Categories
ইউরোপ

নিশিথ সূর্যের দেশে

হাবিব রহমানঃঅনিন্দ সুন্দর প্রকৃতি আর ছবির চেয়েও সুন্দর দেশ নরওয়ে।দেশটির উন্নত জীবন যাপন ,অসাধারণ জীব বৈচিত্র ,সমৃদ্ধ ইতিহাস আর সংস্কৃতি সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে টানে।নরওয়েকে বলা হয় নিশিথ সূর্যের দেশ।অর্থাৎ মধ্যরাতেও এখানে সূর্যের দেখা মেলে। মধ্যরাতের সূর্য হচ্ছে এমন একটা ঘটনা যখন টানা ২৪ ঘন্টাই সূর্য দিগন্ত রেখার উপর ঝুলে থাকে।অর্থাৎ ঐ সকল অন্চল সমূহ ২৪ ঘন্টাই সূর্যের আলো পায়।আর এই সময়টা হচ্ছে ১৯ এপ্রিল থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত।তবে মধ্য রাতের সূর্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায় ২১ জুন তারিখে। আবার একইভাবে সূর্য যখন দিগন্ত রেখার নীচে অবস্হান করে তখন এই অন্চল সমুহে ২৪ ঘন্টাই রাতের অন্ধকার থাকে।তবে এটাকে ঠিক অন্ধকার না বলে বলা যায় গোধূলির আলো ।
নিশি রাতে সূর্য দেখা যায় কেন বিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।তাদের মতে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তন করছে।এই আবর্তনের সময় পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ২৩.৫ ডিগ্রী হেলে থাকে।কখনো হেলে থাকে উত্তর গোলার্ধের দিকে ।কখনো বা দক্ষিন গোলার্ধের দিকে।যখন যে গোলার্ধ সূর্যের দিকে থাকে কখন সে গোলার্ধে সূর্যরশ্মি খাড়াভাবে পড়ে এবং দীর্ঘ সময় সূর্যের আলো পাওয়া যায়। ফলে দিন বড় হয় আর রাত ছোট হয়।অক্ষাংশ যত বেশী হয় দিন তত বড় হয়।বেশী অক্ষাংশে অবস্হিত জায়গাগুলোতে গ্রীস্মকালে সূর্য অস্ত যায়না। তখন মেরু থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্হিত জায়গা গুলোতে কয়েকসপ্তাহ পর্যন্ত টানা সূর্যাস্ত ঘটেনা।আর মেরু অন্চলে সূর্য ডুবেনা ৬মাস।উত্তর মেরুতে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর টানা ছয়মাস দিন থাকে।আর এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধে টানা ছয়মাস থাকে রাত।অর্থাৎ দক্ষিণ গোলার্ধে যখন দিন তখন উত্তর গোলার্ধে রাত।আর এই আশ্চর্য ঘটনার কারণ একটাই তা হলে পৃথিবীর হেলে থাকা।
নরওয়ে ছাড়াও উত্তর গোলার্ধের আরো কয়েকটি দেশ যেমন সুইডেন,ফিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডেও এই একই ঘটনা ঘটে থাকে।তবে নরওয়ের বেশীরভাগ অন্চল উত্তর গোলার্ধের অন্তরভুক্ত বিধায় এই দেশটিতে সূর্যের আলো সবচেয়ে বেশী সময় ধরে পাওয়া যায়।যেজন্য নরওয়ে ই নিশিথ সূর্যের দেশ হিসেবে পরিচিত।তবে নিশি রাতের সূর্য দেখা ছাড়াও এই দেশটির রয়েছে বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,চমতকার সুন্দর সমুদ্রখাড়ি যা ফিয়র্ড নামে পরিচিত।রাতের আকাশজুড়ে বর্ণিল আলোর খেলা বা অরোরা বোরিয়ালিস ।আছে অবিশ্বাস্য সুন্দর সুউচ্চ পর্বত শ্রেনী ।আছে হাজার হাজার নয়নাভিরাম হ্রদ।সেসব হ্রদের পাড়ে ছবির মত সুন্দর জেলেদের গ্রাম আর সবুজের সমারোহ।এসব হ্রদে পাওয়া যায় ইউরোপের সবচেয়ে সুস্বাদু স্যামন মাছ।এছাড়া নরওয়ে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয় এর রয়েছে বর্নিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,নজরকারা স্কান্ডিনেভিয়ান স্হাপত্য ।আর এসব দেখার জন্য প্রতি বছর সারা বিশ্বের পর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে।এই যেমন নিউইয়র্ক থেকে আমি ছুটে এসেছি এই নিশিথ সূর্যের দেশটি ঘুরে দেখার জন্য।
আমি নরওয়ে ভ্রমনের জন্য জুলাই মাসটাকেই বেছে নিয়েছি।এতে এক ঢিলে অনেক পাখী মারা যাবে। নিশিথ রাতের সূর্যতো দেখা যাবেই একই সাথে উপভোগ করা যাবে নরওয়ের গ্রীস্মকালটাকেও।এ দেশের গ্রীস্মকালটা হয় দারুন সুন্দর।কড়া রোদে বরফ গলে হিমবাহ হয়ে যায়।পাহাড়ি ঝর্নারা গান গায়।রঙ বে রঙের ফুল ফুটে রঙিন হয়ে উঠে প্রকৃতি।
নিউইয়র্কের জেএফ কে বিমান বন্দর থেকে ৭ ঘন্টা ১৫ মিনিট ওড়ে নর্স আটলান্টিক এয়ারওয়েজের বিমানটি পাখা নামালো নরওয়ের গাডারমেনন বিমানবন্দরে ।ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলি ভ্রমনে আমেরিকান পাসপোর্টধারীদের জন্য কোন ভিসার প্রয়োজন হয়না।শুধুমাত্র পাসপোর্ট কন্ট্রোলে ইমিগ্রেশন অফিসারকে একটু দেখা দিয়ে পাসপোর্টে একটা এন্ট্রি সিল নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলাম বাইরে।
আজকাল বিদেশ ভ্রমন তেমন কঠিন নয়।বিশেষ করে ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে। সবাই যেন সাহায্যের জন্য মুখিয়ে থাকে।প্রতিটা দেশের বিমান বন্দর থেকে মেইন সিটিতে যাবার জন্য ট্রেন বাসের ব্যবস্হা আছে।এতে খরচ লাগে কম।আর টেক্সিতো আছেই।
ইনফরমেশন বুথ আছে প্রতিটি এয়ারপোর্টে। তাদের জিজ্ঞেস করলেই বা ঠিকানা দেখালেই সহজে কিভাবে যাওয়া যাবে পরামর্শ দেয়।ট্রেনের টিকিট কাউন্টারেও লোক থাকে সাহায্যের জন্য।
এয়ারপোর্টের ইনফরমেশন সেন্টারে আমার হোটেলের ঠিকানা দেখাতেই বলে দিলো ট্রেন বাসে দুটোতেই যাওয়া সম্ভব।গাড়ী থেকে নেমে ৫মিনিট হাঁটলেই হোটেল।
গাডারমেনন এয়ার পোর্ট থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলোর দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। দ্রুতগতির ট্রেনে অসলো পোঁছতে সময় লাগে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিট ।তাই ট্রেনেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। চমতকার ট্রেন।রাস্তার দু ধারের সবুজ প্রকৃতি, মাঝে মাঝে গম ও আলুর ক্ষেত ,পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তা দেখতে দেখতে কখন যে এই ৫০ কিলোমিটারে রাস্তা পেরিয়ে গেলাম টেরই পাইনি।
ট্রেন থেকে নেমে জিপিএস ফলো করেই চলে এলাম হোটেলে।
শংকায় ছিলাম সাত সকালে হোটেলে রুম পাবো কিনা।কারণ পৃথিবীর সব দেশেই চেক ইন টাইম বিকেল ৩টায়।তবে রুম খালি থাকলে এবং রিসেপসানে হ্রদয়বান কেউ থাকলে সাধারণত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। বিশেষ করে তারকা হোটেলগুলোতে রুম সাধারণত খালি থাকেই।আর এসব হোটেলের রিসেপসানে যারা থাকেন তারাও ভালো কাস্টমার কেয়ার করেন।অসলোতে আমার হোটেল ছিলো পার্ক হন বাই রেডিসন।রিসিপসানে হাজিরা দিতেই চেহারায় ক্লান্তির ছাপ আর হাতে আমেরিকান পাসপোর্ট দেখেই সম্ভবত সুন্দরী সেবিকার মায়া লাগলো।কোন কথা না বলেই রুম কার্ড দিয়ে দিলেন।সাথে এও জানালেন রেস্টুরেন্ট এখনো বন্ধ হয়নি।তাড়াতাড়ি করলে ব্রেকফাস্টটাও সেরে নিতে পারবো।
অফিসিয়াল ট্যুর শুরু হবে কাল থেকে।তাই কোন তাড়া ছিলোনা।রুমে লাগেজ রেখে হাত মুখ ধুয়ে দ্রুত নাস্তা সেরে রুমে ফিরে এলাম।দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের ক্লান্তিতে হোটেলের নরোম বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো দুচোখে ।
বিকেলের দিকে বেরোলাম শহরটা ঘুরে দেখতে। চারদিকে একটা অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ।রাস্তায় গাড়ীর হর্ন নেই।চিৎকার চেচামেচি নেই।ইউরোপের অনেক দেশ ভ্রমন করেছি।মনে হচ্ছিলো এর আগে এত নীরব দেশ আর দেখিনি।ভাবছি একটা শহর কি ভাবে এতটা নীরব আর শুনশান হয়।মনে হচ্ছিলো যেন কান পাতলে মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাবে।আগেই জেনেছিলাম নরওয়ে যেমন নীরব,শান্ত দেশ, তেমনি মানুষ ও শান্তিপ্রিয়।ঝুট –ঝামেলাহীন জীবন তাদের পছন্দ। মাত্র কয়েক লাখ লোকের বাস অসলো শহরে। মানুষও প্রকৃতি এখানে হাত ধরা ধরি করে চলে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটা জিনিষ দেখে খুবই চমত্কৃত হচ্ছিলাম।তা হলো সকল জায়গায় ইংরেজির ব্যবহার। যে কোন সাইন বা যে কোন কিছু নরওয়েজিয়ান ভাষার পরেই ইংলিশে লেখা।তাই কোনটা কিসের দোকান তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলোনা।
শৈল্পিক ও আভিজাত্যমণ্ডিত বাড়িগুলির আকৃতি ও নির্মাণশৈলী, পথের দু’পাশে সুদৃশ্য, সুসজ্জিত স্বল্প আলোকিত রেস্তরাঁগুলিও শহরের সৌন্দর্য বর্ধন করেছে অনেকাংশে। এখানকার বাসিন্দারাও পোষাক পরিচ্ছদে খুবই ফ্যাশনদুরস্ত ও পরিপাটি। সবাইকে দেখাচ্ছিলো প্রাণোচ্ছল ও খোশমেজাজি।পাথর বাঁধানো ঝকঝকে পথের দু’পাশে বিশালাকায় সুদৃশ্য গামলা আকৃতির টবে থরে থরে মরসুমি ফুল সাজানো। রাস্তায় একটু পর পর দেখা যাচ্ছিলো পুষ্পশোভিত উদ্যান।
