবেই উদ্বাস্তুরাই দখল করে নিলো দেশটি।
গাইড তার দিকে সকলের দৃস্টি আকর্ষন করলো।কিছু তথ্য জানালো সিডনি শহর সম্পর্কে।বল্লো ক্ষেত্রফলের হিসেবে সিডনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহরগুলোর একটি। সিডনি শহরের ক্ষেত্রফল ১৫৮০ বর্গকিলোমিটার। লন্ডন শহরের প্রায় সমান। আর নিউইয়র্ক শহরের দ্বিগুণ।  নিউইয়র্ক শহরের ক্ষেত্রফল ৭৮০ বর্গকিলোমিটার। আমস্টার্ডাম শহরের ক্ষেত্রফল মাত্র ১৬৭ বর্গকিলোমিটার আর বিখ্যাত প্যারিসের মাত্র ১০৫ বর্গকিলোমিটার। সে তুলনায় সিডনি জায়ান্ট সিটি।এই শহরে মাত্র সাড়ে পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ বাস করে। সরকারি হিসাব মতে এখানে সাড়ে চৌদ্দ লাখ বাসা আছে। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতি হলো সিডনিতে।  তারপরও দেখা যাচ্ছে টোকিওর একজন বাসিন্দার চেয়ে ছয়গুণ বেশি জায়গা নিয়ে থাকে একজন সিডনিবাসী। সিডনি শহরে যারা থাকে তাদের প্রায় অর্ধেকেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। সিডনি যুবকদের শহর। সিডনি শহরে নাকি ১৮০টি দেশের নাগরিক বাস করে। ১৪০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে তারা। আর এজন্যই কালচারাল মেলটিং পট বলা হয় সিডনিকে ।
   গাইড তার বক্তৃতা শেষ করলো ।বল্লো নামতে হবে গাড়ী থেকে।সামনে চেয়ে দেখলাম বিশ্বের অন্যতম নির্মান শৈলি সিডনি অপেরা হাউজ আমার সামনে।অসাধারন স্হাপত্যে নির্মিত অপেরা হাউজটি দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো পানির উপর কয়েকটি সাদা নৌকার পাল ভাসছে।গাইড আমাদের অপেরা হাউজের বাইরে দাড়করিয়ে চলে গেলো টিকিট আনতে।
একটু পরই টিকিট নিয়ে ফিরে আসলোসে ।বল্লো অপেরা হাউজের ভেতরে ট্যুরটা শুরু হবে আরো আধা ঘন্টা পর।এটা তাদের নিজস্ব গাইডেড ট্যুর।আমাদের গাইড সাথে থাকবে বটে।তবে ট্যুর নিয়ন্ত্রন করবে এদের নিজস্ব গাইড।তাঁরাই সাথে নিয়ে ঘুরে দেখাবে।ভেতরের ট্যুর শেষ হলে আমাদের গাউড হারবার ব্রীজ সহ অন্যান্য দর্শনীয়স্হানগুলি ঘুরে দেখাবে।
হাতে থাকা স্বল্প সময়টা কাজে লাগানো গাইড।শুরু হলো এর বর্ননা।পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর স্হাপত্য সিডনি অপেরার অবস্হান বন্দরের বেনেলং পয়েন্টে।এটি মহাসাগরের একপ্রান্তে তৈরি করা হয়েছে যা দেখতে অনেকটা উপত্যকার মতো।১৯৫৬ সালে অপেরা হাউজটি নির্মাণের জন্য নকশা আহ্বান করা হয় ।সারা বিশ্ব থেকে ২৩৩ টি নকশা জমা পড়ে। এ নকশাগুলোর মধ্য থেকে সুইডেনের স্হপতি জন অ্যাডজেনের জিজাইনটি চুড়ান্ত হিসাবে ঘোষনা করা হয়।১৯৫৯ সালে এর নির্মান কাজ শুরু হয়ে শেষ হয়১৯৭৩ সালে।প্রায় ১০ হাজার কর্মী এর নির্মানে অংশ নেন।১.৬২ হেক্টর জায়গার উপর নির্মিত অপেরা হাউজটি লম্বায় ১৮৩ মিটার এবং প্রসঙ্গে ১২০ মিটার।উচ্চতা ৬৫ মিটার যা প্রায় ২৩ তলার সমান।অপেরা হাউজের ভেতরের অংশে রয়েছে ১০০০টি কক্ষ ২৬৯০ টি আসন সহ একটি কনসার্ট হল,পাঁচটি ড্রামা থিয়েটার এবং৩৯৮ সিটের প্লে হাউজ এবং ৪০০ লোক কাজ করার মত স্টুডিও ।কনফিগারেশন পরিবর্তন করে এইসব হলের আয়তন ও সিট ক্যাপাসিটি বাড়ানো বা কমানো যায়।প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ এই অপেরা হাউজটি পরিদর্শনে আসেন।অপেরা হাউজের ছাদ তৈরিতে ১০ লাখ টাইলস ব্যবহার করা হয়।এএর নির্মান বাবদ খরচ হয় ১০ কোটি ২০ লাখ ডলার। ১৯৭৫ সালের ২০ অক্টোবর রানী এলিজাবেথ অপেরা হাউজটি উদ্ধোধন করেন।২০০৭ সালে ইউনেস্কো এই স্হাপনাটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্ট এর তালিকাভুক্ত করে।
একটু পর অপেরা হাউজের নিজস্ব গাইড এসে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলো।আমরা ছাড়াও এই গ্রুপে অন্য দেশ থেকে আসা কঁযেকজন পুরুষ মহিলা ছিলো।একটা রুম পেরিয়ে যাবার সময়ে রুমের কার্যক্রমের বর্ননা দিচ্ছিলো গাইড।তিনি জানান সিডনি অপেরা হাউজটি এখন সিডনির সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।প্রতিদিনের মঞ্চ নাটক বা দুনিয়াখ্যাত শিল্পীদের স্টেজ শো’র পাশাপাশি নববর্ষের প্রথম প্রহর উদযাপনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে সিডনির বেনেলং পয়েন্ট। এখানেই রয়েছে হারবার ব্রিজ। পুরো এলাকায় আলোকসজ্জার পাশাপাশি লেজার শো’র আয়োজন করা হয়। চীনা চন্দ্রবর্ষ উদযাপনেও এখানে লেজার শো’র আয়োজন করা হয়।
