Categories
মধ্যপ্রাচ্য

নবীর শহরে শেষ দিন

আজ রাতেই মদিনা ছেড়ে জেদ্দার পথে রওনা হবো। সকাল ছয়টায় ফ্লাইট। তিনটায় রিপোর্ট করতে হবে এয়ারপোর্টে। শেষ দিন দূরে কোথাও না গিয়ে মসজিদে নববীতে বেশী সময় দেয়ার পরিকল্পনা করলাম। ঢাকার প্রাক্তন মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফের ভায়রা ভাই এবং সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের খালু হারুণ ভূইয়া তার এক আতœীয়ের সাথে দেখা করতে বলেছিলেন। তার নাম ইকবাল। যিনি গত ১৮ বছর যাবৎ মসজিদে নববীতে খাদেম হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি আগেও একবার আমার সাথে দেখা করে গেছেন। আজ মসজিদে নববীতে সারাদিন আমার সাথে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি হারাম শরীফ সংলগ্ন আমার হোটেল হিলটনে এলে তাকে নিয়ে মসজিদে নববীতে গেলাম।
ইকবাল জানান, প্রথম হিজরী সনে নির্মিত এই মসজিদের আয়তন ছিলো ৮৫০ দশমিক ০৫ বর্গমিটার। বিভিন্ন সময়ে মসজিদটির সংস্কার ও সম্প্রসারণ করার পর এর বর্তমান কাঠামো নান্দনিক রূপ নিয়েছে। এখন মসজিদটির আয়তন ৯৮ হাজার ৫০০ বর্গমিটার। মসজিদের ভিতর ১ লাখ ৬৬ হাজার, ছাদের উপর ৯০ হাজার এবং বাইরের আঙ্গীনায় মোট ২ লাখ ৫০ হাজার সহ সর্বমোট ৬ লাখ মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদে ১০টি মিনার ৮টি ফোল্ডিং ছাতা, ২৭টি গম্বুজ, ৭টি প্রবেশ পথ এবং ৮২টি দরজা আছে। মসজিদের বাইরে আন্ডার গ্রাউন্ডে তিন তলা পর্যাপ্ত টয়লেট, অজুর জায়গা এবং গাড়ী পার্কিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে পাঠাগার ও লাইব্রেরী।
ইকবাল আরো জানান, মসজিদে নববীতে প্রথমে কোন গম্বুজ ছিলো না। মসজিদের প্রথম সম্প্রসারণ উমাইয়া বংশের খলিফা ওয়ালিদ কর্তৃক হয়েছিলো। ১২৭৯ খ্রীষ্টাব্দে মসজিদে প্রথম কাঠের গম্বুজ তৈরী হয়। এরপর অনেকবার এর সংস্কার কাজ করা হয়। রওজা মোবারকের গম্বুজটিকে সবুজ রঙ-এ রঙ্গীন করা ১৮৩৭ সালে। মসজিদের বাইরেও বেশ কয়েকটি স্লাইডিং গম্ভুজ রয়েছে। জোহর নামাজের পর এই গম্বুজগুলো সরে যায় এবং মসজিদে সূর্যের আলো এসে পড়ে। এই স্লাইডিং গম্বুজগুলোর পরিকল্পনা করেন জার্মান স্থপতি মাহমুদ বডো রাসের। সমগ্র আরব উপদ্বীপের মাঝে মসজিদে নববীতে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি আসে ১৯০৯ সালে।
তারপর আমরা গেলাম রিয়াজুল জান্নাতে। মসজিদে নববীতে হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর রওজা মোবরক এবং তার সময়ের মূল মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থানকে বলা হয় রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেস্তের বাগান। মসজিদের অন্য কারপেটগুলো লাল রংয়ের হলেও এই জায়গার কার্পেট সবুজ-সাদা রংঙের। ভিন্ন রং-এর কার্পেট দেখে এই জায়গাটা সহজেই চেনা যায়। রিয়াজুল জান্নাত সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহ এই স্থানটুকু বেহেস্তে স্থানান্তর করবেন। এখানে নামাজ ও জিকির করলে রহমত ও সৌভাগ্য লাভ করা যায়। এই জয়গাটিতে নামাজ পড়ার জন্য সবসময় ভীড় হয়। সৌদী পুলিশরা গ্রুপে গ্রুপে এখানে প্রবেশ করার সুযোগ দেন। শুধুমাত্র ২ বা ৪ রাকাত নামাজ নামাজ পড়ার সময় পাওয়া যায়। তারা প্রায় ধাক্কিয়েই মুসল্লিদের বের করে দিয়ে অপেক্ষমান অন্য গ্রুপকে নামাজ পড়ার সুযোগ দেন। আমরাও খুব দ্রুত ২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিলাম।

রিয়াজুল জান্নাতের ভিতরে কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে। এগুলোকে রহমতের স্তম্ভ বলে। রসুল (সা:)-এর সময় মসজিদে নববীতে খেজুর গাছের খুটি ছিলো। ওসমানী সুলতান আব্দুল মজিদ খেজুর গাছের খুটির স্থলে পাকা পিলার নির্মাণ করেন। এগুলোর গায়ে মর্মর পাথর বসানো এবং স্বর্ণের কারুকাজ করা রয়েছে। রিয়াজুল জান্নাতের একটি খুটির নাম ওস্তোয়ানা হান্নানা। বাংলায় এর অর্থ ক্রন্দসী খুটি। হাদিসে বর্ণিত আছে প্রথম দিকে হুজুর (সা:) একটি খেজুর গাছের খুটির সাথে হেলান দিয়ে জুম্মার খুৎবা দিতেন। যখন স্থায়ী মিম্বার বানানো হলো তখন হুজুর (সা:) সেখানে দাঁড়িয়ে খুৎবা বয়ান করতে গেলে হুজুর (সা:)-এর সাথে বিচ্ছেদের কারণে এই খুটিটি এমন কান্না শুরু করে যে মসজিদের সব লোক স্তম্ভিত হয়ে যায়। তখন হুজুর (সা:) মিম্বর থেকে নেমে এসে খুটির গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে সে শান্ত হয়। পরে এই খুটিটি দাফন করা হয়।
একটি ভুল করার পর হযরত আবু লুবাবা (রা:) নিজেকে একটি খুটির সাথে বেধে বলেছিলেন, যতক্ষন পর্যন্ত হজুরে পাক (সা:) নিজ হাতে বাধন না খুলে দেবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সাথে বাঁধা থাকবো। নবী করিম (সা:) বলেন- যতক্ষন পর্যন্ত মহান আল্লাহ আমাকে আদেশ না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি সে বাঁধন খুলবো না। এভাবে দীর্ঘ ৫০ দিন পর হযরত আবু লুবাবা (রা:)-এর তওবা কবুল হয়। অতপর: রাসুল (সা:) নিজ হাতে তার বাঁধন খুলে দেন। ফেরেস্তা হযরত জিব্রাইল (আ:) যখনই হজরত দেহইয়া কালভী (রা:)-এর আকৃতি ধারণ করে ওহি নিয়ে আসতেন, তখন অধিকাংশ সময় যে খুটির কাছে বেশী বসে থাকতেন তাকে বলা হয় ওস্তোয়ানা জিবরাইল। হুজুর (সা:) যেখানে এতেকাফ করতেন এবং রাতে আরামের জন্য যে খুটির কাছে বিছানা স্থাপন করতেন সে খুটিকে বলা হয় ওস্তোয়ানা শারীর। এই খুটিটি হুজরা শরীফের পশ্চিম পাশে জালি মোবারকের সামনে রয়েছে। ওফুদ হলো ওয়াফদের বহুবচন। এর অর্থ হলো প্রতিনিধি। যেখানে বসে রসুল (সা:) দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিদের সাথে বসে আলাপ-আলোচনা করতেন সে খুটিটির নাম ওস্তোয়ানা ওফুদ। এখানে অনেক বিধর্মী রাসুল (সা;) এর কাছে বায়াত গ্রহণ করতেন। ইতিকাফের সময় মা আয়েশা (রা:) জানালা দিয়ে নবীজীর খেদমত করতেন। এই খুটিটির নাম ওস্তোয়ানা আয়েশা (রা:)। হারেস অর্থ পাহারাদার। যেখানে দাঁড়িয়ে হযরত আলী (রা:) নবীজীকে পাহারা দিতেন সেই খুটিটির নাম ওস্তোয়ারা হারেসা বা ওস্তোয়ানা আলী (রা:)। আমরা অত্যন্ত আদবের সাথে এসব খুটিগুলো জিয়ারত করলাম।
আমরা রিয়াজুল জান্নাত থেকে ডান দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে রসুল (সা:)-কে বিদায়ী সালাম জানিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মসজিদ চত্তরে বেরিয়ে এলাম। বিদায় নিলাম বিশ্ব মুসলিমের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চির জাগ্রত নবীর মসজিদ থেকে। যেখান থেকে সারা দুনিয়ার অর্ধেক থেকে বেশী এলাকা শাসন করা হতো ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে

হোটেলে নাস্তা সেরে আমার গাইড এরশাদউল্লাহর গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। আজকে আমাদের গন্তব্য খন্দকের যুদ্ধের মাঠ। যেখানে পঞ্চম হিজরীর সাওয়াল মাসে (৬২৭ খ্রী:) মক্কার কুরাইশ, মদিনার ইহুদী, বেদুঈন এবং পৌত্তলিকরা সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করেছিলো। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিলো মদিনার উপর গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দু:সহ অভিজ্ঞতা।
খন্দক শব্দের অর্থ পরিখা বা গর্ত। যেহেতু এই যুদ্ধে অনেক লম্বা পরিখা খনন করা হয়, তাই এই যুদ্ধের নাম দেয়া হয় খন্দকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আহজাব নামেও পরিচিত। আহজাব অর্থ সম্মিলিত বাহিনী।