অসলোর প্রশস্ত রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। রাস্থা ঘাট বেশ পরিচ্ছন্ন। হাঁটাপথ আর সাইকেল চালানোর আলাদা রাস্তা। রাস্তার পাশে অনেক গর্জিয়াস ভবন। সাম্প্রতিককালে তৈরি ভবনগুলিতে আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর ছাপ। রাস্তায় গাড়ি-ট্রাম পাশা পাশি চলছে।সড়ক আর রেলপথ অসলো শহরকে জালের মতো ছেয়ে রেখেছে। শহরের পুরো রেলপথ মাটির নীচে। রাস্তার পাশে একটু পর ক্যাফে-রেস্তোরা। রেস্তোরার সামনে খাবারের টেবিল সাজানো।নানা কিছিমের দোকানপাট-পোশাক, সৌন্দর্য প্রসাধনী। চার পাশে ভারি সুন্দর রকমারি স্থাপনা। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। দেখতে বড় ভাল লাগে।
একটু হাঁটতেই চোখে পড়লো জগৎবিখ্যাত নোবেল পিস সেন্টার। এই ঐতিহ্যময় ভবনের হলে বিশ্ব শান্তি নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ভবনটা তেমন আহামরি কিছু নয়।তেমন চাকচিক্য নেই।সাদামাটা এক দ্বিতল ভবন। সামনেই এর প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেলের ভাস্কর্য। ঘুরে ঘুরে কক্ষ গুলো দেখতে থাকি।কমিটি রুম,ঘোষনা কক্ষ আরো কতো কি! প্রতিবছর ১০ই ডিসেম্বর এখানে অনুষ্ঠান করে সনদ আর ট্রফি দেয়া হয়,।এখানেই আমাদের গর্ব ড.ইউনুস এসে নোবেল পুরস্কার গ্রহন করেছিলেন।মনে মনে শিহরণ অনুভব করি।
নোবেল পুরস্কারের অন্যান্য শাখার পুরস্কার দেওয়া হয় সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম থেকে। তবে আলফ্রেড নোবেল তাঁর উইলে সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিভাগ শান্তি পুরস্কারের দায়িত্ব দেন নরওয়ের সরকারকে। এর ভিত্তিতে গঠিত হয় নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি। এই কমিটিই এক শ বছরের বেশি সময় ধরে অসলো থেকে শান্তি পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে আসছে।
ভবনের অকপাশে বড়সড় লবি। একপাশে টিকেট কাউন্টার আর স্যুভেনির শপ বা স্মারক বিক্রয়কেন্দ্র। টিকেট কেটে নিচতলার গ্যালারিতে ঢুকি। করিডর ধরে এগোতেই দেখা মিলল নোবেল পুরস্কারের কয়েনের। ১৮ ক্যারেটের সোনা দিয়ে তৈরি এই কয়েনকে কাচের ওপাশে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল ১৯২১ সালে নরওয়ের রাজনীতি গবেষক ক্রিশ্চিয়ান এল ল্যাংকে।
জাদুঘরের প্রাণকেন্দ্র ‘নোবেল ফিল্ড’। কাচ দিয়ে ঘেরা হলটি নীলচে আলোয় আলোকিত। ঘরজুড়ে আইপ্যাডের সমান অনেক স্ক্রিন, স্ট্যান্ডের ওপর বসানো। অন্ধকার ঘরে নীলচে আলো আর জ্বলজ্বলে স্ক্রিন মিলে অন্য রকম একটা আবহ তৈরি হয়েছে।১৯০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যাঁরা শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, তাঁদের সবার প্রোফাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। প্রত্যেকেরনিজস্ব স্ক্রিন রয়েছে। শিরিন এবাদি থেকে মালালা ইউসুফজাই। নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দালাই লামা থেকে বারাক ওবামা। নানা দেশের পর্যটক রয়েছেন ঘরটিতে, সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তবে নিজের দেশের নোবেল লরিয়েটদের সামনেই বেশি সময় ব্যয় করছেন। ড. ইউনূসের স্ক্রিনের সামনে আমরাও বেশ কিছুক্ষণ থাকলাম। ইউনূসের ছবি, তাঁর নোবেল পাওয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আর নানা উক্তি দেখানো হচ্ছে।
নোবেল হল থেকে বের হয়ে গেলাম ‘দ্য ওয়াল পেপার’ নামের দেয়ালটি। এই দেয়ালে পাঁচটি বড় বড় ইন্টার-অ্যাকটিভ স্ক্রিন রয়েছে। নোবেল লরিয়েটদের বিস্তারিত জীবনী ও কাজের বিবরণ এখানে দেওয়া আছে। ভিডিও, এনিমেশনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁদের অবদান তুলে ধরা হয়। এই দেয়াল ধরে একটু সামনে গেলে ‘নোবেল চেম্বার’। এই চেম্বারের ইন্টার-অ্যাকটিভ স্ক্রিনে পাওয়া যাবে আলফ্রেড নোবেলের বর্ণিল জীবনকাহিনি।
দোতলা দেখা শেষ করে নিচে নামলাম। স্যুভেনিরের খোঁজে ঢুঁ মারলাম টকটকে লাল রং করা স্যুভেনির শপে। বিশ্বের নানা প্রান্তে তৈরি হস্তশিল্প বিক্রি হচ্ছে। আরো আছে নোবেল লরিয়েটদের ওপর লেখা বই, তাঁদের ছবি সহ পোস্টকার্ড, উক্তি ইত্যাদি। ভীড়ের মাঝ থেকে খুঁজে আমাদের ড.ইউনুসের ছবি সম্বলিত পোস্টকার্ড খুঁজে বের করে বেশ কয়েকটা কিনলাম।এসব বিক্রির অর্থ দাতব্য কাজে ব্যয় করা হয়। নোবেল কয়েনের আদলে তৈরি কয়েন চকোলেট পাওয়া যায় এখানে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য Akershus castle. ক্যাসেলে ঢুকার পথেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংলিন ডি রুজভেল্ট এর মুর্তি।তিনি একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি চার চারবার ক্ষমতায় ছিলেন।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেয়া এ’প্রসিডেন্টকে জর্জ ওয়াশিংটন ও আব্রাহাম লিংকনের পর সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারি রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নীচে পাথরে খোদাই করা তথ্য থেকে জানা যায় এখানে তিনি ১৯৫০ সালে এসেছিলেন।
কিছু দূর হেঁটেই পৌঁছে গেলাম সমুদ্রের ধারে অসলোর বিখ্যাত ন্যাশনাল অপেরা হাউস। এটি অসলো শহরের একটা বড় আকর্ষণ।অসলো ফিয়র্ডের মাথার কাছে অবস্থিত এই ভবনটি মুলত বানানোই হয়েছে অপেরা এবং ব্যালে ড্যান্সের জন্য। ভিতরটা খুব কারুকার্যময় আর চমৎকার করে সাজানো।ভেতরে ঢুকার জন্য কোন ফি নেই।পর্যটকরা চাইলেই ভবনের ছাদে গিয়ে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।আগাগোড়া পাথরে নির্মিত অপেরা হাউসকে পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোয় ভারী স্নিগ্ধ, মনোরম দেখাচ্ছিলো।সামনের বিস্তীর্ণ ঢালু চাতাল, সবটাই মসৃণ ধূসর হলদেটে পাথরে মোড়া। বহু মানুষ বৈকালিক ভ্রমণের জন্য এখানে আসেন ও সময় কাটান সমুদ্রের মুক্ত, নির্মল বাতাসকে সঙ্গী করে। নিবিড় ঘন নীল পর্বতমালা দিয়ে তিন দিক বেষ্টিত সমুদ্র। ছোট ছোট উজ্জ্বল রঙের পালতোলা নৌকার দল আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে পাহাড়ঘেরা সমুদ্রবক্ষকে। পর্যটকদের কাছে নরওয়ের বিশেষ আকর্ষণ পাহাড় ও সমুদ্রের এই সঙ্গম।
ঢুঁ মারলাম জাতীয় আর্ট গ্যালারিতে।এখানে মূলত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শিল্পীদের চিত্র কর্ম রাখা আছে॥তবে পশ্চিম ইউরোপের কালজয়ী স্রষ্টাদের চিত্রও দেখা গেল বেশ কিছু। পাবলো পিকাসোর জন্য একটি পৃথক কক্ষ বরাদ্দ রয়েছে। পিকাসোর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর ভাবনা, অনুভূতি, উপলব্ধি প্রতিফলিত হয়েছে এ সব চিত্রে।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগছিলো।পাশেই একটা ক্যাফের সাইন দেখে ভেতরে ঢুকলাম।ছোট্ট ক্যাফের প্রায় সবগুলি টেবিলেই লোকজন বসা।হঠাৎ এক পাশের টেবিলে একজনের চোখে চোখ পড় লো।প্রথম দেখাতেই বুঝলাম তিনি একজন বাংলাদেশী।আমাকে হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন।পাশের একচি চেয়ার টেনে আনলেন আমার বসার জন্য।পরিচয় দিয়ে বল্লেন,ঢাকা মানিকগন্জে তার বাড়ী।ইউনিভার্সিটি অব অসলোতে তিনি পড়া শোনা করছেন।বিদেশে বাংগালী মাত্রই স্বজন একথাটা তিনি আরো একবার প্রমান করলেন।
তিনিই আমার জন্য কফির অর্ডার দিলেন।কফি পান করতে করতে অনেক কথা চলে তাঁর সাথে।জানালেন অনেক বাংলাদেশী ছাত্র এখানে পড়াশোনা করেন।১৮১১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় টি নরওয়ের অন্যতম সেরা এবং প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ।এতে ৮টি ফ্যাকাল্টির অধীনে অনেকগুলি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে।ইংরেজীতে মাস্টার্সে প্রায় ৭০ টি কোর্স বা প্রোগ্রাম রয়েছে।পিএইচডির জন্য রয়েছে ৮টি স্টাডি প্রাগ্রাম।
ইতোমধ্যে দুজনেরই কফি পান শেষ হলে আমরা একসাথেই ক্যাফে থেকে বেরোলাম।আমার কোন আপত্তি না শুনে তিনি আমাকে হোটেল পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন
Categories
ইউরোপ