এসবের পাশাপাশি সিডনির সবচেয়ে উপাদেয় খাবারও পাওয়া যায় এখানকার রেস্টুরেন্টে। সিডনির সবচেয়ে নামী শেফরাই এখানে খাবার তৈরী করেন। এখানকার অপেরা কিচেনে রয়েছে মোট ৬০টি ডিশ।
বেনেলং পয়েন্টে নৌবন্দরের পাশে বসে খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। নদীর পারে অপেরা হাউজের চারদিকেই আছে এই রেস্টুরেন্ট। হালকা খাবার, কফি, মিস্টান্ন সবকিছুরই ব্যবস্থা আছে সেখানে।
অপেরা হাউজের ভেতরটা ঘুরে দেখে আমরা বাইরে এলাম।আজকের মত ট্যুর এখানেই শেষ।কাল সকাল থেকে আবার অন্যান্য দর্শনীয় স্হানে নিয়ে যাবে গাইড।আমাদের গন্তব্য স্হল সিডনি হোটেল খুব দূরে নয়। তাই গাইডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম হোটেলের দিকে।
Categories
অষ্ট্রেলিয়া

সৌন্দর্যের শহর সিডনি

ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ার অঙ্গরাজ্য ছয়টি।যেমন ,তাসমানিয়া,ভিক্টোরিয়া,নিউসাউথওয়েলস,কুইন্সল্যান্ড, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া ।এবারকার ভ্রমনে ইতোমধ্যে আমি ভিক্টোরিয়া এবং কুইন্সলান্ড ঘুরে এসেছি।বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দেখে আজ বিকেলে এসে পৌচেছি সিডনি।হ্যামিল্টন আইল্যান্ড এয়ারপোর্ট থেকে সিডনি পৌছাতে সরাসরি ফ্লাইটে সময় লেগেছে মাত্র আড়াই ঘন্টা ।আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম এয়ারপোর্ট থেকেই ট্রেনে সিডনি বিজন্যাস ডিস্ট্রিক্ট এলাকায় আমার হোটেল সিডনহিলটনের খুব কাছেই নামা যায়।আসলেই তা হলো ।ট্রেন থেকে নামতেই চোখে পড়লো সিডনি হিলটনের সাইন।ট্যাক্সি নিতে হলোনা।সুটকেস ঠেলে নিজেই পৌছে গেলাম হোটেলে।
হিলটন আমার প্রিয় হোটেলের একটি।শুধু সেবার মানের জন্য নয়।অন্য কারণেও এই হোটেলটির প্রতি আমার দুর্বলতা রয়েছে। আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশী হলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।বসবাস করি নিউইয়র্কে।এই হোটেলের প্রধান কার্যালয় আমার পাশের স্টেট ভার্জিনিয়ার ম্যাকলিনে।যেজন্য বিদেশে কোথাও গেলে এই হোটেলটিকে আমার আপনজনের মত মনে হয়।
হিলটন হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টস, সংক্ষেপ ‘ব্র্যান্ড’ নাম হিলটন আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন। ১৯১৯ সালে কোনার্ড হিলটন এটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বব্যাপী চার হাজার ৮৭৫টি শাখা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এসব হোটেলের রুমসংখ্যা সাত লাখ ৯৬ হাজার ৪৪০টি।
হোটেলে লাগেজ রেখে বের হলাম লান্চ করার জন্য।যদিও সকালে আমি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ হোটেল থেকে পেট পুরে নাস্তা করেই বিমানে উঠেছিলাম।তারপর বিমানেও আতিথেয়তার কমতি ছিলোনা।তারপরও খেতে বের হবার অন্য কারণ ছিলো।তাহলো আমি বিশ্বের যেখানেই যাই সেখানে রিভলভিং রেস্টুরেন্ট পেলে তার খাবার টেস্ট করতে ভুলিনা।সিডনিতে আমার হোটেল বুক করার সময়ই জেনেছিলাম এর পাশেই আছে ‘সিডনি টাওয়ার আই’।এটি বিশ্বের সাতটি উঁচু টাওয়ারের একটি।এটি সিডনি সিটির শুধু অন্যতম সৌন্দর্য ই নয় এর অবজারভেশন টাওয়ার থেকে পুরো সিডনি শহরটি দেখা যায়।৩৬০ ফুট উচ্চতার এই টাওয়ারটিতে রয়েছে একচি ঘুর্নায়মান রেস্টুরেন্ট।এখান থেকে সূর্যাস্তও দেখা যায়।
হোটেলে ঢোকার সময়েই বাইরে থেকে টাওয়ারের চূড়া চোখে পড়েছিলো।নীচে সুন্দরী রিসেপসানিস্টকে টাওয়ারে যেতে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে বল্লে জানালো হোটেল থেকে বের হয়ে ডান দিকে মোড় নিলেই সিডনি টাওয়ার ।একেবারেই হাঁটা দূরত্ব-ট্যাক্সির প্রয়োজন নেই।তার কথামতই সামান্য হেঁটেই দেখা মিল্লো টাওয়ারের ।
টাওয়ার ভবনে একটি বিরাট মল।মলে ঢুকতে কোন ফি দিতে হয়না।তবে টাওয়ারে উঠতে বড়দের ২৬ আর টিনেজ হলে ১৪ অস্ট্রেলিয়ান ডলার দিয়ে টিকিট কাটতে হয়।
৩৬০ ফুট উচ্চতার টাওয়ারে উঠতে সময় লাগলো মাত্র ৫ মিনিট।খাওয়ার আগে গেলাম অবজারভেশন টাওয়ারে।কাঁচের জানালা দিয়ে খালি চোখে দেখলাম সিডনি হারবার,অপেরা হাউজ,বোটানি বে,ও প্রশান্ত মহাসাগর।অছাড়া একটু পর পর লাগানো আছে বাইনাকুলার।এতে চোখ রেখে দেখা গেল অদূরের ফুটবল ক্রিকেট স্টেডিয়াম,মাদাম তুসোর যাদুঘর, সিডনি যাদুঘর সহ আরো অনেক স্হাপনা।