জাবালে মালাইকার পাদদেশে লেখক
জাবালে মালাইকার পাদদেশে লেখক

খন্দকের যুদ্ধের কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকরা যে ব্যাখ্যা দেন তা হলো বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা কোরাইশদের উপর নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। তারপরেই প্রতিশোধ গ্রহণে মরিয়া হয়ে তারা অহুদের যুদ্ধ বাধায়। যাকে ঐতিহাসিকরা নিষ্ফল বিজয় বলে আখ্যায়িত করেন। অহুদের যুদ্ধে কোরাইশরা চেয়েছিলো হযরত মুহাম্মদ (সা:)-কে হত্যা করে ইসলামের নাম-নিশানা স্তব্ধ করে দিতে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সেজন্য মরিয়া হয়ে ৬২৭ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে ১০ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয় কোরাইশদের এই জোট। সেই খবর পেয়ে সাহাবীদের নিয়ে জরুরী বৈঠকে বসেন হযরত মুহাম্মদ (সা:)। সিদ্ধান্ত হয় শহরের ভিতর থেকে কোরাইশদের আক্রমণ প্রতিহত করা হবে। সৈন্য সংগ্রহ শুরু হলে দেখা গেলো বাছাই প্রক্রিয়া শেষে সর্বমোট ৩ হাজার সৈন্যের জোগার হয়েছে। এতো অল্প সংখ্যক সৈন্য দিয়ে ১০ হাজার সৈন্যের মোকাবেলা কিভাবে হবে এজন্য সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমন সময় এক অসাধারণ যুদ্ধ পদ্ধতির ধারণা নিয়ে আসেন সাহাবী সালমান ফার্সী। তিনি বলেন নগরীর উত্তর ও পশ্চিম দিক সবচেয়ে বেশী অরক্ষিত। তাই ওদিক দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। তিনি এই দিক দিয়ে পরিখা খনন করার পরামর্শ দিলেন। তার পরামর্শ সবার মনোপুত হলে সকলের পরিশ্রমে পরিখা খনন হয়ে যায়। রাসুল (সা:) নিজেও এই খনন কাজে অংশ নেন। কুরাইশ বাহিনী এসে মুসলিম বাহিনীর এই কৌশল দেখে হতচকিত হয়ে যায়। মাঝেমাঝে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের ১০জন নিহত হয়। মুসলিম পক্ষের ৬ জন শহীদ হন। এভাবেই ২৭দিন থাকার পর কাফেরদের উপর গজব হিসেবে ঘুর্ণিঝড় নেমে আসে। ঝড়ে কাফেরদের তাবুসমূহ উড়িয়ে নিয়ে যায়। এবং তারা যুদ্ধ ক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, খন্দক যুদ্ধ নিয়ে আল্লাহপাক সুরা আহজাবে ৯ থেকে ২৭ পর্যন্ত ১৯টি আয়াত নাজিল করেন।
খন্দকের যুদ্ধ ক্ষেত্রের পরিখাগুলোর কোন চিহ্ন এখন আর নেই। যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ৭টি মসজিদ। যুদ্ধের সময় হযরত সালমান ফার্সী (রা:), হযরত আবু বকর (রা:), হযরত সাদ বিন মা’জ (রা:), হযরত আলী (রা:) যেখান থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সেখানে পরবর্তীকালে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে যুদ্ধের সময় নবী কন্যা হযরত ফাতিমা (রা:)-এর তাবু ছিলো সেখানে তাঁর নামে একটি মসজিদ এবং সর্বশেষ খন্দকের যুদ্ধের বিজয়কে স্মরণে রেখে মসজিদ আল ফাতাহ সহ মোট ৭টি মসজিদ নির্মিত হয়। সবগুলো মসজিদ একত্রে আসসাবায়া বা ৭ মসজিদ নামে পরিচিত।
গাইড এরশাদউল্লাহর তাড়া খেয়ে দ্রুত গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। এবারের গন্তব্য মদিনা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে বদরের মাঠ। মুসলিম ইতিহাসের প্রথম সশ¯্র যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এই বদরের মাঠে। ৬২৪ খ্রীষ্টাব্দে তথা দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজানে অনুষ্ঠিত হয় ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ও গৌরবময় অধ্যায় এই বদরের যুদ্ধ। বদর প্রান্তরেই মহান আল্লাহ প্রায় নির¯্র রাসুল (সা:) ও তাঁর সঙ্গীদের কাফেরদের সশ¯্র মোকাবেলায় বিজয়ী করেছিলেন।
গাড়ী এসে থামলো বদর প্রান্তরের পাশে একটি মসজিদের সামনে। গাড়ী থেকে নেমে আমরা গেলাম ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে। এখানেই মুসলিম বাহিনীর সাথে কোরাইশদের সম্মুখ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা:) নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ৩১৩জন মুসলমান অসামান্য রণ নৈপূন্য প্রদর্শণ করে বদরের যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। কুরাইশরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মক্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ১৪জন মুসলিম সৈন্য শাহাদৎ বরণ করেন। এরমধ্যে ৬জন মোহাজীর ও ৮জন আনসার ছিলেন। আবু জেহেল, ওৎবা, সায়েরা, অবু জেহেলের ভ্রাতা আছি, আবু সুফিয়ানের পুত্র আনজেলা সহ শতাধিক কাফের নিহত হয়। কুরাইশরা আবু জেহেলের মরদেহ যুদ্ধের ময়দানে ফেলেই পালিয়ে যায়। পরে মুসলমানরা বদর মাঠের এক কোণায় মাটিতে গর্ত করে তাকে পুতে রাখে। কোন এক সময় কেউ তার কবরটি চারিদেকে মাটি সমান দেয়াল দিয়ে পাকা করে দেয়। আমরা কবরের কাছে গেলাম। ভেতরে ময়লা আবর্জনার স্তুপ। মক্কায় দেখেছি হারাম শরীফ সংলগ্ন আবু জেহেলের বাড়িটি গণ টয়লেটে পরিণত করা হয়েছে। আর এখানেও মৃত্যুর পর অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে তার কবর। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (সা:) বিরোধীতার কি পরিণতি হয় আবু জেহেল এর প্রমাণ। এরশাদউল্লাহ জানালেন এক সময়ের বদর প্রান্তর এখন একটি সমৃদ্ধ শহর। এখানে বর্তমানে ১০ হাজার লোকের বসবাস। পরিকল্পিভাবে এই শহরটি গড়ে উঠছে। সৌদি বাদশা কর্তৃক নিয়োজিত একজন প্রশাসক আছেন এই শহরে। মাঠের পাশেই আরবীতে লেখা বিশাল সাইনবোর্ড। এখানেই শহীদ সাহাবাদের নাম লেখা আছে। তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া করে আমরা আবার গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।
অল্পক্ষণ পরেই গাড়ী এসে থামলো একটি বালুর পাহাড়ের সামনে। আশেপাশে সব রুক্ষ পাথরের পাহাড়। এর মাঝে এই বালুর পাহারটা বড়ই বেমানান। এরশাদউল্লাহ জানান, এটাকে বলে জাবালে মালাইকা বা ফেরেস্তাদের পাহাড়। রাসুল (সা:) যুদ্ধের আগের রাতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানান, হে আমার প্রভু আমরা মাত্র ৩১৩জন অপরদিকে শত্রুরা এক হাজার। এরা যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তবে দুনিয়ার বুকে আপনার নামের মহিমা প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে। রাসুল (সা:) প্রার্থনার সময় তাঁর হাত এতো উপরে উঠিয়েছিলেন যে, তাঁর কাধ থেকে চাদর মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো। তখন আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো- আমি আপনার সাহায্যে মালাইকা বা ফেরেস্তা প্রেরণ করেছি। শত্রুদের এক হাজারের জন্য আমার একজন ফেরেস্তাই যথেষ্ট, আপনি হাত নামান। আমি আপনাকে বিজী ঘোষণা করলাম এবং আপনার সাথে ৩১৩ জনকেও আগাম জান্নাতি ঘোষণা দিলাম। এরশাদউল্লাহ আরো বলেন, এই বালির পাহাড়েই ফেরেস্তারা অবস্থান নিয়েছিলেন বলে একে জাবালে মালাইকা বা ফেরেস্তাদের পাহাড় বলা হয়। কোরআন পাকে এই পাহাড়ের কথা উল্লেখ আছে। পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে একটু দোয়া করে আমরা রওনা দিলাম নতুন গন্তব্যে।
এবার গাড়ী এসে থামলো মূল রাস্তা থেকে একটু দূরে একটি কুপের কাছে। এরশাদউল্লাহ জানালেন- এটাকে বলা হয় বীর এ রোহা। আবার অনেকে এটাকে বীর এ শেফা বলেও অভিহিত করেন। আরবীতে বীর অর্থ কুপ, রুহা মানে থুথু বা লালা আর শেফা মানে আরোগ্য। এই কুপটির রয়েছে একটি ইতিহাস। রাসুল (সা:) যখন বদর যুদ্ধ শেষে এই পথ ধরে মদিনায় ফিরছিলেন, তখন সাহাবীরা পিপাসার্ত হলে তাঁরা এই কুপের কাছে আসেন। কুপের পানি তোলা হলে দেখা গেলো পানি খুবই লবনাক্ত। কিছু সাহাবী এই পানি পান করার পর অসুস্থ হয়ে গেলেন। রাসুল (সা:) তখন তার লালা মোবারক এই পানিতে ফেলে তিনি আবার পানি তুলে তা সাহাবীদের পান করতে বলেন। আল্লাহর কুদরত আর রাসুল (সা:)-এর লালা মোবারকের বরকতে এই লবনাক্ত পানি মিষ্টি হয়ে গেলো। আর যারা এই পানি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তারাও সুস্থ্য হয়ে গেলেন। এজন্যই এই কুপের আরেক নাম আরোগ্যের কুপ। কুপটি গভীরতায় প্রায় ২০ মিটার। ১৪৫০ বছর আগে এই কুপটি খনন করা হয়।
আমরা কুপের পাশেই অনেক গাড়ীর লাইন দেখতে পেলাম। আরব দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পানি সংগ্রহ করতে তারা এসেছে। আমরাও পাশের একটি দোকান থেকে একটি কনটেইনার ক্রয় করে কিছু পানি সংগ্রহ করলাম। পানির জন্য কোন মূল্য দিতে হয়নি। জানা যায়, মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে রাসুল (সা:) এখানে বহুবার থেমে নামাজ আদায় করেছেন। আরো অনেক নবী ও রাসুল এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এখানে থেমেছেন এবং নামাজ আদায় করেছেন। হযরত আনাস (রা:) এবং হযরত আবু মুসা আনসারী (রা:)-এর বরাত দিয়ে উল্লেখ আছে যে, রাসুল (সা:) বলেছেন- মক্কা যাওয়ার পথে কমপক্ষে ৭০জন নবী এখানে থেমে নামাজ আদায় করেছেন। একসময় এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। সংস্কারের অভাবে এখন মসজিদটি ভাঙাচুড়া অবস্থায় আছে।
সারাদিনের ঘুরাঘুরিতে সবাই ছিলাম ক্লান্ত। গাইড এরশাদউল্লাহকেই দীর্ঘ পথ ড্রাইভ করতে হবে। তাই আজকের মতো জিয়ারতে বিরতি দিয়ে ছুটে চললাম নবীর শহর মদিনায় আমাদের হোটেলের দিকে।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

মদীনার জ্বীনের পাহাড়

কেউ বলে জ্বীনের পাহাড়। কেউ বলে যাদুরর পাহাড়। ইউরোপীয়ানরা বলে ঘোষ্ট ভেলী। আর আরবদের কেউ ডাকে ওয়াদি আল আবইয়াজ, ওয়াদিয়ে জ্বীন, ওয়াদি রাজা। কেউ বা অন্য কোন নামে। তবে যে নামেই পরিচিত হোক না কেনো এটি পৃথিবীর এক অবাক বিস্ময়। এখানে সবকিছু ঢালুর বিপরীতে গড়ায়। মানে সাধারণ নিয়মের সব উল্টো। এখানে হার মেনে যায় বিজ্ঞানের সব সূত্র। দুনিয়া জোড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতো প্রসারের পরেও আজ অবদি এই অপার রহস্যের উদঘাটন করতে পারেনি কেউ। আজো বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছে এই অদৃশ্য শক্তির পাহাড়।
জায়গাটি সৌদী আরবের মদীনা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। সেই জ্বীনের পাহাড় দেখবো বলে নিউইয়র্ক থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে গিয়েছিলাম।
আগেরদিন মদীনার আশেপাশে অনেকগুলো ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখেছি। সেগুলোর মধ্যে ছিলো বদর, ওহুদ এবং খন্দকের যুদ্ধ ক্ষেত্র। বীরে রোহা, জবলে মালাইকা, জান্নাতুল বাকী, মসজিদে কুবা, মসজিদে কেবলা তাইন, মদীনা গভর্নর হাউজ সহ আরো অনেক ঐতিহাসিক স্থান। গাইডকে বলা ছিলো আজ জ্বীনের পাহাড় দেখতে যাবো। কথামত তিনি সকাল ৬টায় এসে আমাকে হোটেল থেকে উঠিয়ে নিলেন।
মদীনায় আমার গাইডের নাম এরশাদ উল্লাহ। বাড়ী ঢাকার গাজীপুরে। ৩৫ বছর ধরে বসবাস করছেন নবীর শহর মদীনায়। তার কাজ হজ বা ওমরাহ করতে আসা লোকদের ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখানো। বলা যায় সৌদি আরবের বেশীর ভাগ জায়গা তার হাতের তালুর মতো চেনা।
গাড়ী চলছে রাজপথ ধরে। দুপাশে কালো কালো পাথরের পাহাড়। পাহাড়ের কাছ দিয়ে শুকনো পানি শূন্য খাল। গাড়ীর আওয়াজ ছাপিয়ে কানে আসছে আমার গাইডের ধারা বর্ণনা। ওয়াদি বলা হয় পানি জমা হওয়ার ছোট ছোট খাল-কে। এই খালে বৃষ্টির সময় পানি জমা হয়। আর সে পানি খুব মিষ্টি।
একটু পর পর খেজুর বাগান। পাশেই ন্যাড়া পাহাড়। পাহাড়ের উপর ধারালো সূচের ন্যায় পাথর। এমন পাহাড় নাকি শুধুমাত্র এই এলাকায়-ই। সৌদি আরবের অন্য কোথাও এ ধরনের পাহাড় চোখে পড়ে না। পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা সড়ক। আর সেই সড়কেই লুকিয়ে আছে অপার বিস্ময়।
এরশাদ উল্লাহ জানান, ২০০৯-১০ সালের দিকে সৌদি সরকার এই এলাকায় রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত কাজ করার পর সমস্যা শুরু হয়। হঠাৎ দেখা যায় রাস্তা নির্মাণের যন্ত্রপাতি আসে আস্তে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মদিনা শহরের দিকে চলে যাচ্ছে। কোন অদৃশ্য শক্তিগুলো যেনো যন্ত্রপাতিগুলোকে মদীনার দিকে ঠেলছে। এমনকি পিচ ঢলাইয়ের ভারী রোলারগুলো বন্ধ থাকা অবস্থায় আস্তে আস্তে ঢালু বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। এসব দেখে কর্মরত শ্রমিকরা ভয় পায়। এবং তারা কাজ করতে অস্বীকার করে। ফলে রাস্তা নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তাটি ২০০ কিলোমিটার করার কথা থাকলেও মাত্র ৩০ কিলোমিটার করেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়।
দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটি মদিনার দিকে চলে গেছে এটি ক্রমেই উঁচুতে উঠে গেছে। কিন্তু অবাক করা কান্ড হলো গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেও গাড়ী উচুঁ পথের দিকে চলতে থাকে। আরো একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই সড়কের একেবারে শেষ প্রান্তে প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কে গাড়ী চলতে কোন তেল লাগে না। ইঞ্জিন বন্ধ অবস্থায়ও গাড়ী চলতে থাকে ১০০ মিটার বেগে।
গাইড এরশাদ উল্লাহ তার পা গাড়ীর এক্সেলেটর থেকে তুলে সীটের উপর রাখলেন, ইঞ্জিন নিউট্রাল করে দিলেন। অবাক কান্ড স্পীড মিটার ক্রমেই ১৪০ মিটার বেগে গাড়ীর গতি দেখাচ্ছিলো। এই রহস্যময় সীমার এক প্রান্তে এসে এরশাদ উল্লাহ গাড়ী থামিয়ে একটি পানির বোতল রাস্তার ওপর রাখলেন। কি অবাক করা কান্ড? পানির বোতলটি ঢালুর বিপরীতে গড়িয়ে যেতে লাগলো। বোতল থেকে পানি ঢাললাম, তাও বিপরীতেই গেলো।
কেউ কেউ বলে পাশের পাহাড়ে চুম্বক আছে, যা গাড়ীকে উল্টোদিকে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু আমরা সবাই জানি চুম্বক কেবলমাত্র লোহাকেই টানে। পানির বোতল, জুতা বা বোতল থেকে রাস্তায় পানি ঢাললে তাও ঢালের বিপরীতের দিকে গড়াতে থাকে। এ প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারেননি।
দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে রাস্তাটি যেখানে গিয়ে শেষ হয়ে ইউটার্ন নিয়ে ফের মদিনার দিকে চলে গেছে সেখানেই গাড়ী পার্ক করলেন এরশাদ। আমাকে সুযোগ দিলে দুইপাশের পাহাড়ের ছবি তোলার সুযোগ দিলেন। দেখলাম বেশকিছু শ্রমিক রাস্তা পরিষ্কার করার কাজ করছে। চেহারা সূরত দেখে বাঙালী বলে মনে হলো। কাছে গিয়ে আলাপ করতেই আমার কথার সত্যতা পেলাম। তাদের সবার বাড়ী বৃহত্তর কুমিল্লার চাঁদপুরে। দিনের বেলায় এখানে কাজ করেন আর সন্ধ্যায় চলে যান মদীনা শহরে। এই রাস্তাটা খোলা রাখা হয় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এরপর আর কোন গাড়ী বা মানুষকে এই এলাকায় আসতে দেয়া হয় না। কেউ এই এলাকায় থাকতে চাইলেও অনুমতি দেয়া হয় না।
তারা আরো জানান, এই এলাকার উল্টো রীতি নিয়ে বিভিন্ন ধরণের জনশ্রুতি আছে। তা হলো- এই
পাহাড়ের উপরে উঠে নবী করীম (সা:) জ্বীনদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তখন নাকি কিছু জ্বীন পালিয়ে যেতে চায়। তাই বয়স্ক জ্বীনরা তাদের পালানো ঠেকাতে পথ উল্টে দেয়। তাই এখানে সব কিছু উল্টা চলে।
তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। এরশাদ উল্লাহ জানান- বর্তমানে ওয়াদি আল জ্বীন এলাকটি পর্যটন স্পট হিসেবে ধীরে ধীরে পরিচিতি পাচ্ছে। স্থানীয় আরবরা এখানে ছুটির দিনে অবসর কাটাতে আসেন। এখানে ছোট ছোট গাড়ী ভাড়া দেয়ার দোকান গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে গাড়ী ভাড়া নিয়ে উল্টো পথে গাড়ী চলার অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়।
মদীনার রহস্যময় এই পাহাড় নিয়ে রীতিমত হৈচৈ চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক এখানে আসে এই জ্বীনের পাহাড় দেখতে। প্রতি বছর হজ্ব ও ওমরাহ করতে আসা মানুষও এই রহস্যময় জ্বীনের পাহাড় দেখতে ভীড় জমান।
বেলা যতই বাড়ছিলো প্রচন্ড তাপমাত্রায় অস্থির হয়ে উঠছিলাম। গাড়ীর এসিও মনে হয় কাজ করছিলো না। তাই রহস্যময় এলাকা থেকে মদীনার দিকে গাড়ী চালাতে এরশাদ উল্লাহকে অনুরোধ জানালাম।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