রুপিট একটি গ্রামের নাম

হাবিব রহমানঃ নিউইয়র্ক থেকে স্পেনের বার্সিলোনায় উড়ে এসেছি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তরভুক্ত একটি ছোট্ট দেশ এ্যান্ডোরাঘুরে দেখবো বলে। দেশটি উত্তর থেকে দক্ষিনে ম্বায় মাত্র ২৫ কিলোমিটার ।আর পশ্চিম থেকে পূর্বে  ৩০ কিলোমিটার। এটিফ্রান্স এবং স্পেনের সীমান্তে অবস্হিত।পুরো দেশটির সব স্ হাপনাতে মিশে আছে ফরাসী এবং স্পেনীয় স্হাপত্যের নিদর্শন।এটিএকচি ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের দেশ।যেখানে জনসংখ্যা কঠোর নিয়মের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে।এন্ডোরা খুব শান্ত একটি দেশ।অপরাধ নেই । হৈহল্লা নেই । বিক্ষোভ মিছিল নেই। দেশটি স্কি রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত।সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ,মৃদু জলবায়ু সারা বছরবিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষন করে।

পিরোনিজ পর্বতমালার উপত্যকায় গড়ে ওঠা এ্যান্ডোরাতে কোনো এয়ারপোর্ট নেই। ফ্রান্স বা স্পেনে নেমে সড়ক পথে দেশটিতেআসতে হয় ।তবে স্পেনের গিরোনা-কস্টা ব্রাভা এয়ারপোর্টই দেশটি থেকে কাছে।আমি  নেমেছি স্পেনের বার্সিলোনা এয়ারপোর্টে।এখানকার একটি ট্যুর কোম্পানীর সাথে চুক্তি করে এসেছি তারা সড়ক পথে আমাকে এন্ডোরা ঘুরিয়ে আনবে।

বার্সিলোনায় ট্যুর কোম্পানীর অফিসের সামনে থেকে সকাল ৭টায় বাস ছাড়ার কথা।এখন শীতের সময়।সকাল ৭টা মানে খুবভোর সকাল।আমি সব জায়গায় সময়ের আগেই পৌছে যাই।এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।ট্যুর কোম্পানীর অফিসের সামনেযখন পৌঁছলাম তখনো অন্ধকার কাটেনি।অফিসের দরজাও খুলেনি।অফিসটা বড়রাস্তা থেকে একটু ভিতরে একটা গলিরভেতরে। কেমন যেন একটা নীরব এলাকা।রাস্তা দিয়ে তখনো তেমন লোক চলাচল শুরু হয়নি ।আমাকে একা দাড়িয়ে থাকতেদেখে হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামলো।দুজন নারী পুলিশ বেরিয়ে এসে জানতে চাইলো এই সাত সকালে কি করছিআমি এখানে।সামনে ট্যুর কোন্পানীর অফিসটা দেখিয়ে বল্লাম ওখান থেকে আমি এন্ডোরা ভ্রমনে যাবো। পুলিশ জানালোজায়গাটা তেমন ভালো নয়।ড্রাগ এডিক্টরা এখানে ঘোরাফের করে।সুযোগ পেলে তারা লোকজনের জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। তারাপরামর্শ দিলো  মোড়ের কোনায় একটা ক্যাফে আছে সেখানে গিয়ে বসতে।বাস ছাড়ার সময় এখানে চলে আসতে বলে তারা চলেগেলো।

পুলিশের পরামর্শমত  ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম।সময় কাটানোর জন্য গরম রফি এবং হালকা নাস্তার অর্ডার দিলাম।খেয়ে দেয়েসময়ের একটু আগেই পৌছে গেলাম ট্যুরিস্ট অফিসে।ততক্ষণে কর্ম চন্চল হয়ে উঠেছে অফিসটা।অনেক পর্যটক এসে ভীড় করেছেঅফিসে। বিভিন্ন জায়গায় তাদের ডেস্টিনেশন।

কাউন্টারে আমার টিকিটটি দেখালে কর্তব্যরত একজন  তরুনি খুব হাসিমুখেই দুঃসংবাদটি দিলেন।জানালেন এন্ডোরা যাবারপথে পাহাড়ি রাস্তায় ধ্বস নামার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্হা  অচল হয়ে আছে কাল থেকে।আজও কোন বাস ছেড়ে যাবেনা  এ্যানডোরার উদ্দেশ্যে।তবে সাথে আর একটা সু সংবাদ দিলো যে চাইলে এই একই টিকিটে আমি স্পেনের একটি  বিখ্যাতপাহাড়ি গ্রাম রুপিট ভ্রমনে যেতে পারি।পাহাড়ের চুড়ায় অবস্হিত মধ্যযুগের এই গ্রামটি দেখতে সারা বিশ্বের পর্যটকরা এসে ভীড়করেন।

যদিও আমি এ্যান্ডোরা ভ্রমনের উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিলাম।তবে রুপিট সম্পর্কে আমার জানা ছিলো।এটি একটি সেরা পর্যটন  গ্রাম।জাতিসংঘ পরিচালিত ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেসান যে সেরা গ্রামের তালিকা তৈরি করেছে রুপিট তার একটি।বিশ্বজুড়েএ রকম ৩২ টি গ্রামের তালিকা করেছে সংস্হাটি।প্রতিটি দেশকে বিবেচনার জন্য তিনটি গ্রামের নাম জমা দিতে বলা হয়েছিলো।কিন্তু স্পেনের নাম দেয়া তিনটি গ্রামের মধ্যে তিনটিই তালিকায় চলে এসেছে।এর একটি  হলো রুপিট।

মুখে অপ্রসন্ন ভাব দেখালেও রুপিট  ভ্রমনে আমার আগ্রহের কমতি ছিলোনা।তাই দ্রুত গিয়ে বাসে চেপে বসলাম।পরে দেখেছি এসূযোগ মিস করলে বিরাট একটা ভুল হতো।একটা চমতকার অভিজ্ঞতা থেকে বন্চিত হতাম।

শহরের ভিড় ছেড়ে গাড়ি মোটরওয়েতে পড়লো,।পেরিয়ে যাচ্ছিলাম একের পর এক গ্রাম, প্রান্তর, ফসলের মাঠ। ইউরোপের সবদেশের কান্ট্রিসাইড ই ছবির মত সুন্দর।দিগন্তবিস্তৃত মাঠ বা ফসলের ক্ষেত, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দুটো ঘরবাড়ি, মাঝে মধ্যেব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরঝিরে নদী, চরে বেড়ানো ভেড়ার দল, কখনো দেখতে পাওয়া যায় বহুদূরের কোনো গির্জারচুড়া…..। শহরের কেন্দ্র থেকে একটু বাইরে গেলেই সবুজ আর সবুজ এবং দূরে দূরে সাজানো লোকালয়। বেশ প্রশস্ত আয়তনেলোকজন বসতি নির্মাণ করে। সবুজ বৃক্ষরাশি আর লতা গুল্ম সবকিছু যেন মিলেমিশে একাকার এখানে। 

গাড়ি ক্রমেই একে বেকে চলছে পাহাড়ি রাস্তায় ।আস্তেআস্তেঘুর্ ঘুরে  উপরে উঠছে।রাস্তাটি অনেকটা জলপাইগুড়ি থেকেদার্জিলিং যাবার রাস্তার মতো।কখনো চুলের কাঁটার মত বাঁক।দুটো গাড়ি কোন ক্রমে পাশ কাটাতে পারে।নীচে গভীর খাত।একটুএদিক ওদিক হলেই পপাত ধরনী তল।