এরপর খেতে গেলাম ঘুর্নায়মান টাওয়ার রেস্টুরেন্টে।এটা লেভেল ফোরে।নাম -৩৬০ বার এন্ড ডাইনিং।বুফে খাবারের দাম ৯৫ অস্ট্রেলিয়ান ডলার।যে কোন দেশের বুফেতে সে দেশের সব রকম খাবার টেস্ট করা যায়।তা ছাড়া যেহেতু চয়েস অনেক থাকে সেজন্য হালাল হারামের ভয় থাকেনা।এখানেও তার ব্যতিক্রম ছিলোনা।তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিলো আনিত মহাদেশীয় অন্যান্য খাবারের সাথে সাদা ভাতের সাথে ছিলো ঘন ডাল।নানা খাবারে উদরপুর্তি করে খাওয়া হলো।
খাওয়ার মাঝখানে এলো ফটো গ্রাফার।আমার চেহারা দেখেই বাংলায় কথা বল্লো।নাম বল্লো আজিম।বাংলাদেশের সিলেটের ছেলে।ইচ্ছে না থাকলেও দেশী ভাই বলে ফটো রাজী হলাম।বল্লাম একটু পর আসতে।খাওয়া শেষ হলে ছবি তুলবো।
খাওয়া শেষে কফি খাচ্ছি এমন সময় এলো আজিম।ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন অ্যাংগেল থেকে ছবি তুল্লো।আমাকে বসিয়ে রেখেই ছবি গুলো প্রিন্ট করে একটা এলবাম বানিয়ে নিয়ে এলো।অনেক গুলো ছবি কোনটার ব্যাকগ্রাউন্ডে সিডনি হারবার,কোনটার সিডনি অপেরা আরো নানা ভিউ।বুঝলাম দেশী ভাই বলে আদর শুধু যত্ন করে ছবিই তুলেনি মনযোগ দিয়ে প্রিন্ট ও করেছে।পেমেন্ট করে নীচে নামার জন্য বের হলাম।আজিম বল্লো একটু অপেক্ষা করতে।আজ তার ডিউটি শেষ।আমার সাথে সেও নীচে নামবে।টাওয়ারের অন্যান্য ফ্লোর গুলোও সে ঘুরে দেখাবে।
আজিম জানালো আমি ইচ্ছে করলে এখানে টাওয়ার সিনেমা হলে ছবি দেখতে পারি।এটার একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে।পাঁচ মিনিটের ছবিতে যখন যে দৃশ্য আসে সে অনুভূতি সৃস্টির জন্য সে পরিবেশ তৈরি করা হয়।পানির দৃশ্য দেখালে দর্শকদের পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হয়।আবার আগুনের দৃশ্যে হলের ভেতরে ধোঁয়া ছড়ানো হয়।ইত্যাদি।টিকিটের সঙ্গে ফোর ডি চশমা দেয়া হয়।সময় নেই বলে সিনেমা দেখা থেকে বিরত থাকলাম।তা ছাড়া সিনেমা দেখার চাইতে আজিমের সাথে ঘুরে দেখা আমার কাছে বেশী আকর্ষনীয় ছিলো।
আজিম জানালো সেদিনের মত তার কাজ শেষ।বাসায় যাবে।সে ব্যাচেলর মানুষ।একাই থাকে।কোন তাড়া নেই।আমি চাইলে সে আমাকে সঙ্গ দিতে পারে।শুনে খুশী হলাম।দেশী ভাইকে নিয়ে ঘুরতে পারলে অনেক দেখা এবং জানা যাবে।বিজন্যাস ডিস্ট্রিক্ট দিয়ে যাচ্ছিলাম পায়ে হেঁটে।সুপ্রশস্ত রাস্তা।এলিভেটেড হাইওয়ে।মনোরেল,সাবওয়ে সবই সবই আছে।রাস্তায় রিক্সা বা স্কুটার কিছুই নেই।ট্যাক্সি এবং বাস চলছে রাস্তায়।আজিম জানালো নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানি সিডনি সবচেয়ে প্রাচীন এবং ব্যস্ত শহর।পাহাড়কেটে তৈরি এই শহরকে ঘিরে রয়েছে মনোরেল।পাহাড়ী এলাকা বলে এখানকার পথঘাট বেশ উঁচু নীচু।এমনিতেই এই শহরে বিভিন্ন জাতির বসবাস।তারপর সারা বছর সারা বিশ্ব থেকে আসা পর্যটকরা শহরটিকে আরো বর্ণময় করে তুলে।
সিডনি টাওয়ার থেকে বেরিয়ে অল্প দূরত্বে আজিম আমাকে নিয়ে গেলো চায়না টাউনে।বিশাল এলাকা নিয়ে সিডনির চায়না টাউন।তবে পৃথিবীর সব চায়না টাউনই চরিত্রগতভাবে এক।। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট,হরেকরকম চাইনিজ পন্য সামগ্রীর দোকান,ম্যাসেজ পার্লার ইত্যাদি।এসব চাইনিজ মার্কেটে ঢুকলে মনে হয় চায়নাতে আছি।চারদিকে শুধু চাইনিজ আর চাইনিজ।তাদের কিচির মিচির বাক্যালাপ।তবে ফরাসি,হিন্দী, এবং অন্যভাষার কথা বার্তাও কানে আসছিলো।পৃথিবীর সব দেশে বসবাসরত চাইনিজরা ব্যবসা বানিজ্য করে অর্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করে।আর এজন্যই বোধহয় চায়না এখন বড়অর্থনৈতিক শক্তির দেশ হতে পরিচিত হতে পেরেছে।
আজিম জানালো চায়না টাউনে চাইনিজ ছাড়াও নানান দেশের খাবার রেস্টুরেন্ট আছে।যেমন ভিয়েতনামিজ,ইতালিয়ান,,জার্মানি,মালয়েশিয়ান,ইন্দোনেশিয়ান সহ নানান দেশের খাবার।এক জায়গায় অত দেশের খাবার নাকি সিডনি তেই আছে।যা অস্ট্রেলিয়ার অন্য শহরে নেই।আমি তাকে জানালাম আমাদের নিউইয়র্কের চায়না টাউনে নানা দেশের খাবার রেস্টুরেন্ট তো আছেই।তারপরও লিটল ইতালি নামক একটি এলাকা আছে যেখানে একসাথে বহু ইতালিয়ান খাবার দোকান রয়েছে।শুনে সে খুব অবাক হলো।