মদিনার স্মৃতিময় স্থান

আমার লোকাল গাইড এরশাদউল্লাহর সাথে কথা ছিলো সকাল ৮টায় হোটেল লবিতে অপেক্ষা করবো। তিনি ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সময়েই এলেন। গাড়ীর কাছে যেতেই তিনি বললেন- একটু অপেক্ষা করুন আমি হোটেলের পার্কিং লটে গাড়িটা রেখে আসি। আজ আপনাকে প্রথমে হারাম শরীফ সংলগ্ন মসজিদে গামামা দেখিয়ে আনবো।
মক্কা-মদিনার আনাচে-কানাচে মসজিদের ছড়াছড়ি। তবে এখানকার প্রতিটি মসজিদের সাথে জড়িয়ে আছে নানান ইতিহাস এবং রাসুল (সা:)-এর অসংখ্য স্মৃতি। তাই একটু উৎসুক্য নিয়েই তার সাথে হাঁটা শুরু করলাম। হোটেল থেকে ৭/৮ মিনিট হাঁটার পর মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায় হারাম শরীফের ৭ নং গেট সংলগ্ন মসজিদে গামামার সামনে গিয়ে পৌছলাম। মসজিদটি হারাম শরীফ সংলগ্ন হওয়ায় এখন আর নামাজ হয় না। মসজিদের সামনে গিয়েই এর ইতিহাস জানালের এরশাদউল্লাহ।
রাসুল (সা:) এই মসজিদের সামনের মাঠেই হিজরী দ্বিতীয় সালে প্রথম ঈদের নামাজ পড়েন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই মসজিদকে তিনি দুই ঈদের জন্য ঈদগাহ হিসেবে ব্যবহার করছেন। একবার বৃষ্টির অভাবে মানুষজন খুব কষ্ট পাচ্ছিলো, তখন রাসুল (সা:) এই মসজিদে বৃষ্টির জন্য ইশতিশকার নামাজ পড়েন। দোয়ার পড়েই আকাশে মেঘ জমে উঠলো, প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো। আরবীতে গামামা অর্থ মেঘ। নামাজের পরপরই আকাশে মেঘ জমে বৃষ্টিপাত হয়েছিলো বলেই এই মসজিদের নামকরণ করা হয় মসজিদে গামামা।

‘গারস ওয়েল’ বা গারস কুপ-এর সামনে লেখক
‘গারস ওয়েল’ বা গারস কুপ-এর সামনে লেখক

এই মসজিদটি আরো একটি কারণে বিখ্যাত। তাহলো আবিসিনিয়ার নওমসুলিম বাদশা নাজ্জাসীর মৃত্যুর পর হযরত মুহাম্মদ (সা:) এখানেই তার গায়েবানা নামাজ পড়ান। উল্লেখ্য, নাজ্জাসী চিঠির মাধ্যমে রাসুল (সা:) এর দ্বীনের দাওয়াত পেয়ে খৃীষ্টান ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম কবুল করেছিলেন। এমন কি মক্কার কাফেরদের হাতে নির্যাতিত কিছু মুসলমান নবীজীর নির্দেশে তাঁর কাছে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থণা করলে তিনি তাদের আশ্রয় দেন। কোরাইশদের একটি প্রতিনিধি দল তাদের ফিরিয়ে আনতে গেলে তিনি মুসলামানদের তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান।
গামামা মসজিদটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। গম্বুজ দ্বারা নির্মিত হয়েছে তার ছাদ। উত্তর দিকে ছোট ছোট ৫টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩২ দশমিক ৫ মিটার এবং প্রস্থ ২৩ দশমিক ৫ মিটার। ৭৪৮ হিজরী থেকে ৭৫২ খৃীষ্টাব্দ পর্যন্ত হোসাইন বিন কালাউন মসজিদটি সংস্কার করেন। সর্বশেষ সৌদি সরকার ২ মিলিয়ন রিয়াল ব্যয় করে মসজিদটি সংস্কার করেন। বর্তমানে সৌদি আওকাফ মন্ত্রনালয়ের তত্ত্বাবধানে মসজিদটি পরিচালিত হয়।
মসজিদে গামামার খুব কাছে আরো তিনটি ছোট ছোট মসজিদ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে মসজিদে আবু বকর, মসজিদে ওমর এবং মসজিদে আলী (রা:)। এই মসজিদগুলো হারাম শরীফের সন্নিকটে বিধায় মসজিদগুলোতে নামাজ আদায় হয় না। এই স্থানগুলোতে দাঁড়িয়ে হযরত আবু বকর, হযরত ওমর এবং হযরত আলী দাড়িয়ে হুজুরের পাহাড়ায় নিয়োজিত থাকতেন। পরবর্তীতে এই স্থানগুলোতে তাঁদের নামে মসজিদ তৈরী করা হয়।
আমাদের এখানে অপেক্ষা করতে বলে এরশাদউল্লাহ গাড়ী আনতে গেলেন। একটু পরেই তিনি ফিরে এলে তার সাথে আমরা রওনা হলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ‘উহুদ প্রান্তরে’। এই পাহাড়ের পাদদেশেই সংগঠিত হয়েছিলো ঐতিহাসিক উহুদ যুদ্ধ। এই যুদ্ধেই মুহাম্মদ (সা:)-এর দাঁত মোবারক শহীদ হয়। উহুদের যুদ্ধে যে ৭০জন সাহাবী শহীদ হন তাদের সবার কবর এখানে রয়েছেন। এখানে রসুল (সা:)-এর চাচা সাইয়াদুল শোহাদা হযরত আমীর হামজা (র:)-এর কবরও রয়েছে।
উহুদ পর্বত মদিনা শহরের উত্তরে অবস্থিত। এর উচ্চতা ৩,৫৩৩ ফুট। উহুদ পর্বতের দক্ষিণে রূমা পাহাড়। যুদ্ধের সময় এই পাহাড়েই রসুল (সা:) তীরন্দাজ বাহিনীর সমাাবেশ করেন। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সেখানেই অবস্থান করার নির্শেদ প্রদান করেন। কিন্তু যুদ্ধের প্রথম দিকে মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হলে তীরন্দাজ বাহিনী মালে গণিমত কুড়ানের জন্য মাঠে নেমে পড়েন। এই সুযোগে কাফেরদের সেনাপতি খালেদ বিন ওয়ালীদ পিছন থেকে আক্রমণ করে মুসলমানদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এই যুদ্ধে ৭০ জন মুসলান নিহত হন, অপরদিকে শত্রু পক্ষে নিহত হন ২৩ জন।
উহুদের মাঠে খোলা চত্তরেই বাম পাশে দেয়াল ঘেরা প্রশস্ত কবর স্থানে শুয়ে আছেন উহুদ যুদ্ধের শহীদরা। সবার আগে প্রথম কবরটি শহীদদের নেতা হযরত আমীর হামজা (রা:)-এর। তাঁর স্মৃতি অমর করে রাখতে এখানেই নির্মিত করা হয়েছে মসজিদে শোহাদা। আমরা শহীদদের কবর জিয়ারত করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।
নবীর শহর মদিনায় আমি বেশ কয়েকবার এসেছি। এই নগরী এবং তার আশেপাশে চলতে গিয়ে বারবার শিহরীত হই। যেসব জায়গায় আমরা জিয়ারত করতে যাই তার প্রতিটি স্থান রাসুল (সা:)-এর কদম মোবারকের স্পর্শে ধন্য। এসব জায়গায় পড়েছে সাহাবাদের পদধূলি। যে শহরটিতে শুয়ে আছেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) সেখানে সকাল-বিকাল আগমন ঘটতো ফেরেস্তাদের সরদার হযরত জিরাইল (আ:)-এর। সে সব জায়গায় জুতা পায়ে চলাফেলা করায় নিজকে বড় অসহায় মনে হয়।

ওহুদের মাঠে শহীদানদের কবর জিয়ারতে কয়েকজন বাংলাদেশী
ওহুদের মাঠে শহীদানদের কবর জিয়ারতে কয়েকজন বাংলাদেশী

এরশাদউল্লাহ এবার আমাদের নিয়ে এলেন একটি কুপের কাছে। ইংরেজীতে সাইনবোর্ড টাঙ্গানো আছে ‘গারস ওয়েল’ বা গারস কুপ। জায়গাটি মসজিদে কুবা থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তরে। গাড়ী থেকে নেমে কুয়াটির কাছে এলাম। লোহার নেট দিয়ে আটকানো কুয়াটির চারদিক। এরশাদ ভাই জানালেন এটি ছিলো একটি মিস্টি পানির কুয়া। রাসুল (সা:) নিয়মিত এখানে আসতেন। এই কুপের পানি দিয়ে গোসল ও ওজু করতেন। এই কূপের পানি পান করতেন। তিনি এক সময় হযরত আলী (রা:)-কে ডেকে বলেন- মৃত্যুর পর যেনো এই কুপের পানি দিয়ে তাঁর শেষ গোছল করানো হয়। হযরত আলী (রা:) তাঁর কথামতো এখানকার পানি দিয়ে রাসুল (সা:)-কে শেষ গোছল করিয়েছিলেন।

জুতা পায়ে এই কুপের চারিদিকে হাঁটতে গিয়ে নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হচ্ছিলো। এই কুপের চারিদিকে পড়েছে হযরত রাসুল (সা:) এবং তাঁর সাহাবীদের পদধুলী। তাই দ্রুত গাড়ীতে ফিরে এলাম। এই কুপটি বর্তমানে সৌদী আরবের একটি ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচিত। সৌদি কমিশন ফর ট্যুরিজম এবং ন্যাশনাল হেরিটেজ বর্তমানে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো তাই ফিরে এলাম হোটেলে। একটু বিশ্রাম নিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করার জন্য রওনা দিলাম মসজিদে নববীর উদ্দেশ্যে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম হারাম শরীফের আঙ্গীনায় স্থাপিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছাতাগুলো মসজিদে নববীর বাইরে যারা নামাজ আদায় করবেন, তাঁদের সূর্য্য তাপ থেকে রক্ষার জন্য ছাতা টানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। জার্মান স্থপতিদের দ্বারা এই ছাতাগুলো লাগানো হয়েছে। এর বৈশিষ্ট হচ্ছে এগুলো ভাজ করা যায়। ছাতাগুলো খুলে দিলে মসজিদের ১ লাখ ৪৩ হাজার বর্গমিটার জায়গা ডেকে যায়। ছাতায় বেশ কয়েক ধরনের ফিলটার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে করে প্রায় ৮ ডিগ্রি পরিমান তাপমাত্র কমে যায়। প্রতিটি ছাড়া উচ্চতায় ৩০ মিটার। ছাতাগুলো স্থাপন করা হয়েছে মসজিদুল হারামের সম্প্রসারিত ও বর্ধিত উত্তর-পশ্চিম আঙ্গীনায়।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