গাইড জানালো রুপিট নামের ছোট্ট এই পাহাডি গ্রামটি মধ্যযুগে গড়ে উঠেছে।এটি সমতল খেকে ৮২২ মিটার উচুতে অবস্হিত।রুপিট একটি ল্যাটিন শব্দ।যার অর্থ রক বা পাথর।গ্রামের একমাত্র চার্চটি পাথর দিয়ে তৈরি  হয়েছে ১০ম শতকে।বাড়ি ঘরগুলোপাথর দিয়ে নির্মিত।রাস্তা গুলোও পাথরদিয়ে তৈরি।স্পেন সরকার গ্রামের সেই পুরনো ঐতিহ্যটা ধরে রেখেছে। অধিবাসী অল্পসংখ্যক হলেও তাদের জন্য সব নাগরিক সুয়োগ সুবিধা যেমন হাসাপাতাল,বিদ্যুৎ ব্যবস্হা,আধুনিক রাস্তা ঘাট সব তৈরি করেদিয়েছে।

একসময় আমাদের বাস এসে থামলো গ্রামের প্রবেশ মুখে।গ্রামের বাইরে থাকবে বাস।শুরুতেই একটা হ্যাঙ্গিং ব্রীজ ।নীচে কলকল রবে হয়ে চলেছে স্ফটিক স্বচ্ছ রুপিট নদী।এটা পেরিয়ে ঢুকতে হবে গ্রামে।এই নিরাপত্তা ব্যবস্হা সেই প্রাচীন কাল খেকে যাএখনো অটুট আছে।তবে ব্রীজটি নতুন করে নির্মিত হয়েছে ১৯৪৫ সালে।রাতের বেলা ব্রীজটি উঠিয়ে দিলে অবাঞ্ছিত কেউ ঢুকতেপারবেনা গ্রামে।

প্রকৃতি কন্যা রুপিট যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো এক অন্য রকম মুগ্ধতা নিয়ে।শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ।গ্রামটিকেদেখে মনে হচ্ছিলো প্রকৃতি যেন তার সকলসৌন্দর্য উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে ।রুপিটকে ভালো লেগে গেলো প্রথম দেখায়।

নিচের দিকে তাকালে ভালো করে কিছু চোখে পড়ে না। ধাপে ধাপে উঠে এসেছে পাহাড়। মেঘ আর কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে  কোথাওকোথাও সবুজ প্রকৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ।

একটু হেটে আমরা আসলাম একটা পাহাড়ি ঝর্না দেখতে।প্রকৃতির কোলে ঝর্নাটি যেন একটা অন্য রুপ নিয়ে চোখে ধরা দিলো।পাহাড়ের বুক চিরে আছড়ে পড়ছে প্রবহমান জলধারা। গুঁড়ি গুঁড়ি জলকনা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি হচ্ছে কুয়াশারআভা। স্রোতধারার শীতল কলতানে নিক্কন ধ্বনির উচ্ছ্বাস ছড়িয়েছে চারপাশ। যেন সবুজ অরণ্যের প্রাণের ছোয়ার পরশ এঁকেছেকেউ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব নৈসর্গিক একটা আবহ সৃস্টি করেছে চারপাশে।গাইড একটু সময় দিলে ঝর্নার জলে পা ভিজিয়েবসে রইলাম কিছুক্ষণ।

গোটা গ্রামটাই পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু ভরা মৌসুম নয় বলে তত ভিড় জমেনি। ঝর্নার জলে পা ভিজিয়ে বসে থেকেবেশ ভালোই  লাগছিলো।কিছু জলচর পাখির ডানা ঝাপটানো আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই।সবাই যেনকেমন একটা মৌনতায় মগ্ন।

রুপিট থেকে  অনেকগুলি  হাইকিং স্পট চলে গেছে জঙ্গলের ভিতরে।গাইডের নেতৃত্বে ঘন্টাখানিক হাইকিং করে সবাই ফিরেএলাম একটি রেস্টুরেন্টে ।প্রত্যেকেই নিজ নিজ পছন্দমত খাবার অর্ডার দিলো।আমি আগেই গাইডকে বলে রেখেছিলাম যে মাংসজাতীয় কিছু খাবোনা।সেজন্য গাইড আমার জন্য অর্ডার করলো টরটিলা দে পটাটা নামের একটি খাবার।এটাকে বলা যায়আলুর অমলেট।সাথে সালাদের মত পেঁয়াজের কুচি এবং অ্যাসপারাগাস আর এক বাটি নুডল স্যুপ।পরে এক কাপ গরম কফিখেয়ে সমাপ্তি।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছিলো ধীর লয়ে।

আমরা বাসে গিয়ে বসলাম।বাস ছুটে চল্লো পাহাড়ি পথ ধরে বার্সিলোনার পথে।

Categories
ইউরোপ

মেরুজ্যোতি দর্শন

আজ সারাদিন আইসল্যান্ডে অনেক দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেরিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই শরীর ক্লান্ত ও অবসন্ন। কিন্তু আজ রাতেই মেরুজ্যোতি বা অরোরা বোরিয়ালিস দেখার টিকিট কেটে এসেছিলাম নিউইয়র্ক থেকে। মূলত: এবার ইউরোপ ভ্রমণে আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিলো এই মেরুজ্যোতি দর্শন। আকাশ জুড়ে আলোর খেলা দেখা।
রাত ৯টায় গাইড এসে তুলে নিলো হোটেল থেকে। আগেই বলা ছিলো প্রচুর গরম জামা কাপড় পরে যাওয়ার জন্য। সবাই তা করেছি। কফি মগে করে সাথে নিয়েছি হোটেল কর্তৃপক্ষের দেয়া ধূমায়িত কফি। অনেক বড় বাস। পুরোটাই পর্যটক ভর্তি। সারা বিশ্বের নানা দেশ থেকে পর্যটকরা সমবেত হয়েছেন মেরুজ্যোতি দর্শনে।
গাইড প্রথমেই ব্রিফ করলো মেরুজ্যোতি সম্পর্কে। সুমেরু প্রভা বা মেরুজ্যোতি পৃথিবীর বায়ু মন্ডলে গ্যাসিয় কনাগেুলোর সাথে সূর্যালোকের সংঘর্ষের কারণে চার্জযুক্ত কনার ফলাফল। বাতাসে অক্সিজেন কনা একে অপরের সাথে যুক্ত হলেই সৃষ্টি হয় অরোরার আলো। আলোর রং বাতাসের কনা ও একে অপরের সাথে প্রতিক্রিয়ার ফল। অক্সিজেনের কারণে তৈরী হয় সবুজ বা গাঢ় লাল রং। নাইট্রোজেন থেকে উৎপন্ন হয় নীল ও লাল রং এবং হিলিয়াম থেকে হয় নীল ও গোলাপী রং। গাইড আরো জানান, আলোর এই খেলা চলে প্রায় ৬২০ মাইল উচ্চতায়। সুমেরু প্রভার দৃশ্য দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
এই একাডেমিক কথা-বার্তা শুনতে ভালো লাগছিলো না। ভাবছিলাম ভাগ্য প্রসন্ন হলে নিজের চেখেই সুমেরু প্রভা দেখে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবো।
পেটভর্তি পর্যটক নিয়ে বাস ছুটে চলেছে সুমেরুপ্রভা দর্শনে। ভিউ পয়েন্টটা শহর থেকে বেশ দূরে নির্জন জায়গায়। শহরের আলো যাতে না পৌছায় তাই এই লোকেশন নির্বাচন। গাইড জানালো, মেরু প্রভা দেখতে কয়েকটি শর্তের প্রয়োজন। প্রথমত: মেরু বলয়ের মধ্যে সুমেরুর খুব কাছাকাছি জায়গা থেকে মেরু জ্যোতি দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত প্রচন্ড শীতের রাত হবে হবে। তৃতীয়ত: অন্ধকার যত বাড়বে, আলোর বিচ্ছুরণ খালি চোখে তত বেশী দেখা যাবে। সর্বোপরি আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার হতে হবে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ বা ¯েœা পড়লে মেরু জ্যোতি দেখা সম্ভব হবে না। যেজন্য মেরু জ্যোতি বা সুমেরু প্রভা দেখা অনেকটা ——– ্আর এ জন্য অনেককে রাতের পর রাত অপেক্ষা করতে হয়।
গাইডের কথা শুনে মনটা দমে গেলো। নিউইয়র্ক থেকে আইসল্যান্ডে উড়ে এসেছি মেরু জ্যোতি দেখবো বলে। হাতে সময় কম, ইউরোপের অন্য দেশও ভ্রমনের প্রোগ্রাম রয়েছে। আমাদের হাতে মাত্র আজকের রাতটিই। আজ যদি মেরু জ্যোতি দেখা না হয়, তাহলে আফসোস নিয়ে ফিরে যেতে হবে নিউইয়র্কে।
নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে বাস থামলো। জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। মূল রাস্তা থেকে বেশ ভিতরে। তবে, একটু দূরে একটা ভবন। যা প্রচন্ড শীত থেকে বাঁচার আশ্রয়স্থল। বাথরুমের ব্যবস্থা আছে। আর আছে গরম কফির ব্যবস্থা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যটক জমায়েত হয়েছে এখানে মেরু জ্যোতি দেখার আশায়। অনেক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ ছুটে যাচ্ছেন পাশের ভবনে চা-কফি খেয়ে শরীর চাঙ্গা রাখার জন্য। আমার গ্রুপের বয়ষ্ক পুরুষ-মহিলাদের পাঠিয়ে দিলাম ভবনে বিশ্রাম নিতে। বললাম- মেরু জ্যোতির দর্শণ পেলে তাদের ডেকে নিয়ে আসবো।
রাত প্রায় দুটো বাজে। প্রচন্ড ঠান্ডায় শরীর জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবুও মেরু জ্যোতির দেখা নেই। হতাশ হয়ে ইতোমধ্যে দু-একটি বাস চলেও গেছে। হয়তো তারা পরদিন আসবে। আমাদের গাইড-ও বাসে উঠার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো। তাকে অনুরোধ করলাম, আরো কিছু সময় থেকে যাওয়ার জন্য।
শীতের কামড় থেকে বাঁচতে ভেতরে গিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে সবে চুমুক দিয়েছি। এমন সময় শুনি বাইরে থেকে চিৎকার- ‘অরোরা! অরোরা!’ কফি কাপ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেলাম বাইরে। দেখলাম- উত্তর আকাশে একটা সাদা আলোর রেখা। একটু পর দেখা দিলো চোখ ধাঁধানো তীব্র দ্যূতি ছড়ানো এক সবুজ আলোর নৃত্য। একটু পর রং বদলিয়ে গোলাপী ও হালকা হলুদ রং। মনে হচ্ছিলো প্রকৃতির এক লেজার বিম শো উপভোগ করছি আইসল্যান্ডের উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে।
উপস্থিত পর্যটকরা তখন আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। চারিদিকে ক্যামেরার শাটারের শব্দ। কেউ কেউ অরোরা-কে ক্যমেরার লং এক্সপোজারে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
সুমেরু প্রভার ¯িœগ্ধ আলো প্রচন্ড শীতের কষ্ট একেবারেই ভুলিয়ে দিলো। অবিস্মরণীয় এই মুহুর্তটি কোনদিন ভুলার নয়। মনভরা একরাশ তৃপ্তি নিয়ে বাসে গিয়ে বসলাম। কাল প্রসন্ন চিত্তে রওনা দেবো নেদারল্যান্ডের দিকে।