আজিমের সাথে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি ডার্লিং হারবারে।সমুদ্রের একটা অংশ এখানে ভেতরে ঢুকে শান্ত শিস্ট হয়ে যেন চুপটি করে বসে আছে।পানি স্বচ্ছ এবং টলোমলো।পানিতে ভাসছে অসংখ্য প্রমোদ তরী।ভাসমান জাহাজগুলোয় কোনটায় পার্টি হচ্ছে।তীরে থেকেও হৈ হল্লা শোনা যাচ্ছে।আজিম জানালো দিনের বেলা আসলে জাহাজে করে পানি থেকে অপেরা হাউজ,হারবার ব্রীজ সহ আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করার ব্যবস্হা আছে।জাহাজেই ডিনার বা লান্চের ব্যবস্হা আছে।সিডনির অনেক বিখ্যাত দর্শনীয় স্হান এই ডার্লিং হারবারে।যেমন সিডনি হারবার ব্রীজ ,সিডনি অপেরা হাউজ, ইত্যাদি ।এগুলি ঘুরে দেখার জন্য নিউইয়র্ক থেকেই গাইডেড ট্যুর বুক করে এসেছি।তবে বাইরে থেকে অপেরা হাউজ, হারবার ব্রীজ দেখলাম।রাতের রঙ বেরঙের আলোতে অপেরা হাউজ এবং হারবার ব্রীজ দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল।
হাঁতে হাঁটতে চায়ের পিপাসা পাচ্ছিল।একটু ক্লান্তিও ভীড় করছিলো শরীরে।আর শরীরেই বা দোষ কি। গত কদিন ধরেই শরীরটাকে বিরতিহীন খাটাচ্ছি।আজিমকে বলতেই সে আমাকে অল্প দূরেই একটা কফি শপে নিয়ে গেলো। ছোট্ট দোকানটাতে মানুষের ভীড়ছিলো প্রচুর।আমাকে বাইরের একটা বেন্চে বসিয়ে আজিম কফি আনতে গেলো।কফির দাম দিতে চাইলেও সে নিলোনা।একটু পরেই কফি নিয়ে ফিরলো সে।সাথে একটা বড়সড় পিৎজা। পিৎজা দেখে যেন ক্ষিধেটা চাগিয়ে উঠলো।চারদিকে ঘুরে দেখার আনন্দে এতই মগ্ন ছিলাম যে একক্ষণ ক্ষুধা অনুভব করিনি।কে যেন বলেছিলো ক্ষুধা পেটে সৌন্দর্য উপভোগ করা কঠিন।তাই দেরী না করে খেতে বসলাম।পেট পুরে পিৎজা খেয়ে আয়েশ করে চুমুক দিলাম কফিতে।আজিম বল্লো ,অস্ট্রেলিয়ানরা কফি পাগল।মিটিং য়ে কফি,বেড়াতে গেলে কফি,আড্ডায় কফি।কফি না হলে তাদের চলেই না।
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৯ টা ছুঁই ছুঁই করছে। আজিমকে বল্লাম হোটেলে পৌছে দিতে।
-হাবিব রহমান
Categories
অষ্ট্রেলিয়া

ব্রিসবেনে এক রাত

ব্রিসবেন অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চলের একটি শহর। এটি কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী এবং ব্রিসবেন নদীর তীরে মোরটন উপসাগরের কাছে অবস্থিত একটি সমুদ্র বন্দর। ব্রিসবেন নদীতে ড্রেজ করে শহরটিতে সমুদ্রগামী জাহাজের আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পশম এ শহরের প্রধান রপ্তানিকৃত দ্রব্য। অন্যান্য রপ্তানির মধ্যে আছে বরফজমা মাংস, চামড়া, চিনি, দুগ্ধজাত দ্রব্য, ভুট্টা, মুক্তার খোল এবং কয়লা। শহরটি রেলপথের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত প্রধান স্থানগুলির সাথে যুক্ত। গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্র ব্রিসবেনে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চামড়া পাকাকরণ, মোটরযান জোড়া লাগানো, মদ চোলাইকরণ, এবং কাঠ, কাপড়, তামাকজাত দ্রব্য, বুট ও জুতার উৎপাদন করা হয়।

 

গ্রেট ব্যারিয়ার রিফকে বলা হয় বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের একটি।ইউনেস্কো ১৯৮১ সালে এটাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বলে ঘোষনা দিয়েছে।এছাড়া মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর যে কয়েকটা বস্তু দৃশ্যমান তার মধ্যে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ অন্যতম।অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করবো আর এই রিফটি দেখবোনা তাতো হবার নয়!তাই দর্শনীয় তালিকায় এই নামটি আগেই লিস্ট করেছিলাম।
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী পার্থ ভ্রমন শেষে আজ বিকালের ফ্লাইটে এসে যাত্রা বিরতি করেছি ব্রিসবেন এয়ারপোর্টে।নিউইয়র্ক থেকে কোন অবস্হাতেই সরাসরি কোন ফ্লাইট ম্যানেজ করতে পারিনি।যেজন্য রাস্তায় ব্রিসবেন এয়ারপোর্টে বিরতি দিতে হবে প্রায় ১৩ ঘন্টা ।কোয়ানটাস এয়ারের বিমানটি পার্থ ছেড়েছে বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে।রাত নয়টায় এসে ল্যান্ড করেছে এখানে।হ্যামিল্টন আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে আমার পরবর্তী ফ্লাইট পরদিন সকাল সাড়ে দশটায়।এই দীর্ঘ সময় এয়ারপোর্টে বসে থাকা বিশেষ করে রাত জাগা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।তাই আগে থেকেই এয়ারপোর্টের বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেলে একটি রুম বুক করে রেখেছিলাম।এতে আমার এক ঢিলে দু পাখী মারা হবে।প্রথমত:রাত জাগতে হবেনা।আর দ্বীতিয়ত রাতে কিছুটা সময় শহরটি ঘুরে দেখতে পারবো।