জিয়ারতে মদিনা

সকাল ৮টায় হোটেলে নাস্তা সেরে লবিতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। ৮টা ১৫ মিনিটে আমাকে নিতে এলেন এরশাদ ভাই। তিনি গত ৩৫ বছর যাবৎ মদিনায় বসবাস করেন। আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিরপুরের সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের ভগ্নিপতি। মদিনা এলেই তিনি আমার লোকাল গার্ডিয়ান। এয়ারপোর্টে রিসিভ করা, হোটেলে নিয়ে আসা, জিয়ারত সবই চলে তার তত্ত্বাবধানে। সবশেষে আমাকে মদিনা এয়ারপোর্ট বা মক্কার উদ্দেশ্যে গাড়ীতে তুলে দিয়েই তার ছুটি। আমি মদিনায় এলে তার সব কাজ বন্ধ। তার কাজ শুধুই আমাকে সময় দেয়া।

ইসলামের প্রথম মসজিদ কুবা
ইসলামের প্রথম মসজিদ কুবা

সম্প্রতি তার সাথে যুক্ত হয়েছেন আরো একজন। নাম রিয়াজুল ইসলাম, বাড়ী সিরাজগঞ্জ। হারাম শরীফের পাশেই একটি বড় হোটেলের রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজার। একবার আমি তার হোটেলে উঠেছিলাম। প্রথম পরিচয়েই তার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এখন তার হোটেলে না উঠলেও আমি মদিনায় আসলেই তিনি আমার ছায়া সঙ্গী। কাজ থেকে ছুটি নিয়ে আমার সাথে ঘুরে বেড়ান। আজও আমি তাকে হোটেল থেকে তুলে নিয়েছি।
মদিনা এলেই রসুল (সা:)-এর মাজার জিয়ারতের পর দ্বিতীয় প্রায়োরিটি হিসেবে যেখানে যাই তাহলো মসজিদুল কোবা। এটি ইসলামের তৃতীয় মসজিদ। পৃথিবীর প্রথম মসজিদ হচ্ছে বায়তুল্লাহ মসজিদুল হারাম। এরপর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস। আর তৃতীয়টি হচ্ছে মসজিদে কোবা। আর চতুর্থ মসজিদ হচ্ছে মসজিদে নববী। আল্লাহর নির্দেশে মোহাম্মদ (সা:) যখন মক্কায় হিজরত করেন তখন তিনি কোবা নামক পল্লীতে অবস্থান করেন এবং সেখানেই তিনি এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। পবিত্র কোরআনের সূরা তৌবার ১০৮ নম্বর আয়াতে এই মসজিদের কথা উল্লেখ রয়েছে। মসজিদটি মদিনা শরীফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে অবস্থিত। এর দূরত্ব মসজিদে নববী থেকে ৫ কিলোমিটার। রসুল (সা:) এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি নিজের ঘরে ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করে মসজিদে কোবায় আগমণ করে নামাজ আদায় করেন তিনি একটি ওমরাহর সমপরিমান সওয়াব পাবেন। আর সেজন্যই রসুল (সা:) এর সময় থেকেই মসজিদে কোবায় গমন করা মদিনাবাসীদের অভ্যাসে পরিণত হয়।
মসজিদে কোবায় আমরা দু’ রাকাত নামাজ আদায় করে রওনা হলাম মসজিদে কেবলাতাইনের দিকে। গাড়ীতে উঠেই আমার গাইড এরশাদউল্লাহ মসজিদে কেবলাতাইনের কিছু তথ্য দিলেন। এই মসজিদে নামাজ পড়ার সময় মুহাম্মদ (সা:)-এর কাছে কিবলা পরিবর্তনের ওহি আসে। মহানবী (সা:) মদিনায় হিজরত করার পর প্রায় ১৬ মাস বায়তুল মোকাদ্দেসের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। মুসলমানদের কিবলা বায়তুল মোকাদ্দেসের দিকে হওয়ার কারণে ইহুদীরা এই বলে অপপ্রচার চালাতে থাকলো যে, আমাদের ও মুসলমানদের কেবলা এক ও অভিন্ন, অতএব ধর্মের ক্ষেত্রেও মুসলমানদের উচিৎ আমাদের অনুসরণ করা। এসব কারণে হুজুর (সা:) এর হৃদয়ে সুপ্ত বাসনা ছিলো কাবা যদি মুসলমানদের কিবলা হতো? হিজরী দ্বিতীয় সনের শাবান মাসে তিনি আসরের নামাজ আদায়েরর জন্য মসজিদে আসেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকাতের মাঝামাঝি সময়ে আল্লাহর হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর ইচ্ছা বাস্তবায়নে জিরাইল (আ:) মহান আল্লাহর বাণী নিয়ে অবতীর্ণ হন। এই বাণীতে কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়। এই ঘটনাটি সুরা বাকারার ১৪৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। দুই রাকাত বায়তুল মোক্কাদ্দেস-এর দিকে আর দুই রাকাত কাবা শরীফের দিকে ফিরে আদায় করেছিলেন বিধায় এই মসজিদটি ইতিহাসে মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কেবলা বিশিষ্ট মসজিদ নামে সুপরিচিত। রসুল (সা:) এর যুগ থেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই মসজিদে দুটি মেহরাব বা ইমামের দাঁড়ানোর স্থান ছিলো। পরে সংস্কারের সময় বায়তুল মোক্কাদ্দেস মুখী মেহরাবটি ভেঙ্গে ফেলা হয়।
আমরা গাড়ী থেকে নেমে অজু করে মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলাম। ঐতিহ্যবাহী আরবীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই ঐতিহাসিক মসজিদে মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা ২ হাজার। মসজিদটির আয়াতন ৩,৯২০ স্কয়ার মিটার। মসজিদটিতে ২টি গুম্বুজ ও ২টি মিনার রয়েছে। উল্লেখ্য, হিজরী ২৩ খ্রীষ্টাব্দে বনিসালামা অঞ্চলে খালিদ বিন অলিদ সড়ক সংলগ্ন এই মসজিদটি রসুল (সা:) সাহাবা একরামদের নিয়ে নির্মাণ করেন। অতপর: খলিফা ইবনে আব্দুল আজিজ ১০০ হিজরীতে মসজিদটি পুন: নির্মাণ করেন। এরপরেও কয়েকবার মসজিদটির সংস্কার কাজ করা হয়।
এরপর আমরা গেলাম একটি কুপ দেখতে। এটির নাম বীর-এ ওসমান। আরবীতে বীর অর্থ কুপ। অর্থাৎ ওসমান (রা:)-এর কুপ। এ নিয়ে একটি কাহিনী আছে। একজন ইহুদীর একটি কুপ ছিলো। সে এই কুপ থেকে মুসলমানদের পানি পান করতে দিতো না। এটা জানার পর হযরত ওসমান (রা:) এই কুপটি খরিদ করে মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্য ওয়াকফ করে দেন। তবে দু:খজনক ঘটনা ছিলো যে হযরত ওসমানের খেলাফতের শেষ দিকে একসময় বিদ্রোহীরা মদিনায় তাঁর বাসভবন ঘেরাও করে খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। সেই ঘেরাও অবস্থায় তিনি একদিন জানালা দিয়ে মাথা বের করে মদিনাবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- রাসুল (সা:)-এর নির্দেশে আমি এই কুপটি ক্রয় করে সর্ব সাধারণের জন্য ওয়াকফ করেছিলাম। আজ সেই কুপের পানি থেকে তোমরা আমাকে বঞ্চিত করেছো। আজ আমি পানির অভাবে ময়লা পানি দিয়ে ইফতার করছি।
বীর এ ওসমান কুপটি এখন দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি খেজুর বাগানের ভিতরে। দর্শনার্থী প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। আমরা গেটের কাছে দাঁড়ালে ভিতর থেকে একজন লোক এসে গেট খুলে দিয়ে জানালেন- যদিও ভিতরে ঢুকার অনুমতি নেই, তিনি একজন বাংলাদেশী হিসেবে আপনাদেরকে অল্প কিছুক্ষণের জন্য সুযোগ দিচ্ছি। তিনি দ্রুত আমাদেরকে নিয়ে কুপটি দেখিয়ে নিয়ে ফিরে এলেন।
এরপর আমরা গেলাম হযরত সালমান ফার্সীর খেজুর বাগান দেখতে। তিনি ছিলেন রাসুল (সা:)-এর অন্যতম সম্মানিত সাহাবী। এই সালমান ফার্সীর পরামর্শ ও বুদ্ধিতেই খন্দক যুদ্ধে পরীখা খননের মাধ্যমে মুসলিমরা শত্রু পক্ষকে পরাজিত করে। সালমান ফার্সী (রা:) ছিলেন একজন ইহুদীর ক্রীতদাস। সেজন্য স্বাধীনভাবে তাঁর হযরত (সা:)-এর সহচার্য লাভ সম্ভব হচ্ছিলো না। এমন কি বদর ও ওহুদের যুদ্ধেও তিনি শরীক হতে পারেননি। তাই হযরত (সা:) একদিন তাকে ডেকে বললেন- তাঁর ইহুদী মালিকের সাথে আলাপ করে বিনিময় প্রদানের শর্তে মুক্তিলাভের চুক্তি করার জন্য। তিনি তার মুনিবের সাথে আলাপ করলে সে দু’টি শর্ত আরোপ করলো। প্রথমত: তিন বা ৫শত খেজুর গাছ রোপণ করে দিতে হবে এবং সেই গাছে যেদিন খেজুর ফলবে সেদিন তিনি মুক্তি পাবেন। দ্বিতীয়ত: ৪০ উকিয়া অর্থাৎ ৬ সেরের অধিক পরিমান স্বর্ণ প্রদান করতে হবে। আসলেই তাঁকে মুক্তি করে দেয়ার অভিপ্রায় ছিলো না বলেই ইহুদী এই শর্ত আরোপ করেন।
হযরত সালমান ফার্সী রাসুল (সা:)-এর দরবারে এসে এই ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি হযরত আলীকে নিয়ে গেলেন ইহুদীর কাছে। ইহুদী এক কাঁদি খেজুর দিয়ে বললেন- এই খেজুর থেকে চারা উৎপন্ন করে ফল ফলাতে হবে। রাসুল (সা:) দেখলে ইহুদীর দেয়া খেজুরগুলো আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে কয়লা করে ফেলা হয়েছে যাতে চারা না গজায়। রাসুল (সা:) খেজুরের কাঁদি হাতে নিয়ে হযরত আলী (রা:)-কে জমিতে গর্ত করতে বললেন। আর সালমান ফার্সী (রা:)-কে বললেন পানি আনতে। আলী (রা:) মাটিতে গর্ত করলে রাসুল (সা:) নিজ হাতে প্রতিটি গর্তে পুড়া খেজুর বপন করলেন। আর সালমান ফার্সী (সা:)-কে নির্দেশ করলেন গর্তে পানি দিতে দিতে সামনে এগিয়ে যেতে। হুজুর আরো বললেন যে, পানি দেওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেনো পিছনে না তাকান। বাগানের শেষ প্রান্তে যাওয়ার পর তিনি পিছনে তাকিয়ে দেখলেন প্রতিটি খেজুর থেকে গাছ উৎপন্ন হয়ে খেজুর ধরে পেকে কালো বর্ণ হয়ে আছে। এই খেজুরের নাম আজুয়া। এটি সবচেয়ে দামী খেজুর এবং স্বাদের দিকে দিয়ে বেশী সুস্বাদু।
বোখারী শরীফের ৫৩৫৬ নম্বর হাদিসে বর্ণিত আছে যে, জুমুয়া ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) তাঁর পিতা থেকে শুনেছেন রাসুল (সা:) বলেছেন- যে ব্যক্তি প্রত্যহ ৭টি আজুয়া খেজুর খাবেন সেদিন তাকে কোন বিষ বা যাদু ক্ষতি করতে পারবে না।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