Categories
ইউরোপ

অপরূপ আইসল্যান্ড

আইসল্যান্ডে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন। দিনে রাতে ঠাসা ট্যুর প্রোগ্রাম। সকাল ৯টা থেকে শুরু হবে গ্রান্ড গোল্ডেন সার্কেল ট্যুর যা শেষ হবে বিকাল ৫ায়। আগ্নেয়গিরির ক্রেটার, হট স্প্রিং, গাইজার, জলপ্রপাতসহ আরো নানা কিছু আছে দর্শনীয় তালিকায়। আর রাতের বেলায় নর্দান লাইটস ট্যুর।
সকাল ৮.৩০ মিনিটে সবাই হোটেলের লবিতে গিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। ট্যুর গাইড আমাদের তুলে নিলো কাঁটায় কাঁটায় ৯টায়।
বিরাট বাস। পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ উঠেছে এই বাসে। সবাই মিলে সারাদিন ঘুরে দেখবো আইসল্যান্ড। আমাদের সুদর্শন চটপেেট গাইডের নাম জন পোরসন। জন নামে ডাকলেই হবে জানালো সে। উচ্চারণ সহজ। আরো কয়েকটা হোটেল ঘুরে সবাইকে বাসে উঠিয়ে শুরু হলো যাত্রা।
টিপিক্যাল ট্যুর গাইডের মত শুরু হলো তার বক্তৃতা। প্রথমেই আইসল্যান্ডের ইতিহাস জানালো। দ্বীপটির প্রায় ১১ শতাংশ হিমবাহ দ্বারা আবৃত। দ্বীপের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা পশু চারণের জন্য ব্যবহার করা হয়। আর মাত্র ১ শতাংশ এলাকায় হয় কৃষিকাজ। ৯০০ খ্রীষ্টাব্দে দ্বীপটিতে মানুষ বসতির আগে দ্বীপটির প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ বৃক্ষ আচ্ছাদিত ছিলো। বর্তমানে কেবল কিছু বার্চ গাছের জঙ্গল ছাড়া আর তেমন কোন বনভূমি অবশিষ্ট নেই।
আরো কিছু মজার তথ্য দিলো গাইড জন। তা হলো আইসল্যান্ডে কোন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী কিংবা বিমান বাহিনী নেই। দেশটির পুলিশ নিজেদের সাথে কোন অস্ত্র রাখেনা। কারণ এখানে অপরাধ খুবই কম হয়। তাছাড়া দেশটি এতটাই পরিষ্কার যে সেখানে কোন মশা নেই। দেশটিতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও নেই। আইসল্যান্ডের মানুষ আইসক্রীম খেতে ভীষণ পছন্দ করে। এতটাই পছন্দ করে যে, তারা কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও আইসক্রীম খেয়ে থাকে। জাতিসংঘের প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুযায়ী আইসল্যান্ড বিশে^র মধ্যে তৃতীয় সুখী দেশ।
বাস প্রথমে এসে থামলো একটি চার্চের সামনে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে একটা জিনিস আমি দেখেছি সে সব দেশে প্রতিটি ট্যুর প্রোগ্রামে চার্চ দর্শন অন্তর্ভূক্ত থাকে। চার্চগুলোর যেমন রয়েছে ইতিহাস তেমনি আছে নান্দনিক স্থাপত্য। তাই সেগুলো দর্শনীয় তালিকায় পড়ে।
আমাদের যে চার্চটি দেখাতে নিয়ে আসা হলো তার নাম হলগ্রিমিস্কিকা চার্চ। লুথারর্ণ সম্প্রদায়ের এই চার্চটি আইসল্যান্ডের সবচেয়ে বড় চার্চ এবং দেশটির সবচেয়ে লম্বা স্থাপত্য। এর অবস্থান রিকজাভিকের একেবারে মধ্যভাগে। তাই দেখা যায় যে কোন অংশ থেকে। গাইড জানায় ৪১ বছর সময় নিয়ে এই চার্চটি তৈরি করা হয়। পাথরের তৈরি লম্বা লম্বা কলাম একটি আর একটির সাথে লাগানো। দুই পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট কলাম এবং ধীরে ধীরে মাঝপথে উঁচু লম্বা কলাম একসাথে হয়ে দেয়াল আকৃতির একটা উঁচু পাহাড়ের রূপ ধারণ করেছে। চার্চটির নামকরণ করা হয়েছে আইসল্যান্ডের কবি Hallgrimur Petursson এর নামে।
বাস ছুটে যাচ্ছিলো মসৃন পথ ধরে। রাস্তায় দুধারের মাঠে কালো কুচকুচে এবড়ো থেবড়ো পাথর। গাইড জানালো এগুলি আগ্নেয়গিরির লাভা গলে এই কালো পাথরে পরিণত হয়েছে। এই পাথুরে জমিতে কোন ফসল উৎপন্ন হয় না। এক ধরনের গুল্ম জাতীয় ঘাস দেখা গেলো এখানে সেখানে। স্থানীয় ভাষায় এগুলোকে বলা হয় ‘মস’। আর এগুলি ঘোড়ার প্রিয় খাবার। মাঝে মাঝেই ঘোড়ার পালের দেখা মিললো এসব জমিতে। অনেক সময় দাড়িয়ে থাকা ঘোড়াগুলোকে স্টাচু বলে ভ্রম হয়।
আমরা চার্চ দেখে রের হতেই হুড়মুড় করে শুরু হলো বৃষ্টি। অথচ হোটেল থেকে যখন আমরা বাসে উঠি তখন আকাশ ছিলো নির্মেঘ, সমগ্র আকাশে ছিল ছোট ছোট সাদা ভেলার ছড়াছড়ি। অবশ্য আমি এবং আমার গ্রুপের পূর্ব প্রস্তুতি ছিলো আগে থেকেই। সবাইকে ছাতা সাথে রাখতে আগেই বলে দিয়েছিলাম। আইসল্যান্ড আসার আগে আমি হোম ওয়ার্ক করে এসেছিলাম। তাতে জেনেছি এখানের আবহাওয়া ক্ষনে ক্ষনে পাল্টে যায়। মুহূর্তে মুহূর্তে চলে রোদ বৃষ্টির খেলা। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে কৌতুক প্রচলিত আছে তা হলো “আবহাওয়া তোমার পছন্দ না হলে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো”। অর্থাৎ আইসল্যান্ড এমনই একটা জায়গা যেখানে সূর্যের তাপে ত্বক পুড়ে যাবে আবার একটু পরেই ঝমঝম বৃষ্টি আপনার গা ভিজিয়ে দিবে।