ভ্রমনে বিমান বিরতির এই সুযোগটা সব সময় আমি কাজে লাগাই।২০১৮ সালে স্কানডেনেভিয়ান দেশগুলি ভ্রমনের সময় নরওয়ে থেকে সুইডেন যাবার পথে দীর্ঘ বিরতিতে ট্রমসো শহরটি ঘুরে দেখেছিলাম।আইসল্যান্ড থেকে কায়রো যাবার সময় এথেন্সে লম্বা বিরতিতে শহরটি ঘুরে দেখার সূযোগ হয়েছিলো।
আগেই জেনেছিলাম ব্রিসবেন অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চলের একটি শহর। এটি কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী এবং ব্রিসবেন নদীর তীরে মোরটন উপসাগরের কাছে অবস্থিত একটি সমুদ্র বন্দর। ব্রিসবেন নদীতে ড্রেজ করে শহরটিতে সমুদ্রগামী জাহাজের আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পশম এ শহরের প্রধান রপ্তানিকৃত দ্রব্য। অন্যান্য রপ্তানির মধ্যে আছে বরফজমা মাংস, চামড়া, চিনি, দুগ্ধজাত দ্রব্য, ভুট্টা, মুক্তার খোল এবং কয়লা। শহরটি রেলপথের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত প্রধান স্থানগুলির সাথে যুক্ত। গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্র ব্রিসবেনে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চামড়া পাকাকরণ, মোটরযান জোড়া লাগানো, মদ চোলাইকরণ, এবং কাঠ, কাপড়, তামাকজাত দ্রব্য, বুট ও জুতার উৎপাদন করা হয়। ব্রিসবেন একটি সুপরিকল্পিত নগরী। এর রাস্তাগুলি চওড়া, এখানে বহু নগর উদ্যান ও অনেক আধুনিক দালান আছে। উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে আছে সংসদ ভবন, টাউন হল বা নগর ভবন, ব্রিসবেন জাদুঘর এবং কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮২৪ সালে ব্রিটেনের অপরাধীদের রাখার জন্য ব্রিসবেন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও প্রশাসক, তৎকালীন নিউ সাউথ ওয়েল্‌স রাজ্যের গভর্নর টমাস ব্রিসবেনের নামে শহরটির নামকরণ করা হয়। শহরটিকে ১৮৪২ সালে বসতি স্থাপনের জন্য খুলে দেয়া হয় এবং ১৮৫৯ সালে এটি নতুন রাজ্য কুইন্সল্যান্ডের রাজধানীতে পরিণত হয়।
ব্রিসবেন শহরটি ‘সান শাইন স্টেট’ নামেও পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি বলা চলে এই ব্রিসবেনকে।এখানে পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি যেমন ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড’ আছে। সারা বিশ্ব থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করতে আসে কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই শহর জুড়ে বহুমুখী সংস্কৃতির চর্চা সারাবছর লেগেই থাকে। এই রাজ্যের আয়ের একটা বড় অংশ আসে বিদেশি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ থেকে।
ব্রিসবেনের আবহাওয়া অনেক ভালো। বরফ পরে না। সারাবছরই তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। যারা বিভিন্ন ঋতু পছন্দ করেন, তাদের জন্য তো ব্রিসবেন অসাধারণ। বছরের শেষের দিকে শুধু মাস দুয়েকের মত গরম পড়ে। বাংলাদেশে যখন ঠাণ্ডা পরে এইখানে তখন গরম পড়ে।
আগেই জেনেছিলাম ব্রিসবেনে প্রচুর বাংলাদেশীর বসবাস।আর এর পরিচয়ও পেলাম হাতে নাতে।এয়ার পোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়াতেই সিরিয়াল অনুয়ায়ী যে ট্যাক্সিটি এসে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো তার চালক একজন বাংলাদেশী।বিদেশে অনেক বাংলাদেশীকে দেখেছি তারা হীনমন্যতায় ভুগেন।পরিচয় দিতে কুন্ঠা বোধ করেন।দেশে হয়তো ভালো অবস্হানে ছিলেন।বিদেশে গিয়ে গাড়ী চালাচ্ছেন এটাই হয়তো তার কুন্ঠার বড় কারন।
আমার চালক আলমগীর খুবই সপ্রতিভ একজন মানুষ।দেশের বাড়ী কুমিল্লায়।দীর্ঘদিন এ দেশে আছেন।তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বল্লাম যাচ্ছি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দেখতে।যাত্রা বিরতিতে থেমেছি এখানে।তিনি যদি অনুগ্রহ করে শহরটি ঘুরে দেখান তাহলে খুশী হবো।তিনি মিটার চালু করে নেমে পড়লেন রাস্তায়।