ঘুরে দেখা নবীর শহর

হোটেলের নাস্তা সেরে সকার সকাল বেরিয়ে পড়লাম। মক্কায় ইব্রাহীম আল খলিল রোডে আমার হোটেল হায়াৎ রিজেন্সীর সামনে থেকে ট্যাক্সি যায় সোজা নবীর শহর মদিনায়। দর-দাম করে একটি ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলাম। ৭ সিটের ট্যাক্সি। একটু পর লোক ভর্তি হলে রওনা দিলো মদিনার উদ্দেশ্যে। ড্রাইভারকে আমি আগেই বলে রেখেছিলাম- আমাকে মদিনায় আমার হোটেলে নামিয়ে দিতে।
মিনিট দশেক চলার পর একটা গ্যাস ষ্টেশনে গিয়ে গাড়ী থামলো। সবার কাছ থেকে অগ্রিম ভাড়া নেয়া শুরু করলো ড্রাইভার। কেউ অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে দেয়ার ভয় দেখাচ্ছিলো। আমি কিছু না বলে গাড়ী থেকে নামলাম। তার গাড়ীর নাম্বার প্লেটের ছবি তুললাম। ছবি তুললাম ড্রাইভারেরও। মধ্য বয়সী ড্রাইভার, মাথায় টুপি এবং সৌদি রুমাল। তার ছবি কেন তুলছি জানতে চাইলে বললাম- তুমি যাত্রীদের সাথে যে আচরণ করলা তা আমার কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর আমি তোমাকে অগ্রীম অর্থও পরিশোধ করবো না। মদিনায় আমার হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেই তবে তোমার পাওনা অর্থ পাবে। আর যদি আমার সাথে বেয়াদবী করো তাহলে তোমার ছবি সহ ট্যাক্সি নম্বর আমি পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দিবো। তখন শুধু আমি নই এই ট্যাক্সির অন্য যাত্রীরাও তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবে। তারপর পুলিশ যা ভালো বুঝে তাই করবে।
পুলিশের কথা শুলে জোকের মুখে লবন দেয়ার মতো অবস্থা হলো ড্রাইভারের। কোন কথা না বাড়িয়ে সোজা গাড়ীতে গিয়ে বসে রওনা হয়ে গেলো মদিনার পথে।
প্রায় ৪০০ কিলোমিটার রাস্তা চুপচাপ পাড়ি দিলো ড্রাইভার। মদিনা শহরে এসে রাস্তা থেকে দূরে আমার ম্যারিয়ট হোটেল আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে নামতে বললো। আমি তার পাওনা মিটিয়ে দিলে সে চলে গেলো। আমি অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলাম যে, সে আমার হোটেলের সামনে দিয়েই যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম যাবার বেলায় একটা ছোট্ট প্রতিশোধ নিয়ে গেলো।
লাগেজ দুটো ঠেলে ঠেলে হোটেলে গিয়ে পৌছলাম। একজন বাংলাদেশী হোটেল কর্মী আমাকে রিসিভ করলেন। তার নাম আলাউদ্দিন, বাড়ী চাঁদপুর। তিনি খুব দ্রুত ফরমালিটিজ শেষ করে আমার লাগেজ সহ ১০ তলায় আমার রুমে পৌছৈ দিলেন। বললেন- পাশেই একটি পাকিস্থানী হোটেল আছে, দুপুরের খাবার খেতে পারবো সেখানে। নবীর রওজা মোবারক হাঁটা দূরত্বেই। তারপরও তাদের গাড়ী আছে, যা আমি ব্যবহার করতে পারবো। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিশ্রামের জন্য রুমে গেলাম।
প্রায় ৪০০ মাইল জার্নি করে ক্লান্তি ভর করেছিলো শরীরে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। আজানের মধুর শব্দে ঘুম ভাঙলো। তাড়াতাড়ি অজু করে নীচে নামলাম। গাড়ী নিয়ে আলাউদ্দিন অপেক্ষা করছিলেন নীচে। অল্প সময়ে তিনি আমাকে পৌছে দিলেন নবীর রওজা মোবারকের গেটে।
মদিনা মানে শহর। এই মদিনার আগে নাম ছিলো ইয়াসরিব। ইয়াসরিব অর্থ অলক্ষুনে, বা কু লক্ষণে। রসুলে করীম (সা:) হিজরতের পর ইয়াসরিবের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেন মদিনাতুন নবী। বা নবীর শহর। যাকে সংক্ষেপে বলা হয় মদিনা। আবরীতে বলা হয় মদিনা মনোওয়ারা। তথা আলোক শহর বা আলোকিত নগরী।
এই সেই মদিনা। পূণ্য ভুমি মদিনা। যে মদিনাকে নিয়ে কত কবি তাঁদের কবিতার লিখেছেন। বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ে রয়েছে এই পবিত্র নগরী ঘিরে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। প্রিয় নবী (সা:) তাঁর জীবনের শেষ ১০ বছর এই নগরীতেই কাটিয়েছেন। বেশীরভাগ ওহি এই নগরীতেই নাজিল হয়। এই নগরীকে কেন্দ্র করে তিনি আল্লাহর সাহায্যে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই মদিনার অধিবাসীরাই তার বিপদের সময় আশ্রয় দিয়েছিলো, ভালোবেসে টেনে নিয়েছিলো বুকে। আমৃত্যু তিনি এই শহরটিকে ভুলেননি। ভুলেননি এই শহরের অধিবাসীদের। তাইতো মক্কা বিজয়ের পরও বসবাসের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রিয় মদিনাকে।
আমি মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করে গেলাম নবীজিকে সালাম পৌছে দিতে। যেজন্য আমি নিউইয়র্ক থেকে এখানে ছুটে এসেছি। বাব অসসালাম গেট দিয়ে ঢুকলাম রসুল (সা:) রওজা মোবারকের উদ্দেশ্যে। মসজিদে নববীর পশ্চিম পাশের গেট-কে বাব আসসালাম বলা হয়। গেটে প্রচার ভীড়। আমাকে হাঁটতে হচ্ছিলো না। ভীড়ের ঠেলায় নিজের অজান্তেই সামনে এগুচ্ছি। একসময় পৌছে গেলাম হুজুর পাক (সা:) এর রওজা মোবারকের সামনে। যতই নবীর রওজা মোবারকের কাছাকাছি হচ্ছি ততই শরীর ও মন শিহরীত হচ্ছিলো। কত বছরের লালিত সাধ প্রিয় নবীর মাজারে গিয়ে সালাম পেশ করা। সেই সাধ আজ পূরণ হতে চলেছে। নবীর রওজার সামনে গিয়ে সালাম পেশ করতেই আবেগে দু চোখের অশ্রু ঝরে পরছিলো। নবীর পাশেই শুয়ে আছেন তার প্রিয় সাহাবী হযরত আবু বকর (রা:) ও হযরত ওমর (রা:)। তাদেরও সালাম জানালাম। রওজা মোবারকের ভিতরে আরো একটি কবরের জায়গা খালি আছে। কথিত আছে সেখানে হযরত ঈশা (আ:) এর কবর হবে। এখানে উল্লেখ্য, হযরত ওমর (রা:) কে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানেই বিবি আয়শা সিদ্দিকা (রা:)-এর কবর দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তার জন্য নির্ধারিত সমাধি স্থানে তারই অনুমতিতে হযরত ওমর (রা:)-কে সমাহিত করা হয়।
ইচ্ছে থাকলেও বেশীক্ষণ অপেক্ষ করার সুযোগ ছিলো না। একদিকে পুলিশের তাড়া, অপরদিকে পেছন দিক থেকে জনতার চাপ। তাই আস্তে আস্তে সামনের দিকে রওনা হলাম। বাবে জিবরাইল মসজিদে নববীর বহির্গমন দরজা। এখানে হযরত জিবরাইল (আ:) ওহি নিয়ে অপেক্ষা করতেন। তাই এই নামকরণ করা হয়েছে।
মসজিদে নববীর অদূরেই জান্নাতুল বাকি। যেখানে বিবি ফাতেমা, হযরত ওসমান (রা:) সহ ১০ হাজার সাহাবীর কবর রয়েছে। প্রতিদিন ফজর এবং আসরের নামাজের পর জান্নাতুল বাকির দরজা খুলে দেয়া হয়। তাই দ্রুত ছুটলাম জান্নাতুল বাকিতে শায়িত সাহাবীদের কবর জিয়াতের জন্য। আরবীতে জান্নাতুল বাকীর নাম বাকী উল গারকাদ। যদিও মদিনাবাসীর কাছে এটা জান্নাতুল বাকি নামে পরিচিত। জান্নাতুল বাকি মসজিদে নববীর পূর্ব দিকে অবস্থিত। এখানে ১০ হাজার সাহাবীর কবর থাকলেও কোন কবর চিহ্নিত নেই। এই কবর স্থানের গোড়া পত্তন হয় ইসলামের সূচনা থেকেই। হযরত মুহাম্মদ (সা:) প্রায় শেষ রাতেই জান্নাতুল বাকিতে যেতেন এবং দোয়া করতেন। হুজুরে পাক (সা:) মদিনা থাকা অবস্থায় তাঁর দুধ ভাই হযরত ওসমান ইবনে মজউন (রা:) এর মৃত্যু হয়। তখন সাহাবী কেরাম হুজুর (সা:)-কে জিজ্ঞাসা করেন তাকে কোথায় দাফন করা হবে। হুজুর (সা:) তখন বলেন- আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে তাকে বাকি-উল গারকাদ-এ দাফন করার জন্য। আর এভাবেই জায়গাটা কবর স্থানের জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়ে যায়।
সৌদি সরকার দু’বার জান্নাতুল বাকি-কে সংস্কার করেছে। প্রথম সংস্কার হয় বাদশা ফয়সল ইবনে আব্দুল আজিজের সময়। দ্বিতীয় সংস্কার হয় বাদশা ফাহাদের সময়। এসময় আশপাশের সকল মহল্লা বা সড়ক উচ্ছেদ করে জান্নাতুল বাকিতে সংযোগ করে কবর স্থানটি প্রশস্ত করা হয়। এখন জান্নাতুল বাকির চতুর্দিকে ১৭২৪ মিটার লম্বা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। দেয়ালে লাগানো হয়েছে মর্মর পাথর। জান্নাতুল বাকির এক পাশে মৃতের গোছল দেয়া ও কাফন পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
জান্নাতুল বাকি জিয়ারতের জন্য ফজর ও আসর নামাজের পর খুলে দেয়া হয়। শুধুমাত্র পুরুষরা জিয়ারতের জন্য ভিতরে যেতে পারেন কারণ হিসেবে বলা হয় নারীদের জন্য ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক কবর জিয়ারত করা বৈধ নয়। জানা যায়, ওসমানী খেলাফত পর্যন্ত জান্নাতুল বাকিতে সাহাবাদের কবর স্থান চিহ্নিত ছিলো। পরে কবরকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের কুসংস্কার চালু হলে সৌদি সরকার সব কবর ধ্বংস করে দেয়। তবে মদিনায় যারা দীর্ঘদিন ধরে আছেন তাদের মতে জান্নাতুল বাকিতে প্রবেশের মুখে আলাদা করে ঘেরাও করে রাখা কবর দু’টোর একটি কবর হযরত ফাতেমা (রা:) এবং অপরটি হযরত আয়শা (রা:)-এর। আর কবর স্থানের একেবারে শেষ মাথায় রয়েছে খলিফা হযরত ওসমানের কবর।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

মক্কায় শেষ দিন

পবিত্র মক্কা নগরীতে আজ আমার শেষ দিন। কাল সকালে এই পবিত্র শহরটি ছেড়ে চলে যাবো নবীর (সা:) শহর মদিনায়। হোটেল থেকে বের হয়ে বিদায়ী তাওয়াফ করতে গেলাম। এখন হজ্বের সময় নয়। তারপরও মসজিদুল হারাম ও কাবা চত্তর লোকে লোকারণ্য। বর্তমান অবস্থায় ১০ লাখ মসুল্লি এখানে একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। হজ্ব মৌসুমে ৪০ লাখ মুসল্লীর স্থান সঙ্কুলান হয়। হারাম শরীফ এলাকার সংস্কার কাজ চলছে। আশা করা যায় এই কাজ সমাপ্ত হলে আরো অধিক পরিমান মুসল্লী একত্রে নামাজ আদায়ের সুযোগ পাবেন। কাবা চত্তরে ঢোকার জন্য মোট ৮১টি দরজা থাকলেও সংস্কার কাজ চালু থাকার কারণে অনেকগুলো দরজাই বন্ধ থাকে বিধায় মুসল্লীদের ঢুকতে কষ্ট হয়।
সৌদী সরকার শুধু কাবা ঘরের সংস্কার কাজই করছেন না। চারপাশের পরিবেশও করছেন দৃষ্টি নন্দন। আমি যে হোটেলটাতে ছিলাম এর নাম ফিয়ার মাউন্ট হোটেল। এটি যে টাওয়ারের উপর নির্মিত এটাকে বলা হয় ক্লক টাওয়ার। এই টাওয়ারে অনেকগুলো ৫ তারকা মানের হোটেল নির্মিত হয়েছে। এখানে নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি ঘড়ি। এজন্যই এটি ক্লক টাওয়ার নামে পরিচিত। ঘড়িটি স্থাপনের কাজ শুরু হয় ২০০২ সালে এবং উদ্বোধন হয় ২০১২ সালে। ঘড়িটিতে সাদা ও সবুজ রংয়ের প্রায় ২১ হাজার বাতি ব্যবহার করা হয়েছে। দিনের বেলা ১২ কিলোমিটার এবং রাতের বেলা ১৭ কিলোমিটির দূর থেকে ঘড়ির সময় দেখা যায়। মুসলমানদের বিশেষ দিনগুলোতে ঘড়ির ওপর আকাশের দিকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১৬ রংয়ের আলো বিচ্ছুরণ ঘটানো হয়। প্রতি ৫ ওয়াক্ত নামাজের সময় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ফ্ল্যাশ লাইটের মাধ্যমে নামাজের ইঙ্গিত দেয়া হয়। ঘড়ির উপর বড় করে আল্লাহু শব্দটি লেখা রয়েছে।