গুলফস জলপ্রপাত
গুলফস জলপ্রপাত

এরপর বাস এসে যেখানে থামলো তার নাম ‘বিয়ার নারফেল’। এখানে আছে একটি গরম পানির ঝর্ণা যা থেকে সব সময় বুদ বুদ উঠছে। একটু পরেই এই গরম পানি উঠে আছে অনেক উচ্চতায়। প্রাকৃতিক এই উষ্ণ প্রবাহকে ইংরেজীতে বলে গাইজার।
বাসে উঠার পর গাইড ঘোষণা দিলো আমাদের পরবর্তী স্টপেজ হবে এটা জলপ্রপাত। আমি নায়াগ্রার দেশের মানুষ। এছাড়াও সুইজারল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনেক সুন্দর সুন্দর জলপ্রপাত দেখেছি। তাই তেমন কোন আগ্রহ ছিলো না জলপ্রপাত দেখার। কিন্তু গাইডের পীড়াপীড়িতে নামলাম। জলপ্রপাতের তীরে এসে বুঝতে পারলাম, না আসলে অনেক মিস করতাম।
প্রপাতটির নাম ‘গুলফস’। অর্থাৎ সোনালী জলপ্রপাত। সূর্যের আলোর প্রতিফলনে জলপ্রপাতটিকে সোনালী রং এর মনে হচ্ছিলো। প্রপাতে জল আসছে আইসল্যান্ডের অগণিত হিমবাহের জল গলে। প্রপাতের গর্জন, কুয়াশার মত জলের কণা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল।
দুপুরে বাস থামলো একটা মলের সামনে। লাঞ্চের পর কিছুটা ফ্রি সময় কেনাকাটার জন্য। আইসল্যান্ডের ভেড়ার মাংস খুব বিখ্যাত। আমার গ্রুপের প্রায় সবাই ভেড়ার মাংসের স্যুপ এবং পাউরুটির অর্ডার দিলো। হালাল হারাম বিবেচনায় আমি বিদেশে সাধারণত মাংস খাই না। তাই সামুদ্রিক মাছের স্যান্ডউইচ অর্ডার দিলাম। এর পরে স্থানীয় খাবার ‘স্কীর’। এটা হলো ঘন দই এবং খেতে খুব সুস্বাদু।
খাওয়া দাওয়া এবং কিছু কেনাকাটার পর গাইড আমাদের নিয়ে এলো ‘থিংভেলি ন্যাশনাল পার্কে’। অপূর্ব সৌন্দর্য্য মন্ডিত এই পার্ক। গাঢ় নীল রংয়ের একটা লেক রয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। গাইড জানালো পৃথিবীর উপরের স্তরটা অনেকগুলো প্লেট ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে জোড়া লাগালে যেমন হয় অনেকটা সেরকম। এই প্লেটগুলোকে বলে ‘টেকটনিক প্লেট’। এই প্লেটগুলি যখন এদিক ওদিক নড়াচড়া করে তখনই হয় ভূমিকম্প। এই রকম দুটো প্লেট সেখানে জোড়া লেগেছে। তার ঠিক উপরে বসে আছে আইসল্যান্ড দেশটা আর প্রতিবছর এই প্লেটগুলো বাইরের দিকে এক ইঞ্চি করে সরে যাচ্ছে। আর মাঝের সেই ফাটল ভরে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির লাভা জমে যাওয়া পাথরে। থিংভেলী ন্যাশনাল পার্কের এক জায়গায় দু’দিকের প্লেটের সেই ফাটল দেখালো গাইড। এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে যেন কুয়াশায় ঘিরে আসছে চারদিক। শীতও পড়ছে জাঁকিয়ে। হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতে আবার বেরোতে হবে সুমেরু প্রভা বা অরোরা বোরিয়ালিস দেখার জন্য।

Categories
ইউরোপ

মেরু জ্যোতির দেশে

মেরুজ্যোতি, নর্দান লাইটস, সুমেরু প্রভা, অরোরা বোরিয়ালিস কত যে নাম! যে নামেই ডাকা হোক এটা প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। আকাশে এই চোখ ধাঁধানো উজ্জ¦ল ও রঙিন আলোর যে খেলা চলে তখন সূর্যের সৌর বায়ু ও পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র এক অপরের সংস্পর্শে আসে। তীব্র সৌর ঝড়ের সময় সুমেরু প্রভা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে। আরো স্পষ্টভাবে দেখা যায় এই বর্ণিল আলোর ঝলক।
অনেকদিনের স্বপ্ন ছিলো সুমেরু প্রভা দেখার। পৃথিবীর যে সব দেশগুলোতে সুমেরু প্রভা দর্শন করা যায় যেমন নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, কানাডা, রাশিয়া, আইসল্যান্ড, আলাক্সা, নিউজিল্যান্ড এসব দেশের প্রায় সবগুলিতে ঘুরে এলেও সুমেরু প্রভা দেখা হয়নি। কারণ বছরের সব সময় তা দেখা যায় না। সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই ছয় মাস এসব দেশগুলোতে সুমেরু প্রভা দেখতে পাওয়া যায়।
গত ক’দিন আগে হঠাৎ করেই একটা আমেরিকান ট্যুর কোম্পানী যাদের সাথে আমি কাজ করি তারা জানালো একদল ট্যুরিস্ট অরোরা বরিয়ালিস বা নর্দান লাইটস দেখতে চায়। আমি তাদের দেখিয়ে আনতে পারবো কিনা। আমি এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম। কারণ শীতের এই সময়টাতে আমার বাইরে যাওয়া হয় না বিধায় কখনো সুমেরু প্রভা দর্শন হয়নি।
৭ অক্টোবর সকালে আমার ট্যুর গ্রুপের ১২ জন সদস্য সহ জেএফকে থেকে আইসল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বুড়োবুড়ি সহ আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটস থেকে এসেছে এরা। এদের বেশিরভাগই রিটায়ার্ড। অবসর সময়টা তারা ‘এনজয়’ করতে ঘুরে বেড়ায় দেশ বিদেশে। আর আমার কোম্পানী ‘বাংলা ট্যুর’ এর কাজ এ ধরনের রিটায়ার্ড এবং ভ্রমণার্থীদের সহায়তা দেওয়া। ঘুরতে সাহায্য করা। ট্যুর প্রোগ্রাম বানানো, তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা। মোদ্দা কথা ট্যুরের এ-টু-জি পর্যন্ত সবকিছুর ব্যবস্থা করা।
ওয়াও এয়ারলাইনের বিমানটি প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টা আকাশে ডানা মেলে বিকালের দিকে নামলো আইসল্যান্ডের রিকজাভিক বিমান বন্দরে। এটি আইসল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। নিউইয়র্কের আকাশে ঝাঁঝাঁ রোদ্দুর থাকলেও আইসল্যান্ডের আকাশ ছিলো মেঘাচ্ছন্ন। টুপ টাপ বৃষ্টি পড়ছিলো। সেই সাথে বাতাস আর তীব্র শীতের আক্রমন। ইউরোপ আসা যাওয়ার পথে অতীতে আমি অনেকবার এই রিকজাভিক বন্দরে স্টপ ওভার করেছি। বছরের কোন সময়ই এখানে পরিস্কার আকাশ দেখতে পাইনি।
যা হোক এয়ারপোর্ট ট্যুরিষ্ট ইনফরমেশন বুথে আমাদের হোটেলের ঠিকানা দেখাতেই তারা কাঁচের জানালা দিয়ে পাশেই পার্ক করা বাস দেখিয়ে দিয়ে বল্লো ওটা একেবারে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। তারাই টিকেট কাউন্টার দেখিয়ে দিলেন। বাসের পেটে লাগেজ ঢুকিয়ে আমরা ভেতরে গিয়ে আরাম করে বসলাম। বাস ছুটে চললো আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকজাভিক এর পথে।
এয়ারপোর্ট থেকে রাজধানীতে যেতে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব চমৎকার। প্রতি ১০ মিনিট অন্তর অন্তর বাস। ভীড় নেই বল্লেই চলে। ৫০ মিনিটের জার্নির জন্য ভাড়া দিতে হয় ৩ হাজার ৯শত ৬০ আইসল্যান্ড ক্রোনার। যা ৩৩ ইউএস ডলারের সমমান। বাসে কোন কন্ডাক্টার নেই। ড্রাইভারকে টিকিট দেখিয়ে বাসে উঠতে হয়। বসতেই ড্রাইভারের ঘোষণা প্রত্যেককেই সিট বেল্ট বাঁধতে হবে। আর ভেতরে কোন রকমের ড্রিঙ্কস এলাউড নয়।
বাস ছুটে চলছে রিকজাভিক এর পথে। দু’পাশে বাড়ীঘর নেই। বিরান মাঠ, পাথুরে অনুর্বর ভূমি। মাঝে মাঝে ঘোড়া চড়ছে। কোথাও কোথাও লেক। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সড়ক পথের পরিচ্ছন্নতা। কোথাও কোন আবর্জনা কাগজ বা প্লাস্টিকের টুকরা পড়ে নেই। রাস্তার পাশে ছোট বড় গাছগুলোর উপর পরম যতেœর ছাপ।
প্রায় চল্লিশ মিনিট এর পর একটা বিরাট বাড়ীর সামনে বাস এসে থামলো। এটা শহরতলী। বড় বাসের সীমানা এখানেই শেষ। এগুলো শহরের ভিতর ঢুকতে মানা। এখন আমাদের উঠতে হবে মিনিবাসে। ওগুলো পৌঁছে দেবে আমাদের হোটেলে। তবে এজন্য বাড়তি কোন অর্থ দিতে হবে না।
বাস থেকে নামার সাথে সাথেই ছোট মিনি বাস এসে দাড়ালো আমাদের সামনে। ড্রাইবারই সাহায্য করলো লাগেজগুলো উঠাতে। তারপর ছেড়ে দিলো বাস। ১০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের নামিয়ে দিলো হোটেলের সামনে।
ইউরোপ মহাদেশের একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র আইসল্যান্ড। দেশটির সরকারী নাম আইসল্যান্ড প্রজাতন্ত্র। রাজধানী রিকজাভিক। সমুদ্রপাড়ে অবস্থিত এবং ৩দিকে পানি দিয়ে ঘেরা। একেবারেই ছোট্ট একটি শহর। দেশটির উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগর। গ্রীনল্যান্ড, নরওয়ে, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সদা সক্রিয় ও ভূ-গাঠনিক প্লেটগুলোর উপরে অবস্থিত একটি আগ্নেয় দ¦ীপ। আয়তন ৩৯ হাজার র্বগমাইল। যা বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশের সমান। রাজধানী রিকজাভিক অনেকটা দার্জিলিংয়ের মত। সন্ধ্যার আগেই সারা শহর কুয়াশাচ্ছন্ন। বাতাসে শীতের আমেজ। এটি একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র জনসংখ্যার দেশ। মাত্র ৩ লাখ ৩২ হাজার মানুষের বসবাস এখানে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ (১ লাখ ২২ হাজার) থাকে রাজধানী রিকজাভিক বা এর আশেপাশের এলাকায়। প্রায় ১ হাজার বছর আগে খৃষ্টীয় ৯ম শতকে ভাইকিং অভিযানকারীরা আইসল্যান্ডে বসতি স্থাপন করে। আইসল্যান্ডবাসী তাদের ভাইকিং ঐতিহ্য নিয়ে বেশ গর্ববোধ করে। প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর ধরে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত থেকে দ্বীপটির উৎপত্তি। এখনো দ্বীপটিতে অনেকগুলো আগ্নেয়গিরি সক্রিয় আছে। এখানে গড়ে প্রতি চার বছরে একবার আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নুৎপাত হয়। তাছাড়া দেশটিতে ভূমিকম্প একটা সাধারণ ব্যাপার।
আইসল্যান্ড দেশ হিসাবে ছোট হলেও এটা পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ। মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার। দেশে বিদ্যমান বিশাল জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঠামো ও ভূগর্ভস্থ নবায়নযোগ্য জ¦ালানির পরিমাণ প্রায় অশেষ। মজুদের ভিত্তিতে আইসল্যান্ডে মাথাপিছু হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বিদ্যুত উৎপাদিত হয়।
হোটেলের রুমে লাগেজ রেখেই খেতে বেরোলাম। সামনেই সারি সারি হোটেল। এর মাঝেই আলী বাবা হালাল রেষ্টুরেন্টের সাইন চোখে পড়লো। তবে যেহেতু আমার সঙ্গীদের সবাই আমেরিকান তাই পাশেই একটা বড় হোটেলে গিয়ে খাবার অর্ডার দিলাম।
হালাল রেষ্টুরেন্ট না হলে আমি সাধারণত মাছের অর্ডার দিই। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। খাবার আসলো সামুদ্রিক মাছের বড় দুটি ফিলেট সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। বাটিতে সালাদ। আলাদা সসের বোতল এবং লেবুর টুকরো। ড্রিঙ্কস হিসাবে বোতলের পানি দিতে বল্লাম। সুন্দরী ওয়েট্রেস মৃদু হেসে বল্লো তুমি চাইলে বোতলজাত পানি দিতে পারি। তবে শুনে খুশী হবে আইসল্যান্ডের পানি বিশুদ্ধতার জন্য জগদ্বিখ্যাত। কোন প্রকার বিশুদ্ধকরণ ছাড়াই এই পানি ঘরে ঘরে সরবরাহ করা হয়। তাই টেবিলের জগে রাখা পানি তুমি নিশ্চিন্তে খেতে পারো।
ক্ষুধার্ত ছিলাম তাই পেট পুরেই খেলাম। শীতের দেশ। তাই খাবার শেষে এক কাপ কফি দিতে বল্লাম। বিল এলো ৩ হাজার ৩২৯ আইসল্যান্ড ক্রোনার (প্রায় ২৮ ডলার)।
আইসল্যান্ড খুব খরুচে দেশ। সব কিছুই অগ্নিমূল্য। ট্যুরিস্ট ক্লাস হোটেল নিতে হয়েছে প্রতি রাতের জন্য ২৫০ ইউএস ডলার। সে যাক সারা দিনের ভ্রমণে সবাই ছিলো ক্লান্তশ্রান্ত। পরদিন থেকে শুরু হবে আমাদের আইসল্যান্ড দেখা। তাই সেদিনের মত সবাই হোটেলে ফিরে গেলাম বিশ্রামের জন্য।