ব্রিসবেনের বড়রাস্তা ধরে গাড়ী চলছে শহরের দিকে।আলমগীর জানান,বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্রিসবেন এখানে আম্ব্রেলা সংগঠন।তাদের উদ্যোগে এখানে আড়ম্বরের সাথে পালিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো।এখানকার কিয়ংপার্কে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা বর্ষবরণ শোভাযাত্রা।
তিনি আরো জানান ,৯০ দশকের দিকে ব্রিসবেনে বাংলাদেশীদের পরিমান ছিলো হাতে গোনা।আর এখন তা বেড়ে হয়েছে কয়েকহাজার।আছে বাংলা স্কুল এবং বাংলাদেশী পরিচালিত একটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন -যা শুনে খুব ভালো লাগলো।
আলমগীর গাড়ী থামালেন ব্রিসবেন নদীর পাড়ে।নদীর দুই পাশে সুরম্য হাই রাইজ দৃস্টি নন্দন ভবন।ভবনের আলোগুলি নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করছিলো।তিনি জানান পুরো শহরটাই পরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে।প্রতি সন্ধ্যায় এই নদীতে অনুষ্ঠিত হয় লাইট এন্ড লেসার শো।শত শত দর্শনার্থী তা উপভোগ করেন।এই নদীতে বিনে পয়সায় নৌ ভ্রমনেরও ব্যবস্হা রয়েছে।
এরপর একে বেকে গাড়ী চালিয়ে আলমগীর আমাকে নিয়ে একটি একটি পাহাড়চুড়ায়।জায়গাটার নাম মাউন্ট কোট-থা।বাংলায় অর্থ করলে দাড়ায়,এখানে মধু পাওয়া যায়।আলমগীর জানান ,আদি বাসীরা এই পাহাড় থেকে মধু সংগ্রহ করতো।জায়গাটা সমুদ্র পৃস্ট থেকে ২৮৭ মিটার উঁচুতে।এখান থেকে পুরো ব্রিসবেন শহরটা দেখা যায়।পূর্নিমা রাতে এখানে এসে অনেকে সারা রাত থেকে চাঁদের আলোতে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করে থাকেন।
এরপর আমরা এলাম সমুদ্রের পাড়ে।জায়গাটা নাকি সার্ফারদের জন্য স্বর্গ।রাতের বেলা বলে সৈকতের শোভা উপভোগ থেকে বন্চিত হলাম।তবে এজন্য আমার আফসোসও ছিলোনা।কারন এমনিতেই আমি বিশ্বের দেশে দেশে ঘুরে ফিরে নানা দেশের সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করি।তা ছাড়াবিশ্বের সবচেয়ে বড়সাগর সৈকত আমার দেশের কক্সবাজারে।
আলমগীর আফসোস করে বলছিলো আমাকে ‘সাউথ ব্যাঙ্ক’ এ নিয়ে যেতে পারেনি বলে।একদিন থাকলে সখানে তিনি আমাকে নিয়ে যেতেন।তিনি জানান সাউথ ব্যাঙ্ক হচ্ছে একটা জনপ্রিয় জায়গা। অনেককিছুর পাশাপাশি এখানে মানুষের বানানো সমুদ্র সৈকতের মতো জায়গা আছে যেখানে বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত পানিতে নেমে সাঁতার কাটতে পারে। দেখলে বোঝাই যাবে না যে এটা একটা বানানো বিচ। একদম ফ্রি। আছে সহজ পার্কিং ব্যবস্হা।আপনি যেখানেই যান না কেন পাশেই কোথাও না কোথাও পার্ক খুঁজে পাবেন। ইচ্ছামতো বিশ্রাম নিতে পারবেন।

ব্রিসবেন শহরটি ঘুরে দেখতে গিয়ে রাত হয়েগিয়েঁছিলো।তাই আলমগীরকে বল্লাম গাড়ী ঘুরাতে।হোটেলে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে হবে।কাল সকালেই উড়াল দিতে হবে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের উদ্দেশ্যে।
—-লেখক,সিইও-বাংলা ট্যুর।

Categories
অষ্ট্রেলিয়া

বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম-গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড উপকুলের কাছে এই গ্রেট ব্যরিয়ার রিফ পৃথিবীর সপ্তার্শ্চর্যের অন্যতম ।এখানে ২৯০০ পৃথক পৃথক প্রবাল প্রাচীর প্রায় ১৬০০ মাইল জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে।প্রবাল,পলিপস ইত্যাদি কোটি কোটি অর্গানিজম দ্বারা এই রিফ কাঠামো গঠিত।
বিস্ময়কর সামুদ্রিক জীব প্রবাল (Coral)। প্রাণী হলেও এরা চলেফিরে বেড়ায় না। বরং সাগরতলে কোনো এক জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে এরা সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। প্রাণীজগতে এদের স্থান অ্যান্থোজোয়া শ্রেণীতে। এরা অমেরুদন্ডী। প্রবালের অনেকগুলো প্রজাতি আছে।
এক একটা প্রবাল-প্রাণীকে বলা হয় পলিপ। এই পলিপগুলো সাধারণত আকারে খুবই ছোটো, মাত্র ১/২ মিলিমিটার লম্বা। জিনগত ভাবে সম্পর্কিত এরকম হাজার হাজার প্রবাল-পলিপ সমুদ্রের নিচে কলোনি বানিয়ে একসাথে বাস করে। এই কলোনি থেকেই গড়ে ওঠে প্রবাল প্রাচীর।