মক্কায় হুদাইবিয়ার সন্ধিস্থল
মক্কায় হুদাইবিয়ার সন্ধিস্থল

একটু সময় নিয়েই বিদায়ী তাওয়াফ সারলাম। তাওয়াফ সেরে গেলাম হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জন্ম ভিটা দেখতে। সাফা পাহাড়ের ডান দিকে অল্প দূরেই তাঁর এই পৈত্রিক ভিটা। এখানেই ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে মহানবী (সা:) জন্মগ্রহণ করেন। হযরত খাদিজা (রা:) -এর সাথে বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই বাড়িতেই বসবাস করতেন। বর্তমানে এটি একটি লাইব্রেরী।
রাসুল (সা:) এর এই জন্মভিটা দেখেতে প্রতিদিন প্রচুর মানুষের ভীড় হয়। বাড়ীর দেয়ালে বিভিন্ন ভাষায় অনেক কিছু লেখা রয়েছে। বাংলা ভাষাও আছে। সবাই তাদের মনোবসনা পূরণের আর্তির কথা লিখেছেন বিভিন্ন ভাষায়। বাড়ীর আশেপাশে এবং সামনের আঙ্গীনায় অনেককেই নামাজ পড়তে দেখা গেলো। নবীর জন্ম ভিটা পরিদর্শণ শেষ করে হেরেম শরীফের বাইরে একটি পাকিস্তানী বিরিয়ানী হাউজে দুপুরের খাবার খেয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম হুদাইবিয়ার উদ্দেশ্যে।
মক্কার ৯ মাইল উত্তর-পশ্চিমে হুদাইবিয়া অবস্থিত। এই স্থানে নবী করিম (সা:) ও কুরাইশদের মধ্যে একটি সন্ধি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো ষষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে। এই চুক্তির মাধ্যমে কুরাইশগণ ইসলামী রাষ্ট্রকে একটি পক্ষ ও শক্তি বলে স্বীকৃতি প্রদান করে। এবং ১০ বছরের জন্য স্বাধীনভাবে ধর্ম প্রচারের সুযোগ প্রদান করে। ইসলামের ইতিহাসে এই সন্ধিচুক্তিকে স্পষ্ট বিজয় বলে কোরান মজিদে ঘোষণা করা হয়েছে।
হুদাইবিয়ায় একটি মসজিদও রয়েছে। মসজিদের পাশে একটি জায়গা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। যেখানে হযরত ওসমানের কথিত হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সাহাবীরা রাসুল (সা:)-এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ ও রাসুল (সা:) এর সন্তুষ্টি অর্জন এবং যুদ্ধ করার লক্ষ্যে এই বাইয়াত অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বলে এটাকে বাইয়াতে রেজওয়ান বা বাইয়াতে রাসুল-ও বলা হয়। এই ঐতিহাসিক স্থানটি অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন রাখা হয়েছে দেখে মনে কষ্টবোধ হচ্ছিলো।
হুদাইবিয়া থেকে ফেরার পথে আমরা গেলাম রসুল (সা:)-এর সর্বশেষ বিবি উম্মুল মোমেনীন হযরত মায়মুনার কবর জিয়াত করতে। তার প্রকৃত নাম ছিলো বাররা। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা:: তার নাম পরিবর্তন করে মায়মুনা রেখেছিলেন। নবীজির (রা:) ইন্তেকালের পর মায়মুনা আরো ৪০ বছর মদিনাতে বসবাস করেন। মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন। এখানেই তাকে কবর দেয়া হয়। তাঁর কবরস্থান ঘিরেই একটি ভবন তৈরী করা হয়েছে। এর ভিতরে ঢোকা নিষেধ। জানালা দিয়েই কবরটি দেখা যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করে বিদায় নিলাম।
এরপর ড্রাইভার আমাদের নিয়ে এলো মক্কার অদূরে কাকিয়া নামক স্থানে একটি খেজুরের পাইকারী মার্কেটে। বিশাল মার্কেটে নানা রকমের খেজুর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েক পদের খেজুর কিনলাম। প্রায় প্রতিটি দোকানেই বাংলাদেশীরা কাজ করছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জন্ম গৃহ। যেটি এখন লাইব্রেরী
হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জন্ম গৃহ। যেটি এখন লাইব্রেরী

কাকিয়া মার্কেটের বিপরীত দিকে একটি বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে গেলাম। রেষ্টুরেন্টটির মালিক খুবই আপ্যায়ন করলেন। স্পেশাল সালাদ বানিয়ে আনতে বললেন। কয়েক প্রকার ভাজি-ভর্তা আর ডাল নিয়ে উদরপূর্তি করে খেলাম। খাবার পর এলো চা এবং সবশেষে পান। দাম দিতে গেলে তিনি নিতে চাইলেন না। বুঝলাম প্রবাসী মাত্রই স্বজন। তবুও জোর করে হাতে ১০০ রিয়ালের নোট দিলাম। তিনি মাত্র ১০ রিয়াল রেখে বাকী অর্থ ফেরৎ দিলেন।
এরপর গেলাম নাক্কাসা নামক একটি স্থানে। এটি হেরেম শরীফ সংলগ্ন ইব্রাহীম খলিল রোড ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ দূরে। এখানে পাইকারী দরে সবজি, মাছ, ফল সবই পাওয়া যায়। দোকানগুলোর মালিক প্রায় সকলেই বাংলাদেশী। বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টগুলোতে ছোলা, বুট, মুড়ি সবই পাওয়া যায়। আমি যাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলাম, তার বাড়ি সিলেটে। নাম মমিনুল ইসলাম। গতবার এসে তার সাথে পরিচয় হয়েছিলাম। এবারে আসার পর হৃদ্যতার সম্পর্কটা আরো বেড়েছে। তিনি হঠাৎ করেই বললেন- ভাই সৌদী আরব আপনি এতোবার এসেছেন, গাওয়া খেয়েছেন কি? আমি তার কথায় হতবাক খেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম- এটা কি ধরনের খাবার বুঝতে পারিনি। তাই খাওয়া হয়নি। তিনি হেসে বললেন এটা কোন খাবার নয়, পাণীয়। ছোট ছোট কাপে করে সৌদীরা খায়। এতক্ষণে মনে পড়লো আমি মসজিদে নববীর ভিতরেও দেখেছি যে, সৌদিআনদের একসে বসে গাওয়া পান করতে। মমিনুল বললেন- চলুন আপনাকে গাওয়া আস্বাদন করাই।

বিবি মায়মুনার কবর
বিবি মায়মুনার কবর

গাড়ী উঠেই মমিনুল গাওয়ার গুণাগুণ বর্ণনা শুরু করে দিলো। বললো- আরবীয় সংস্কৃতিতে একটি ঐতিহ্যবাহী পানীয় হচ্ছে গাওয়া বা আরবীয় কফি। সাধারণত এটা বাড়ীতে বিশেষ অনুষ্ঠানে অতিথিদের সামনে ছোট কাপে পরিবেশিত হয়। বেশ সময় নিয়ে গাওয়া ছোট ছোট চুমুকে খেতে হয়। এর কোন হ্যান্ডেল নেই। বিশেষ এই কাপকে ফিনজান বলা হয়। কোন অনুষ্ঠান হলে পরিবেশনকারী ঐহিত্যবাহী আরবীয় পোশাক পড়ে অতিথিদের তার ফ্ল্যাক্স থেকে গাওয়া ঢেলে দেন। অতিথিকে বেশী সম্মান জানাতে বাড়ীর কিশোর ছেলেকে দিয়েও গাওয়া পরিবেশন করা হয়। গাওয়া ঔষুধেরও কাজ করে। এটি পান করলে শরীর চাঙ্গা হয় এবং কর্মস্পৃহা বাড়ে। গলায় কাশি থাকলে তা সেড়ে যায়। গাওয়া সাধারণত খেজুর দিয়ে খাওয়া হয়।
গল্প করতে করতে আমরা অনেক দূর পেরিয়ে এলাম। গাড়ী পার্ক করে মোমিনুল আমাকে নিয়ে এলো একটি আরবীয় রেষ্টুরেন্টে। ছোটখাটো দোকান, তবে বসার ব্যবস্থা আছে। মমিনুল জানালো- এই দোকানে শুধুই গাওয়া বিক্রি হয়। অর্ডার দেয়ার পর চায়ের কাপের মতো বড় কাপে পরিবেশিত হলো গাওয়া। প্রতি কাপ ৩ সৌদি রিয়াল। খেতে খুব একটা খারাপ লাগেনি। দুধ বা চিনি না থাকলেও দারুচিনি, এলাচি এবং সুগন্ধি মশলা থাকায় পুরো কাপটাই শেষ করলাম। আমাকে দোকানে বসিয়ে রেখে মমিনুল দোকানের বাইরে গেলো। একটু পর একটি প্যাকেট হাতে নিয়ে আমার সামনে রেখে বললো- এটা আপনাকে নিউইয়র্ক নিয়ে যেতে হবে। উৎসুক্য নিয়ে জানতে চাইলাম এর ভিতরে কি? বললো- গাওয়া। সে আরো বললো- ইন্টারনেট ঘাটলে গাওয়া বানানোর পদ্ধতি জানা যাবে। আমি দাম দিতে চাইলে সে কোনভাবেই নিতে চাইলো না। অবশেষে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।
প্রায় সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে সারা শরীর অবসন্ন লাগছিলো। মমিনুলকে বললাল- এবার হোটেলে নামিয়ে দিতে। আগামীকাল খুব ভোরেই রওনা দিতে হবে নবীর (সা:) শহর মদিনায়।

 