Categories
ইউরোপ

আমস্টারডাম-এক শহরে দুই দুনিয়া

আমস্টারডাম-নেদারল্যান্ডের রাজধানী। শহরটির যেমন রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তেমনি রয়েছে আধুনিক জগতের সমস্ত আকর্ষণ। পুরো শহরে রয়েছে ১৬৫টি খাল। ৯০টি ছোট-বড় দ্বীপ। যেগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত রয়েছে ২৮১টি সেতুর মাধ্যমে। ৬,৮০০ ঘরবাড়ী রয়েছে শহরটিতে। এরমধ্যে ১৬ শতক থেকে বিংশ শতাব্দীতে তৈরী বাড়ীঘর যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু অত্যাধুনিক স্থাপনা। নতুন-পুরনোর মিশেলে একাকার এই আমস্টারডাম। ৫০টি দেখার মতো যাদুঘর রয়েছে এই শহরে। এরমধ্যে ভ্যানগগ যাদুঘর এবং রিক্স যাদুঘরটি খুবই বিখ্যাত। এছাড়াও জলে ভাসা বসতবাড়ি, প্রকাশ্য রেডলাইট ডিষ্ট্রিক্ট, গুঞ্জিকা সেবনের বৈধতা, স্থাপত্য বৈশিষ্ট সবকিছু মিলিয়ে আমস্টারডাম সব মানুষের আকর্ষণ। বলা যায় এক শহরে যেনো দুই দুনিয়া। আর এ জন্যই শহরটি সারা বছর সারাবিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
আমস্টারডাম-কে খালের জন্য উত্তরের ভেনিস-ও বলা হয়। গত বছর ইতালীর ভেনিস শহর ঘুরে এসেছি। তাই উত্তরের ভেনিসটা দেখার আগ্রহ ছিলো। এবারের ইউরোপ ট্যুরে ভ্রমণের তালিকায় প্রথমেই অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম আমস্টারডাম-কে।
ভ্রমণটা শুরু হয়েছিলো আইসল্যান্ড দিয়ে। আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকজাভিক-এর দর্শনীয় স্থানগুলো পরিভ্রমণ করে ওয়াও এয়ারলাইন্সের বিমানে চড়ে আমস্টারডাম-এর শিফল বিমানবন্দরে যখন পা রাখলাম তখন বেলা দুটো। আগেই জেনেছিলাম ব্যস্ত বিমানবন্দরটি সমুদ্র সমতল থেকে ১১ ফুট নীচে। তবে বাইরে থেকে তেমন কিছু বুঝা যায়নি।
শিফল বিমানবন্দরের নামেরও একটি ইতিহাস রয়েছে। এক তথ্যমতে ‘শিফ হল’ অর্থ জাহাজের নিরাপদ ঘর। অন্য ভাষ্যমতে- প্রাচীন ডাচ ভাষায় ‘হল’ মানে সমাধি। অর্থাৎ জাহাজের সমাধি। আবার কারো মতে শব্দটি এসেছে ‘শিফ হেল’ অর্থাৎ জাহাজের নরক থেকে। যেখানে প্রায়ই জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটতো।
শিফল বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে বেরুতেই ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ঘিরে ধরলো। অনেকটা লাগেজ নিয়ে টানাটানি। এদের মধ্য থেকে বয়স্ক মতো একজনকে বেছে নিয়ে উঠে পরলাম ট্যাক্সিতে। গাড়ী ছুটে চললো নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম-এর পথে।
১৫/২০ মিনিট হাইওয়ে ধরে চলার পর ট্যাক্সিটি সরু পথ ধরে নেমে গেলো। একে-বেঁকে রাস্তা ধরে চলছিলো ট্যাক্সি। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিলো- মিটারে বেশী ভাড়া তুলতে ড্রাইভার ঘুরপথে যাচ্ছে। পরে আবশ্য এ ধারণাই ঠিক হয়েছিলো। নিয়মিত ভাড়ার চেয়ে দেড়গুণ ভাড়া আদায় করেছিলো সে। আমার হোটেল রিসেপসনিষ্ট একথাই বলেছিলো।
হোটেলে চেক-ইন করেই তাড়াহুড়া করে ছুটলাম আমাদেও গ্রুপের জন্য ট্যুর প্রোগ্রামে যোগ দেয়ার জন্য। দিনব্যাপী একটি ওয়াকিং ট্যুর বুক করেছিলাম আগেভাগেই নিউইয়র্ক থেকে। ওয়াকিং ট্যুর-এর মাধ্যমে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই দেখা যায়। ট্যুর গাইড যতক্ষণ হাঁটতে থাকে ততক্ষণ সে চারপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোর ধারা বর্ণনা করতে থাকে, যা ট্যুরিস্টদের কাছে হয় উপভোগ্য ও আকর্ষণীয়। হোটেল রিসেপশন থেকে জানিয়েছিলো গাইডের সাথে আমাদের মিটিং প্লেসটা খুব দূরত্বে নয়। হাঁটা পথে ২০ মিনিটের মতো। তবে সময়-স্বল্পতার জন্য অচেনা দেশে কোন রিস্ক নিতে চাইনি। এজন্য ট্যাক্সি নিয়ে যথাসময়ে পৌছে গেলাম সঠিক ঠিকানায়।
ওয়াকিং ট্যুরটার সদস্য ছিলো অনেক। নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষ। দুই গ্রুপে ভাগ করে দুজন গাইড নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। আমাদের ভাগের ট্যুর গাইডের নাম মারিয়া। বয়স ৩০-এর কোঠায়। অধ্যাপনা করেন একটা কলেজে, আর পার্ট টাইম ট্যুর গাইড। তাকে নিয়ে শুরু হলো আমাদের হাঁটাপথে আমস্টারডাম নগর ভ্রমণ।
টিপিক্যাল গাইডদের মতো প্রথমেই নেদার‌্যান্ড নিয়ে একটা বড় লেকচার দিলো মারিয়া। নেদারলান্ড শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘নি¤œভূমি’। উত্তর ও দক্ষিণ হল্যান্ড নামে দুটো প্রদেশ নিয়ে গঠিত নেদারল্যান্ড। নিয়মিত বন্যার কবলে পড়া শহরটিকে বাঁধ দিয়ে সুরক্ষিত করে বহু বছরের চেষ্টায় গড়ে তোলা হয় বর্তমান আমস্টারডাম। শহরটির মূল কেন্দ্রবিন্দু ড্যাম্স স্কোয়ার নামের বিশাল চত্বরটি উন্মুক্ত হয় ১২৭০ সালে আমস্ট্যাল নদীতে বাঁধ তৈরী করার পর। এরপর জলের তলায় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে তৈরি করা হয় বাড়িগুলো। আর এভাবেই গড়ে উঠে আমস্টারডাম-এর নগর স্থাপত্য।
আমস্ট্যাল নদীর মোহনায় আমস্টারডম শহর। এটি ক্যানেলের মাধ্যমে উত্তর সাগরের সাথে সংযুক্ত। আমস্টারডাম-এর খালের পাড় ঘেষে বাড়িঘরগুলো। প্রতিটি বাড়ী একটি সাথে আরেকটি লাগোয়া। একই উচ্চতায় একই রকম বাড়ী। গাইড জানালো, জলের আগ্রসন ঠেকিয়ে জাগিয়ে তোলা মাটির মধ্যে সহ্য ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে ১৫০০ শতক থেকে এধরনের বাড়ি নির্মানের অনুমতি দেয় সরকার। বাড়িগুলো যেন বেশী ওজন না হয়, সেজন্য একই ধরনের পরামর্শ দেয়া হয় এবং তা নজরদারীও করা হয়। এসব বাড়িগুলোতে স্থানীয়রা আদর করে বলে ড্যান্সিং হাউজ। আমস্টারডাম-এর এসব বাড়িগুলো বেশীরভাগ কমবেশী সামনের দিকে হেলানো। কারণ হিসেবে গাইড জানায় বাড়িগুলোর উপর তলায় উঠার জন্য সিড়িগুলো হচ্ছে সরু। আর সেগুলো দিয়ে বড় কোন আসবাসপত্র উঠানো প্রায় অসম্ভব। তাই দড়ি বেঁধে যাতে জানালা দিয়ে উঠানো যায়, সেজন্যই বাড়িগেুলো সামনের দিকে হেলিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