যাচ্ছি বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম , অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যরিয়ার রিফ দেখতে। রাস্তায় যাত্রা বিরতি ছিলো কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী ব্রিসবেনে। স্হানীয় বাংলাদেশী আলমগীরকে সাথে নিয়ে বলা যায় সারা রাত চষে বেড়িয়েছি ব্রিসবেন শহরটি। ভোররাতে হোটেলে ফিরে একটু ঘুম।তারপর সকালে হোটেলেই নাস্তা সেরে আবার এয়ারপোর্টে।আলমগীরই আমাকে এয়ারপোর্টে পৌছে দিয়েছে।তাকে ধন্যবাদ জানালাম।আলমগী না থাকলে হয়তো এত অল্প সময়ে আমার ব্রিসবেন শহরটি ঘুরে দেখা সম্ভব হতোনা।রাতে মিটার অনুযায়ী তাকে ভাড়া দিতে পারলেও সকালে এই ট্রিপের জন্য কোন অর্থ নিতে রাজী হলোনা।প্রবাসে স্বদেশীরা যে কতো আপন হয় আলমগীর তা আবার প্রমান করলেন।
ব্রিসবেন থেকে হ্যামিল্টন আইল্যান্ড এয়ারপোর্টের দুরত্ব আকাশ পথে সময় লাগলো ১ঘন্টা ৫৫ মিনিট।সিটে বসে লান্চ খাওয়া শেষ না করতেই ঘোষনা এলো সিট বেল্ট বাঁধার।অর্থাৎ নামার সময় হয়ে গেছে।

এয়ারপোর্টের ফর্মালিটি সারতে খুব বেশী বিলম্ব হয়নি।লাগেজ ঠেলে বাইরে বেরোতেই দেখলাম আমার নাম লেখা প্লাকার্ড নিয়ে দাড়িয়ে আছে রিফ ভিউ হোটেলের একজন কর্মী।হোটেল বুক করার সময়ই জেনেছিলাম তাদের এয়ার পোর্ট সাটল সার্ভিস আছে।তাদের আমার বিমানের সময়সূচি জানিয়েদিয়েছিলাম সে সময়েই।সঠিক সময়েই তারা এসে আমাকে তুলে নিলো। লাগেজেও আমার হাত লাগাতে হলোনা।হোটেলের ড্রাইভার এবং স্টাফ দুজনকেই এক নজরেই ভালো লাগলো।
৩৬৮ টি গেস্ট রুম নিয়ে আমার রিফ ভিউ হোটেলটি এক নজর দেখেই ভ্রমনের ক্লান্তি সব দূর হয়ে গেলো।টপ ফ্লোরে রুম দিতে বল্লাম।খুব দ্রুত রিসিপসনের কাজ শেষ করে উঠে এলাম আমার রুমে।রুমের সামনে ব্যালকনি।সামনে সুনীল কোরাল সাগর মন ভালো করার জন্য যথেস্ট।রুমে হাত মুখ ধুয়ে জামা কাপড়ছেড়ে নীচে নামলাম ডিনারের জন্য।সারা শরীর ক্লান্তিতে ছেয়ে আছে।ডিনার সেরে রুমে এসে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম বিছানায়।সকাল ৮টায় গাইড এসে তুলে নেবে।এর আগেই ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে নিতে হবে আমাকে।
কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৮ টায় গাইড এসে হোটেল লবি থেকে আমাকে তুলে নিলো।রিফে সাড়ে আট ঘন্টা কাটবে তার সাথে। স্মরকেলিং ছাড়াও অন বোর্ড বারবিকিউ লান্চ অন্তর্ভুক্ত এই ট্যুরে ।পৃথিবীর অনেক জায়গায় আমি স্মরকেলিং এ অংশ নিয়েছি।তাই এ নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই ।জাহাজ থেকে রিফের দৃশ্য অবলোকন করাই আমার বেশী আগ্রহ।
১০০ জন ট্যুরিস্ট নিয়ে বোটটি ছাড়লো।বেশ বড়সড়বোট।একটু পরেই শুরু হলো গাইডের লেকচার।বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে গাইডের লেকচার শোনার খুব একটা প্রয়োজন হয়না।একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই সব তথ্য হাতের নাগালে এসে যায়।কিন্তু গাইডের ডিউটি তাকে পালন করতেই হয়। তাই অনিচ্ছা থাকলেও কান পাতলাম তার বক্তৃতায়।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড উপকুলের কাছে এই গ্রেট ব্যরিয়ার রিফ পৃথিবীর সপ্তার্শ্চর্যের অন্যতম ।এখানে ২৯০০ পৃথক পৃথক প্রবাল প্রাচীর প্রায় ১৬০০ মাইল জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে।প্রবাল,পলিপস ইত্যাদি কোটি কোটি অর্গানিজম দ্বারা এই রিফ কাঠামো গঠিত।
বিস্ময়কর সামুদ্রিক জীব প্রবাল (Coral)। প্রাণী হলেও এরা চলেফিরে বেড়ায় না। বরং সাগরতলে কোনো এক জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে এরা সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। প্রাণীজগতে এদের স্থান অ্যান্থোজোয়া শ্রেণীতে। এরা অমেরুদন্ডী। প্রবালের অনেকগুলো প্রজাতি আছে।
এক একটা প্রবাল-প্রাণীকে বলা হয় পলিপ। এই পলিপগুলো সাধারণত আকারে খুবই ছোটো, মাত্র ১/২ মিলিমিটার লম্বা। জিনগত ভাবে সম্পর্কিত এরকম হাজার হাজার প্রবাল-পলিপ সমুদ্রের নিচে কলোনি বানিয়ে একসাথে বাস করে। এই কলোনি থেকেই গড়ে ওঠে প্রবাল প্রাচীর।

প্রবাল প্রাচীরগুলো দেখতে অপূর্ব সুন্দর। এগুলো বাদামি, লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, সোনালি, ইত্যাদি নানান রঙে রঙানো থাকে। একই প্রাচীরের আলাদা আলাদা অংশ আলাদা আলাদা আকারের হতে পারে, যেমন, হরিণের শিং, মৌমাছির চাক, মানুষের মস্তিষ্ক, ইত্যাদি। প্রবাল প্রাচীরের মূল উপাদান প্রবাল-ক্ষরিত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট। এছাড়াও প্রাচীরে বসবাসকারী অ্যালজি, স্পঞ্জ ও অন্যান্য জীবরা এতে নানান উপাদান যোগ করে এর বর্ণবৈচিত্রকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
কুইন্সল্যান্ড ন্যাশনাল ট্রাস্ট এই রিফকে কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের প্রতীক হিসাবে ঘোষণা করেছে। এটি শুধু একটি বিশ্বের বিখ্যাত পর্যটন স্হানই নয় পাশাপাশি একটি সমৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক নিদর্শনও বটে।এখানে ৪০০ প্রজাতির কোরাল এবং ১৫০০ প্রজাতির মাছের আবাসস্হল রয়েছে। এছাড়াও ১৩৩ প্রজাতির হাঙর সহ অন্যান্য বৃহদাকার সামুদ্রিক মৎস, অসংখ্য প্রজাতির জেলিফিশ, ঝিনুক, শামুক এবং ত্রিশটিরও বেশি প্রজাতির তিমি মাছ ও ডলফিন রয়েছে৷
এছাড়াও গ্রেট ব্যারিয়ার জীববৈচিত্রের জন্য অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত। বৈচিত্রপূর্ণ জীবের উপস্থিত ছাড়াও এখানে ডুগং বা সমুদ্রধেনু এবং সবুজ কচ্ছপের মত বিলুপ্তপ্রায় প্রানীর উপস্থিত রয়েছে। সমুদ্রধেনু হচ্ছে গাভীর মত দেখতে বিশাল এক ধরণের উদ্ভিদভোজী প্রাণী। যাদের অস্তিত্ব এবং উপস্থিত গ্রেট ব্যারিয়ার ছাড়া অন্য কোথাও নেই।
কিন্তু দূষণ ও মানবসৃষ্ট কারণে গত কয়েক দশক ধরে এই রিফের অবস্হান হুমকির মুখে।
গাইড আরো জানায় ১৯৮৪ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলের অ্যাবট বন্দরটি কয়লা রপ্তানিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ সম্প্রতি সরকার এটার সম্প্রসারণের ঘোষণা দিয়েছে৷ কিন্তু এতে রিফের পরিবেশ আরও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশংকা করছেন পরিবেশবাদীরা।
আরো একটা আশংকার কথা জানালো গাইড। তা হলো গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের কচ্ছপরা বিভিন্ন দ্বীপের সৈকতের বালুতে যৌনক্রিয়া করে থাকে৷ এক্ষেত্রে বালুর তাপমাত্রা একটা বড় ব্যাপার৷ বড় বন্দরের কারণে আশেপাশের এলাকার তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সেক্ষেত্রে কচ্ছপরা বিপদে পড়তে পারে।

গাইড জানায় ধারণা করা হয় ২০ হাজার বছর পূর্বে যখন সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের গঠন শুরু হয়েছিল এবং এই প্রক্রিয়া প্রায় ৬০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তবে এর গঠনপ্রণালী থেকে ধারনা করা হয়, প্রাচীরের একটা বৃহৎ অংশ কোন একসময় মহাদেশীয় দ্বীপ ছিল যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে অবস্থান করলেও সমুদ্রের পানির উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকলে মহাদেশীয় দ্বীপটি একসময় পানিতে ডুবে গিয়ে প্রবাল প্রাচীরের উপরে অবস্থান করে।
ইতিমধ্যে আমরা বোটে
করে প্রায় ঘন্টা খানিক সময় পার করেছি।যারা স্মারকলিংয়ে অংশ নেবে তারা প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে।তাদের উদ্দেশ্যে নির্দেশনা দিচ্ছে গাইড।যেমন পানির নীচে কোন অবস্থাতেই উত্তেজিত হওয়া যাবেনা।নীচে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে কি সাইন দেখাতে হবে।অথবা অসুস্হ বোধ করলে উপরে উঠিয়ে নেবার জন্য কি সাইন দেখাতে হবে ইত্যাদি।
ডাইভিং ,স্মরকেলিং একটি উত্তেজনাপূর্ণ বিনোদন।ইতোপূর্বে আমি বাহামার বিভিন্ন দ্বীপে ভ্রমন করে এই বিনোদন গুলির স্বাদ নিয়েছি।তাই এবার তা থেকে বিরত থেকে কোরাল সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখাতেই মগ্ন থাকলাম।

একসময় অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ,পৃথিবীর একমাত্র প্রবাল প্রচারী ভ্রমন শেষ হলো।সারা বিশ্ব থেকে বছরে প্রায় ২০ লাখের বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে এখানে।নিজকে ধন্য মনে হলো।পৃথিবীটা এত বড় যে এই ছোট জীবনে হয়তো আর এখানে আসা হবেনা।মহান সৃস্টি কর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম। কাল ফিরে যাবো সিডনিতে।
—-লেখক সিইও ,বাংলা ট্যুর ।