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

মক্কার মিসফালাহ যেন এক খন্ড বাংলাদেশ

মিসফালাহয় আখের রস
মিসফালাহয় আখের রস

মক্কার এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মসজিদ। রাসুল (সা:) এবং তার সাহাবীদের বিভিন্ন স্মৃতি ঘেরা স্থানে এসব মসজিদ গড়ে উঠেছে। আমরা গত তিনদিন ধরে সে সব স্মৃতিময় জায়গা চষে বেড়াচ্ছি। আমরা শুধুমাত্র দর্শক তাই কোথায় যাব বা কি দেখবো তা দেখার দ্বায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি আমাদের স্থানীয় গাইড তারিকের উপর। তার কথামত সকাল আটটায় হোটেল লবিতে অপেক্ষা করছিলাম। সময় মত সে এসে পৌছালে আমরা গাড়ীতে গিয়ে বসলাম।
একটু পরেই গাড়ী এসে থামলো মসজিদে নামেরার সামনে। এটি মক্কা থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে মক্কা- মদীনা রোডের আলহিজরা এলাকায় তানঈম নামক স্থানে অবস্থিত। এজন্য এটাকে মসজিদে তানঈমও বলা হয়। মসজিদটি ইসলামী শিল্প নৈপুন্যের এক অনুপম নিদর্শন। বিশাল এই মসজিদের দুটি মিনার ও একটি গম্বুজ অনেক দূর থেকে দেখা যায়। বিবি আয়েশা (রা:) এর এই মসজিদ ঘিরে রয়েছে ইতিহাসের ছোঁয়া। হিজরী ১১ সনে রাসুল (স:) বিদায়ী হজ্ব করতে আসেন মক্কায়। তাঁর সফর সঙ্গী হন বিবি আয়েশা। তিনিও হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর সাথে হজ্ব ও ওমরাহ এর নিয়ত করেন। কিন্তু শরীর খারাপ হওয়ায় তিনি রাসুল (সা:) এর সাথে ওমরাহ পালন করতে পারেননি। পরে তিনি বিবি আয়েশার ভাই হযরত আব্দুর রহমানের সাথে হারামের বাইরে এখান থেকে ওমরাহ এর ইহরাম বাঁধার জন্য পাঠিয়েছিলেন। পরে এখানে এই মসজিদটি তৈরি করা হয়। মসজিদ এবং মসজিদ চত্বরটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ৪০ জন ক্লিনার কাজ করেন। আর এদের সবাই বাংলাদেশী। তাদের বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ হলো। আয়েশা মসজিদে দু’ রাকাত নামাজ পড়ে আমরা আবার গাড়ীতে এসে বসলাম।
ততক্ষনে ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। সবার পেটে ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছিলো। তারিককে বললাম হেরেম শরীফ সংলগ্ন বাংলাদেশী অধ্যুষিত মিসফালায় নিয়ে যেতে। ওখানেই আমরা লাঞ্চ করবো। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে কিশোর বয়স আমার মায়ের সাথে হজ্ব করতে এসে এই মিসফালাহয় একটি বাড়ীতে উঠেছিলাম। আমাদের সৌদি মুয়াল্লিম ইব্রাহিম ওজাইমি আমাদের পরিবারের ১১জন সদস্যকে এখানেই একটি সুন্দর বাড়ীতে রেখেছিলেন। এর পরেও কয়েকবার পবিত্র মক্কায় আসা হলেও মিসফালায় আসা হয়নি। তারিক জানালো এই এলাকায় ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক হোটেল রয়েছে। এর মাঝে দুই তৃতীয়াংশ পরিচালিত হয় বাংলাদেশীদের দ্বারা। এখানে অনেকগুলি মসজিদ রয়েছে। তার অধিকাংশ বাংলাদেশী ইমাম বা মুয়াজ্জিন। আছে জামা কাপড়, জুয়েলারী জুতা সহ নানাবিধ দোকান। আছে বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট। ভর্তা ভাজি থেকে সব ধরনের বাংলাদেশী খাবার পাওয়া যায়।
মিসফালাহ অর্থ নীচু এলাকা। পাহাড় ঘেরা মক্কায় অপেক্ষাকৃত নি¤œ ভূমি হচ্ছে এই এলাকাটি। হেরেম শরীফের পাশে ইব্রাহিম খলিল সড়কটি মিসফালাহ এলাকার মধ্য দিয়ে চলে গেছে মক্কা শহরের ভেতরে। রাস্তার এক পাশে খালি জায়গায় ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর চরে বেড়াচ্ছে। অনেকে শস্য দানা কিনে ছিটিয়ে দিচ্ছে কবুতরদের খাওয়ানোর জন্য। ভীড়ের জন্য গাড়ী আস্তে আস্তে যাচ্ছিলো। চারদিকে বাংলা কথা বার্তা কানে আসছিলো। মনে হচ্ছিলোনা বিদেশে কোথাও আছি।
তারিক বল্লো চলুন খাওয়ার আগে আরো একটি বাংলাদেশী এলাকা ঘুরিয়ে আনি। জায়গাটা মিসফালাহ থেকে খুব বেশী দূরে নয়। মিনিট পাঁচেক পর গাড়ী এসে থামলো একটি এলাকায়। জায়গাটির নাম নাক্কাসা। এখানে শুধু বাংলাদেশী নয় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলমানদেরও বসবাস। তাদেরও রয়েছে নানা ধরনের ব্যবসা। এখানে বাহারী রকমের শাক শব্জী, ফল, মুরগী, মাছ কিনতে পাওয়া যায়। এখানকার রেষ্টুরেন্টগুলি লাঞ্চ, ডিনারের পাশাপাশি বিকেল থেকে ছোলা, বুট, মুড়ি, পিয়াজু, কাবাব ইত্যাদি পাওয়া যায়। নাক্কাসা এলাকায় একটু ঘুরে ফিরে আবার ফিরে এলাম মিসফালাহ এলাকায়। বড় রাস্তা থেকে ভিতরে ঢুকে গেছে ছোট বড় গলি। গলির অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রথমেই দেখে থমকে গেলাম। তারপরও এসেছি যখন খেতে হবে। শুধু খেতে নয় পরিবেশ দেখার জন্যও। নীচে কিচেনে রান্না হচ্ছে। সিড়ি বেয়ে উপরে খাবার ব্যবস্থা। প্রতিটি রেষ্টুরেন্টের সামনে লোকজন দাড়িয়ে চিৎকার করছে। আসেন ভাই আমাদের এখানে ভাত, মাছ, গরু, খাসী, উট সব মাংস আছে। বলা যায় গ্রাহকদের নিয়ে টানাটানি। সারি সারি অনেকগুলি হোটেল। এর মাঝে থেকে বাংলাদেশ নামের হোটেলটা পছন্দ হলো। নীচে রাস্তায় দাড়িয়ে যেই ছেলেটি লোক ডাকছিল গায়ে লাল গেঞ্জি। সামনে পেছনে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। বাংলা ইংরেজীতে দুই ভাষায়ই বাংলাদেশ লেখা। নীচে দাড়ানো ছেলেটা আমাদের সাথে করে ওপরে নিয়ে এলো। টেবিল খালি নেই। একটু অপেক্ষা করার পর খালি হলে আমরা বসলাম। ভেতরটাও খুব অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্ন। কোন নেপকিন নেই। কাউন্টারের পাশে বড় গোল টিস্যুর রোল। আমাদের নিউইয়র্কে দোকানের বাথরুমে যেমন থাকে। নেপকিন চাইতেই বড় রোল থেকে ছিড়ে কয়েকটুকরা সামনে এনে রাখলো। যা হোক খাবারের অর্ডার দিলাম। বিভিন্ন রকমের ভর্তা ভাজি। তারপর গরু ভুনা এবং উটের মাংস। পছন্দ করে উটের মাংস নিয়েছিলাম। ছোট ছোট টুকরো করে গরুর মাংসের মত ঝোল দিয়ে রান্না করা। আমার কাছে গরুর মাংসের মতই মনে হয়েছে। আমার সঙ্গী নিউইয়র্কের বিখ্যাত শেফ খলিল বিরিয়ানী হাউজের স্বত্ত্বাধিকারী খলিল ভাই ছিলেন। এক একটা তরকারী তার কাছে নিলে তিনি তা সাথে সাথে নাকচ করে দেন। বল্লাম, এখানের শেফরা তো আপনার মত নিউইয়র্কের বিখ্যাত কুলিনারি ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে আসেনি। তাই রান্নার মান খুঁজবেন না। খেয়ে নিন। তিনি মৃদু হেসে খাওয়া শুরু করলেন। বুঝলাম ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য সবাই খেলেও কারো তৃপ্তি হয়নি। খাওয়া শেষে চা দিতে বল্লাম। দুধ, তেজপাতা এলাচ মিশিয়ে মজাদার মশলা চা খাওয়ার কষ্ট ভুলিয়ে দিলো।
আমাদের আগেই খলিল ভাই নীচে নেমে গেলন। হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম তিনি একটা দোকানের সামনে অপেক্ষা করছেন। বললেন, আমি জানি সবারই পেটের কিছু অংশ খালি রয়ে গেছে। আমি খাঁটি আখের রস খাইয়ে সে অংশটুকু পূরণ করে দেবো। খলিল ভাই সবার জন্য আখের রস অর্ডার দিলেন। আস্ত আখ মেশিনে ঢুকিয়ে রস বের করে আইস মিশিয়ে সবাইকে পরিবেশন করল দোকানি। সবাই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে রওয়ানা দিলাম হোটেলের দিকে।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

নবীর স্মৃতি আর সৌন্দর্য্যরে শহর তায়েফ

তায়েফের বণি সাকিফ গোত্রের বিবি হালিমার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন শিশু নবী (সা:)। এই শহরের একটি পাহাড়ে তিনি ছাগল চড়াতেন। তায়েফ-কে বলা হয় ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সৌদী বাদশা ফয়সল এবং বা বাদশা খালেদের আমলে শীতকালীন রাজধানীর মর্যাদা পায় তায়েফ। রবি শস্য ও ফলফলাদি বিশেষ করে আঙ্গুরের জন্য তায়েফ বিখ্যাত। তায়েফে উৎপাদিত শাকসবজি সমগ্র সৌদি আরবের চাহিদার ৩০ ভাগ পূরণ করে থাকে।

 

সুন্দর এবং মনোরম শহর তায়েফ। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের শহর তায়েফ। চমৎকার একটি সাজানো-গুছানো শহর। চারদিকে সবুজের হাতছানি। ক্ষেত ভরা ফসল, খেজুর গাছের ঘন বন। আর এই শহরবাসীর প্রস্তর আঘাতেই আমাদের প্রিয় নবীজীর (সা:) শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলো। তাঁর উপর চালিয়েছিলো নানা নির্যাতন। এছাড়াও নানা কারণে ইতিহাসে তায়েফ শহরটি আলোচিত। এই তায়েফের বণি সাকিফ গোত্রের বিবি হালিমার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন শিশু নবী (সা:)। এই শহরের একটি পাহাড়ে তিনি ছাগল চড়াতেন। তায়েফ-কে বলা হয় ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সৌদী বাদশা ফয়সল এবং বা বাদশা খালেদের আমলে শীতকালীন রাজধানীর মর্যাদা পায় তায়েফ। রবি শস্য ও ফলফলাদি বিশেষ করে আঙ্গুরের জন্য তায়েফ বিখ্যাত। তায়েফে উৎপাদিত শাকসবজি সমগ্র সৌদি আরবের চাহিদার ৩০ ভাগ পূরণ করে থাকে।
এসব নানা কারণে তায়েফ শহরটি দেখার শখ ছিলো বহুদিনের। তাই এবার আমার সৌদি আরব ভ্রমণের সময় মক্কা-মদিনার পাশাপাশি তায়েফ শহরটিও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। গত দু’দিন আমি বাংলাদেশী গাড়ী চালক জসিমের সাথে পবিত্র মক্কা নগরীর আশেপাশে ঘুরে বেরিয়েছি। তার সাথে আমার চুক্তি হয়েছিলো আজ সে আমাকে তায়েফ নিয়ে যাবে। কথামতো সকাল ৮টায় সে আমাকে তুলে নিলো হোটেল থেকে।
গাড়ী চলছে পাহাড় ঘেষা আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে গভীর খাদ। এসব পাহাড়ী পথে চলাচলের অভিজ্ঞতা আমার অনেক। ভারতের দার্জেলিং, সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালা, স্পেনের পাহাড়ীগ্রাম রুপিত সহ এমনি অনেক পাহাড়ী এলাকা ভ্রমণ করেছি। তাই উঁচু পাহাড়-কে সঙ্গী করে আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলা আমার জন্য সমস্যা হচ্ছিলো না।
জসিম জানালো, তায়েফের রাস্তার আশেপাশে গড়ে উঠেছে অনেক অবকাশ কেন্দ্র। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে ক্যাবল কার। পর্যটকরা এসব ক্যাবল কারে চরে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। পাহাড়ী রাস্থায় ঘুরে ঘুরে গাড়ী উপরে উঠছিলো। মূল শহরের কাছাকাছি পৌঁছতেই গাড়ী গো গো করে থেমে গেলো। জসিম বেরিয়ে গিয়ে বনেটটা উঠিয়ে দেখলো ইঞ্জিনটা গরম হয়ে গেছে। আধা ঘন্টার মতো বিশ্রাম নিতে হবে। ইঞ্জিনটা একটু ঠান্ডা হলে আবার রওনা দেবো।
গাড়ী থেকে নেমেই দেখলাম। অল্প দূরেই রাস্তার পাশে সারি সারি ফলের দোকান। আমি এগিয়ে গেলাম। পরে জেনেছিলাম জায়গাটির নাম ওকাজ। দেখলাম প্রতিটি দোকানেই বাংলাদেশী কর্মচারী। তারা গল্প গুজবে মত্ত। আঙ্গুর কমলা ছাড়াও বাংলাদেশী বড়ই, বড় বড় কলা, ডালিম, শরিফা সহ নানা পরিচিত ফল চোখে পড়ছিলো। ডালিমের খোঁসা ছাড়িয়ে রসে ভরা দানাগুলো প্যাকেট করে রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য। লোভ সামলাতে না পেরে দুই প্যাকেট কিনলাম। একজন বাংলাদেশী কিছু আঙ্গুর প্যাকেট করে দিয়ে বললেন- ‘গাড়ীতে বসে খাবেন। তায়েফের আঙ্গুর খুব মিষ্টি।’ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ীর কাছে এসে দেখলাম তখনো ইঞ্জিনের মর্জি ভালো হয়নি। জসিম জানালো- আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন উটওয়ালা এলো। রকমারী সাজে সজ্জিত উটটি। পর্যটকরা উটের উপর উঠে ছবি তোলে আর আশপাশের এলাকা ঘুরে বেড়ায়। আমিও দরদাম করে আধা ঘন্টার জন্য একটি উট ভাড়া করলাম।
পাহাড়ী রাস্তায় চলার সময় দেখলাম কোথাও উট আবার কোথাও দুম্বার সারি। ব্যবসায়ীরা উটে করে মাল পরিবহণ করছে। অনেক বানরও চোখে পড়লো রাস্তার পাশে। পথচারীরা পাশের দোকান থেকে কলা কিনে এনে তাদের খাওয়াচ্ছে। উট ভ্রমণ শেষ করে গাড়ীর কাছে আসতেই জসিম জানালো- গাড়ী রেডি। এরপর অল্প সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম তায়েফ শহরের প্রাণ কেন্দ্রে। মক্কা থেকে ১২০ কিলোমিটার তূরত্বে তায়েফ শহরে পাহাড়ী পথে সময় লেগেছে দেড় ঘন্টার মতো। শহরটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত।
জসিম প্রথমে আমাকে নিয়ে গেলো বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:) এর মাজারে। মাজারটি চারদিকে দেয়ার দিয়ে বেষ্টন করা। খাদেম জানালো- বেষ্টনীর ভিতর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:) সহ আরো বেশ কয়েকজন সাহাবীর কবর রয়েছে। মাজারের কাছে যাওয়া অথবা কবর স্পর্শ করা সৌদি সরকার বেদাত বলে মনে করে। তাই কবরের চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। দেয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ করে চলে এলাম পাশের মসজিদে। এটা তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ। এর নামকরণ করা হয়েছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:)-এর নামে। এটা মসজিদে ইবনে আব্বাস নামে পরিচিত। মসজিদের পাশে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। এতে আছে অনেক মুল্যবান কিতাব-এর সংগ্রহ। আছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ:)-এর হাতে লেখা পবিত্র কোরআনের কপি সহ বিভিন্ন সময়ে পাথর ও কাগজে লিখিত পবিত্র কোরআনের প্রাচীন কপি।
এরপর আমরা এলাম ওয়াদি মিটনা নামক একটি স্থানে। পথভ্রষ্ট কিছু তায়েফবাসী এখানেই রসুল (সা:) এবং তাঁর পালিত পুত্র হারেসা বিন জায়েদকে পাথর ছুড়ে রক্তাক্ত করে। এই নিপীড়নের স্থানটি দেখে অজান্তেই চোখ অশ্রসজল হয়ে উঠে। এক বর্ণনায় আছে- তায়েফবাসীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে রক্তাক্ত রাসুল (সা:) ওয়াদি মিটনার পাশে এক আঙ্গুর বাগানে আশ্রয় নেন। তখন সেখানে ফেরেস্তা জিবরাইল এসে বলেন- হে আল্লাহর রাসুল (সা:) মহান আল্লাহপাক আপনার প্রতি তায়েফবাসীর অত্যাচার দেখেছেন। এই পাহাড়ের রক্ষক ফেরেস্তারা আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছেন। আপনি যা বলবেন, তারা তাই করবেন। আপনি হুকুম দিনে দুই পাশের পাহাড় একত্রিত করে তায়েফবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে। এই কথা শুনার পর পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত মহামানব ফরিয়াদ করে বলেন, হে আল্লাহ! এরা বুঝে না। এরা যদি ধ্বংস হয়ে যায়, আমি কাদের কাছে তোমার বাণী প্রচার করবো! ঐতিহাসিকরা বলেন- এই দোয়া পৃথিবীর মহামানবদের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ আবেদন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এখানে কারো বিরুদ্ধে বিদ্বেষ কিংবা অভিযোগ তুলে ধরা হয়নি। কারো ধ্বংস কামনা না করে ক্ষমার মহত্ত দেখানো হয়েছে।
জসিমের আহ্বানে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। কেনো জানি বার বার ১৪০০ বছরের আগেকার এই ঘটনাটি মনে পড়ে হৃদয়কে পীড়া দিচ্ছিলো। গাড়ী এসে থামলো একটি পাহাড়ের ঢালে। আমাদের একটু হেঁটে উপরে উঠতে হবে। এখানেই ছিলো সেই বুড়ির বাড়ী। যে কিনা রাসুল (সা:) এর পথের উপর কাঁটা বিছিয়ে রাখতো। ছোট ছোট দুটি কক্ষ নিয়ে পাথরের তৈরী একটি ঘর। আমরা সেখানে ছবি তুলে আবার গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। এরপর গাড়ী এসে থামলো হযরত আলী (রা:) মসজিদের সামনে। একটি মিনার সহ ছোট একটি মসজিদ। যেখানে ১০/১২জন মুসল্লী নামাজ পড়তে পারেন। জানা যায়, হযরত আলী (রা:)-এর খেলাফতকালে তিনি এই মসজিদে বসে জনগণের অভাব-অভিযোগ শুনতেন এবং খেলাফত পরিচালনা করতেন।
এবার আমাদের মক্কা ফিরে যাওয়ার পালা। আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য মিকাত জিল মাহরাম। এখানে গিয়ে গোসল বা অজু করে এহরাম পড়ে মক্কায় গিয়ে ওমরাহ করতে হবে। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী কাজ করছেন। তারাই অজু এবং গোসলখানার স্থান দেখিয়ে দিলেন। গোসল করে এহরামের কাপড় পরিধান করে মসজিদে দুই রাকাত নামাজ পড়ে জসিমের সাথে রওনা হলাম মক্কার পথে।

Categories
মধ্যপ্রাচ্য

আরাফাতের মাঠ-একটি নাম একটি ইতিহাস

আরাফাত শব্দটি আরবী। এর অর্থ জানা, চেনা, পরিচয় ইত্যাদি। আরাফাত ময়দানের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে বেশী যে মতবাদটি প্রচলিত তা হলো- বেহেস্ত থেকে পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর বাবা আদম ও মা হাওয়া পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা একে অপরকে খুঁজতে খুঁজতে এসে এই প্রান্তরে এসে মিলিত হন। এজন্য এর অন্য নাম আরাফাত বা মিলনস্থল।

আরাফাতের মাঠে দর্শনার্থীদের জন্য বাংলায় নির্দেশনা
আরাফাতের মাঠে দর্শনার্থীদের জন্য বাংলায় নির্দেশনা

আজ আমরা এসেছি ঐতিহাসিক আরাফাত প্রান্তরে। এই জায়গাটি মক্কা নগরী থেকে ২২ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর পূর্ব প্রান্ত তায়েফের সুউচ্চ পর্বতমালায় ঘেরা। বছরে মাত্র একদিন ৯ জিলহজ্জ হাজী সাহেবানরা হজ্বের সর্বপ্রধান অনুষ্ঠানে এখানে এসে সমবেত হন। আরাফাত ময়দানটি ১০ দশমিক ৪ কিলোমিটার বিস্তৃত। ময়দানটি তিনদিক দিয়ে পাহাড় বেস্টিত। এর দক্ষিণ পাশ দিয়ে রয়েছে মক্কা, হাদাহ তায়েফ রিং রোড। সড়কের দক্ষিণ পাশে সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উম্মুল কুরআ বিশ্ববিদ্যালয়। এই আরাফাতের মাঠে হাজী সাহেবগণ মধ্যাহ্নের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। সেদিন তাদের পরনে থাকে দুই প্রস্থ সেলাইবিহীন পোশাক। মুখে লাব্বায়েক ধ্বনি। আকুল হৃদয়ে সেদিন তারা রাব্বুল আলামিন-কে বলেন- আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোন শরীক নেই। সব প্রশংসা এবং নিয়ামত তোমার-ই এবং সব সা¤্রাজ্যই তোমার।
আরাফাত শব্দটি আরবী। এর অর্থ জানা, চেনা, পরিচয় ইত্যাদি। আরাফাত ময়দানের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে বেশী যে মতবাদটি প্রচলিত তা হলো- বেহেস্ত থেকে পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর বাবা আদম ও মা হাওয়া পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা একে অপরকে খুঁজতে খুঁজতে এসে এই প্রান্তরে এসে মিলিত হন। এজন্য এর অন্য নাম আরাফাত বা মিলনস্থল। অন্য একটি মতে আরাফাত শব্দটি আরাফ ধাতু থেকে এসেছে। এর অর্থ সুগন্ধি। কারণ আরাফাত প্রান্তর খোলামেলা এবং সুঘ্রানে ভরপুর। অপরদিকে মিনা হলো সেই জায়গা যেখানে ময়লা আবর্জনা ও কোরবানীর পশুর রক্ত জমা হয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ বলেছেন- যখন কোন ব্যক্তি ধৈর্যশীল ও আল্লাহ ভীরু হয় তখন তাকে বলা হয় আরেফ, ধৈর্য্যশীল ও আল্লাহ ভীড়– ব্যক্তি। ৯ জিলহজ্ব জোহরের পরে প্রচন্ড রৌদ্র তাপের মধ্যে হাজী সাহেবানরা যখন এই মাঠে তাবুর মাঝে অপেক্ষা করেন তখন তারা দু:খ-কষ্ট ও অসুবিধাসমূহ পরম ধৈর্য্যরে সাথে মোকাবেলা করেন। এখানে তারা অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল, ন¤্র, বিনয় ও আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এইজন্য দিনটিকে আরাফা এবং প্রান্তটিকে আরাফাত বলা হয়।
প্রান্তরটির নামকরণ নিয়ে আরেকটি মতবাদ রয়েছে তাহলো- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মোমিন মুসলমানগণ একে অপরকে খুঁজতে থাকেন। এজন্য এই প্রান্তরটিকে আরাফাত প্রান্তর বলে আখ্যায়িত করা হয়। অন্য একটি বর্ণনায় আছে- এই ময়দানে জিবরাইল (আ:) হযরত ইব্রাহীম (সা:)-কে হজ্বের বিধিবিধান শিক্ষা দেয়ার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন- হাল আরাফতা। অর্থাৎ আপনি কি বুঝতে পেরেছেন। হযরত ইব্ররাইম (আ:) বলেন হাঁ। এরপর থেকেই এই ময়দানের নাম হয়েছে আরাফা। এই আরাফাতে উপস্থিত না হলে জ্ব পূর্ণ হবে না। তাই হজ্বে এসে যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন তাদেরও অ্যাম্বুলেন্স করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হয় স্বল্প সময়ের জন্য।
এই ময়দানে এসে বারবার শিহরিত হচ্ছিলাম। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে কিশোর বয়সে মায়ের হাত ধরে এই আরাফাতের মাঠে এসেছিলাম। অদেখা পৃথিবীর এক আনন্দ খুঁজছিলো সেদিন আমার চোখ। আজ পরিণত বয়সে এসে নতুন করে যেনো সব আবিষ্কার করছিলাম। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে এই ময়দানে রাসুল (সা:) লক্ষাধিক সাহাবীকে সামনে রেখে বিদায় হজ্বের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ময়দানেই ইসলামের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে কোরআনের আয়াত নাজিল হয়েছিলো।
এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে এলাম জাবালে রহমতে। জাবাল অর্থ পাহাড়। জাবালে রহমত হলো রহমতের পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে একটি সাইনবোর্ডে বিভিন্ন ভাষায় দিক নির্দেশনা রয়েছে। কি করা যাবে বা কি করা যাবে না, দর্শনাথীরা যেনো বেদাতে অংশ না নেন তার নির্দেশনা। বাংলা-তেও এই সাইনবোর্ড দেখে ভালো লাগলো। পাহাড়ে উঠার জন্য সিঁড়ি তৈরী করা হয়েছে। সিঁড়িগুলো বেশ প্রশস্থ। পাহাড়ের উপরে একটি সাদা রং এর পিলার। আরাফাতের মাঠের চারিদিকে যেহেতু পহাড় তাই জাবালে রহমত চিহ্নিত করার জন্য এই পিলার তৈরী করা হয়েছে। এই পাহাড়ের পাদদেশে রাসুল (সা:) হজের খুৎবা ও বিদায় হজ্বের ভাষণ দিয়েছিলেন। জাবালে রহমতের আশেপাশে প্রচুর পুলিশের দেখা পেলাম। তারা দর্শনার্থীদের নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। যেনো পিলারটি জড়িয়ে না ধরেন, পিলারে যেনো চুমু না খান ইত্যাদি। রহমতের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে নিজের জন্য, স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সর্বপরি দেশের জন্য দোয়া করে নীচে নেমে এলাম।
মক্কায় আমার গাইড হিসেবে কাজ করেন সিলেটের তারিফ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করেন এবং জিয়ারতের কাজ করেন। তিনি যেসব জায়গা চিনেন তা গতানুগতিক। আমি যতবার যাই হোম ওয়ার্ক করে তাকে নিত্য-নতুন জায়গার হদিস দিতে বলি। তিনি তা খুঁজে বের করে রাখেন এবং পরের বার এলে আমাকে সেখানে নিয়ে যান। গতবার এসে তার কাছে নহরে জোবায়দার খোঁজ জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এটা তার জানা না থাকায় বলেছিলেন- তিনি খুঁজে রাখবেন এবং পরেরবার নিয়ে যাবেন। এবার আরাফাতের মাঠে আসলে তিনি জানান যে, নহরে জোবায়দার খোঁজ তিনি পেয়েছেন এবং আরাফাত মাঠের এক পাশে এখনো তার চিহ্ন রয়েছে। জাবালে রহমত দেখা শেষ করে তার সাথে আমরা নহরে জোবায়দা দেখতে গেলাম।
নহরে জোবায়দা নিয়ে একটি কাহিনী রয়েছে। বেগম জোবায়দা ছিলেন বাগদাদের খলিফা হারুন-অর রশীদের স্ত্রী। একদিন রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য লোক এসে তার সাথে দৈহিক মিলন করে পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এই স্বপ্ন দেখে তিনি ঘৃণা, লজ্জা এবং চিন্তায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি তার বিশ্বস্ত বাদীকে সা¤্রাজ্যের প্রধান কাজীর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে পাঠালেন। বাদী বেগম জোবায়দার আদেশ অনুযায়ী স্বপ্নটি নিজে দেখেছে বলে উল্লেখ করে। কাজী সাহেব তখন তাকে বললেন- এই স্বপ্নটি তুমি কখনো দেখতে পারো না। যে দেখেছে তার নাম বলো, নাহলে এর ব্যাখ্যা দেয়া যাবে না। অগত্যা বাদী ফিরে গিয়ে বেগম সাহেবার অনুমতি নিয়ে এসে তার নাম জানালেন। অতপর কাজী সাহেব বললেন যে, বেগম সাহেবা দ্বারা এমন একটি মহৎ কাজ সাধিত হবে যা দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের লোক উপকৃত হবেন। পরবর্তীকালে বেগম জোবায়দা হজ্বের সময় হাজীদের কষ্ট দূর করার জন্য মক্কা শরীফ থেকে মদিনা শরীফ পর্যন্ত বিরাট একটি খাল খনন করে দিয়েছিলেন যা নহরে জোবায়দা নামে পরিচতি ছিলো। আব্বাসীয় খেলাফত পর্যন্ত এই নহরটির অস্তিত্ব ছিলো। কালের বিবর্তনে সে নহরটি আজ আর নেই। কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে। নহরে জোবায়দার একটি অংশ রয়েছে মসজিদে নামিরার পাশে। কিছু অংশ আরাফাত প্রান্তরে। আমরা তারিফের সাথে নহরে জোবায়দার কিছু অংশ দেখে আবার বাসের কাছে ফিরে এলাম।