এরপর গাইড আমাদের নিয়ে এলো ভ্যানগগ যাদুঘর পরিদর্শনে। আমস্টারডাম-এ সবচেয়ে বেশী পর্যটক আসেন এই যাদুঘরে। ভ্যানগগের চিত্রকর জীবনের শুরু থেকে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত যেসকল ছবি একেছেন এখানে ধারাবাহিকভাবে তা সাজানো আছে। ভ্যানগগের চিত্রকর্মের পাশাপাশি রেনেসাঁ ও ইম্প্রেসনিষ্ট যুগের মনে, মেতিস সহ অন্যান্য আরো কয়েকজন শিল্পীর বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম রয়েছে এই যাদু ঘরে।
যাদুঘরে ঢুকে প্রথমে আমরা উপভোগ করলাম শিল্পী ভ্যানগগের জীবন ও কর্ম নিয়ে তৈরী ৮ মিনিটের একটি প্রামাণ্য চিত্র। যাদুঘরের প্রথম তলায় মূলত: শিল্পীর পরিচিতি দিয়ে সাজানো। বিভিন্ন ছবি, আতœপ্রতিকৃতি ইত্যাদি। দ্বিতীয় তলায় তার পারিবারিক পরিচিতি, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ইত্যাদি। তৃতীয় তলাটি মুলত: বিখ্যাত কিছু সংগ্রহের। একপাশে জায়গা পেয়েছে শিল্পীর ভক্তদের আকাঁ কিছু ছবিও। এখানে ভ্যানগগের কিছু শিল্পকর্ম যেমন সানফ্লাওয়ার, দ্য স্টারি নাইট, পটেটো ইটার্স-এর মতো বিখ্যাত চিত্রকর্মও রয়েছে।
ভ্যানগগ যাদুঘর দেখতে দেখতে একটা ব্যাপার মনের কোনে বারবার উঁকি দিচ্ছিলো। গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেখছি সেসব দেশের মিউজিয়াম, বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম। কিন্তু একটি ব্যাপারে সকল শিল্পীর ভাগ্য একই রকম মনে হয়েছে। তাহলো তাদের বেশীরভাগ জীবদ্দশায় যেমন নিজেরা মূল্যায়িত হননি, তেমনী আর্থিকভাবেও বিবেচিত হয়নি তাদের শিল্পকর্মগুলো।
আমি আজ ভ্যানগগ যাদুঘরের যেসব শিল্পকর্মগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেগুলোর এক একটির বর্তমান মূল্য ৬০/৬৫ মিলিয়ন ডলার। অথচ এই শিল্পী জীবদ্দশায় অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন। রং তুলি কেনার পয়সাও তাঁর জুটেনি।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রিক্স যাদুঘর। ভ্যানগগ যাদুঘরের পাশেই এর অবস্থান। বিশ্বখ্যাত ডাচ শিল্পীদের চিত্রকর্মের সংগ্রহ আছে এই যাদুঘরে। এরমধ্যে দুজন শিল্পী হচ্ছেন র‌্যামব্রান্ট এবং ভার্মিয়ার। এই মিউজিয়ামের সবচেয়ে বড়, মূল্যবান ও বিখ্যাত চিত্রকর্মটি শিল্পী র‌্যামব্র্যান্টের আকাঁ। দুজন পাহাড়াদার সবসময় ছবিটি আগলে রেখেছে। পুরো একটি ঘরে শুধু এই ছবিটিই রয়েছে। সবমিলিয়ে ১০ লক্ষাধিক চিত্রকর্ম রয়েছে এই যাদুঘরে। এরমধ্যে ৮ হাজার শিল্পকর্ম দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।
গাইডের সাথেই পায়ে হেঁটে আমরা আমস্টারডাম শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখছিলাম। একটু পর পর দেখছিলাম সাইকেল আরোহীদের সারি। তরুণ-তরুনী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউই বাদ নেই। ২/৩ বছরের বাচ্চাদের জন্য রয়েছে সাইকেলের পিছনে বা সামনে বসার বিশেষ ব্যবস্থা।
গাইড জানালো আমস্টারডাম শহরে মানুষের চেয়ে সাইকেল বেশী। দেশের প্রেসিডেন্টও নাকি সাইকেলে চড়ে অফিস করেন। সাইকেলের জন্য রয়েছে আলাদা লেন বা রাস্তা। এখানে-সেখানে প্রচুর দোকান রয়েছে, যেখানে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। পর্যটকরা চাইলে সাইকেল ভাড়া নিয়ে শহর ঘুরে দেখতে পারেন। ট্রেন অথবা ট্রামে সাইকেল নিয়ে উঠে পড়া যায়। তাছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে সাইকেলের জন্য রয়েছে সুবিশাল কয়েক তলা গ্যারেজ।
আমস্টারডাম শহরের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত কফি শপ। এইসব কফি শপে খাবার-দাবার, কফির সাথে মারিজুয়ানা, গাজা সহ বিভিন্ন ড্রাগস লিগ্যালি বিক্রয় হয়। গাইড জানালো এই কফি শপগুলোর টানেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণ-তরুনীরা ছুটে আসে আমস্টারডাম- যা ড্রাগ ট্যুরিজম নামে পরিচিত।
গাইড আরো জানায়, ওলন্দাজরা জাতি হিসেবে খুবই উদার। এই দেশে সমকামিতা বৈধ। কিন্ডারগার্টেন থেকেই বাচ্চাদের সেক্স সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়। এরা চায় বাচ্চারা যেনো সেক্স সম্পর্কে তাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালোমতো জানতে পারে।
ইতোমধ্যেই দলের সবার কয়েক ঘন্টা হাঁটা হয়ে গেছে। কিন্তু গাইডের আলাপ-আলোচনায় সবাই এতোটাই মগ্ন ছিলো যে কেউই ক্ষুধা-তৃষ্ণা টের পায়নি। গাইড-ই তা মনে করিয়ে দিয়ে আমাদের একটি খাবার দোকানে নিয়ে এলো। এখানে পাওয়া যায় স্থানীয় ডাচ ফুড। গাইড সবার মতামত নিয়ে অর্ডার দিলো আলু ভর্তা আর সবজি মিলিয়ে এক ধরনের ডাচ খাবার। সাথে ভেড়ার মাংস। শেষে আপেল কেক। যার যার পছন্দ মতো ড্রিংঙ্কস। যেহেতু বিদেশে আমি মাংস খাইনা, তাই বাকী খাবারগুলো খেলাম। টেষ্ট ছিলো দারুণ।
দিনের সবশেষে ছিলো নৌকা ভ্রমণ। জলযানে করে খালের পানিতে ভেসে বেড়ানো। আমাদের সাথের গাইড এই নৌকা ভ্রমণের দর্শক কারণ এখানে রয়েছে আলাদা গাইড। তিনি ইংরেজী এবং ডাচ ভাষায় ধারা বিবরণি দিচ্ছিলেন। খালের দুপাশে মধ্যযুগীয় বাড়ী-ঘরের সারি। এর অনেকগুলোর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। গাইডের বর্ণনায় তাই উঠে আসছিলো। আর আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম।