Categories
ইউরোপ

মেরুজ্যোতি দর্শন

আজ সারাদিন আইসল্যান্ডে অনেক দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেরিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই শরীর ক্লান্ত ও অবসন্ন। কিন্তু আজ রাতেই মেরুজ্যোতি বা অরোরা বোরিয়ালিস দেখার টিকিট কেটে এসেছিলাম নিউইয়র্ক থেকে। মূলত: এবার ইউরোপ ভ্রমণে আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিলো এই মেরুজ্যোতি দর্শন। আকাশ জুড়ে আলোর খেলা দেখা।
রাত ৯টায় গাইড এসে তুলে নিলো হোটেল থেকে। আগেই বলা ছিলো প্রচুর গরম জামা কাপড় পরে যাওয়ার জন্য। সবাই তা করেছি। কফি মগে করে সাথে নিয়েছি হোটেল কর্তৃপক্ষের দেয়া ধূমায়িত কফি। অনেক বড় বাস। পুরোটাই পর্যটক ভর্তি। সারা বিশ্বের নানা দেশ থেকে পর্যটকরা সমবেত হয়েছেন মেরুজ্যোতি দর্শনে।
গাইড প্রথমেই ব্রিফ করলো মেরুজ্যোতি সম্পর্কে। সুমেরু প্রভা বা মেরুজ্যোতি পৃথিবীর বায়ু মন্ডলে গ্যাসিয় কনাগেুলোর সাথে সূর্যালোকের সংঘর্ষের কারণে চার্জযুক্ত কনার ফলাফল। বাতাসে অক্সিজেন কনা একে অপরের সাথে যুক্ত হলেই সৃষ্টি হয় অরোরার আলো। আলোর রং বাতাসের কনা ও একে অপরের সাথে প্রতিক্রিয়ার ফল। অক্সিজেনের কারণে তৈরী হয় সবুজ বা গাঢ় লাল রং। নাইট্রোজেন থেকে উৎপন্ন হয় নীল ও লাল রং এবং হিলিয়াম থেকে হয় নীল ও গোলাপী রং। গাইড আরো জানান, আলোর এই খেলা চলে প্রায় ৬২০ মাইল উচ্চতায়। সুমেরু প্রভার দৃশ্য দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
এই একাডেমিক কথা-বার্তা শুনতে ভালো লাগছিলো না। ভাবছিলাম ভাগ্য প্রসন্ন হলে নিজের চেখেই সুমেরু প্রভা দেখে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবো।
পেটভর্তি পর্যটক নিয়ে বাস ছুটে চলেছে সুমেরুপ্রভা দর্শনে। ভিউ পয়েন্টটা শহর থেকে বেশ দূরে নির্জন জায়গায়। শহরের আলো যাতে না পৌছায় তাই এই লোকেশন নির্বাচন। গাইড জানালো, মেরু প্রভা দেখতে কয়েকটি শর্তের প্রয়োজন। প্রথমত: মেরু বলয়ের মধ্যে সুমেরুর খুব কাছাকাছি জায়গা থেকে মেরু জ্যোতি দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত প্রচন্ড শীতের রাত হবে হবে। তৃতীয়ত: অন্ধকার যত বাড়বে, আলোর বিচ্ছুরণ খালি চোখে তত বেশী দেখা যাবে। সর্বোপরি আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার হতে হবে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ বা ¯েœা পড়লে মেরু জ্যোতি দেখা সম্ভব হবে না। যেজন্য মেরু জ্যোতি বা সুমেরু প্রভা দেখা অনেকটা ——– ্আর এ জন্য অনেককে রাতের পর রাত অপেক্ষা করতে হয়।
গাইডের কথা শুনে মনটা দমে গেলো। নিউইয়র্ক থেকে আইসল্যান্ডে উড়ে এসেছি মেরু জ্যোতি দেখবো বলে। হাতে সময় কম, ইউরোপের অন্য দেশও ভ্রমনের প্রোগ্রাম রয়েছে। আমাদের হাতে মাত্র আজকের রাতটিই। আজ যদি মেরু জ্যোতি দেখা না হয়, তাহলে আফসোস নিয়ে ফিরে যেতে হবে নিউইয়র্কে।
নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে বাস থামলো। জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। মূল রাস্তা থেকে বেশ ভিতরে। তবে, একটু দূরে একটা ভবন। যা প্রচন্ড শীত থেকে বাঁচার আশ্রয়স্থল। বাথরুমের ব্যবস্থা আছে। আর আছে গরম কফির ব্যবস্থা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যটক জমায়েত হয়েছে এখানে মেরু জ্যোতি দেখার আশায়। অনেক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ ছুটে যাচ্ছেন পাশের ভবনে চা-কফি খেয়ে শরীর চাঙ্গা রাখার জন্য। আমার গ্রুপের বয়ষ্ক পুরুষ-মহিলাদের পাঠিয়ে দিলাম ভবনে বিশ্রাম নিতে। বললাম- মেরু জ্যোতির দর্শণ পেলে তাদের ডেকে নিয়ে আসবো।
রাত প্রায় দুটো বাজে। প্রচন্ড ঠান্ডায় শরীর জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবুও মেরু জ্যোতির দেখা নেই। হতাশ হয়ে ইতোমধ্যে দু-একটি বাস চলেও গেছে। হয়তো তারা পরদিন আসবে। আমাদের গাইড-ও বাসে উঠার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো। তাকে অনুরোধ করলাম, আরো কিছু সময় থেকে যাওয়ার জন্য।
শীতের কামড় থেকে বাঁচতে ভেতরে গিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে সবে চুমুক দিয়েছি। এমন সময় শুনি বাইরে থেকে চিৎকার- ‘অরোরা! অরোরা!’ কফি কাপ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেলাম বাইরে। দেখলাম- উত্তর আকাশে একটা সাদা আলোর রেখা। একটু পর দেখা দিলো চোখ ধাঁধানো তীব্র দ্যূতি ছড়ানো এক সবুজ আলোর নৃত্য। একটু পর রং বদলিয়ে গোলাপী ও হালকা হলুদ রং। মনে হচ্ছিলো প্রকৃতির এক লেজার বিম শো উপভোগ করছি আইসল্যান্ডের উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে।
উপস্থিত পর্যটকরা তখন আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। চারিদিকে ক্যামেরার শাটারের শব্দ। কেউ কেউ অরোরা-কে ক্যমেরার লং এক্সপোজারে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
সুমেরু প্রভার ¯িœগ্ধ আলো প্রচন্ড শীতের কষ্ট একেবারেই ভুলিয়ে দিলো। অবিস্মরণীয় এই মুহুর্তটি কোনদিন ভুলার নয়। মনভরা একরাশ তৃপ্তি নিয়ে বাসে গিয়ে বসলাম। কাল প্রসন্ন চিত্তে রওনা দেবো নেদারল্যান্ডের দিকে।

Categories
ইউরোপ

অপরূপ আইসল্যান্ড

আইসল্যান্ডে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন। দিনে রাতে ঠাসা ট্যুর প্রোগ্রাম। সকাল ৯টা থেকে শুরু হবে গ্রান্ড গোল্ডেন সার্কেল ট্যুর যা শেষ হবে বিকাল ৫ায়। আগ্নেয়গিরির ক্রেটার, হট স্প্রিং, গাইজার, জলপ্রপাতসহ আরো নানা কিছু আছে দর্শনীয় তালিকায়। আর রাতের বেলায় নর্দান লাইটস ট্যুর।
সকাল ৮.৩০ মিনিটে সবাই হোটেলের লবিতে গিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। ট্যুর গাইড আমাদের তুলে নিলো কাঁটায় কাঁটায় ৯টায়।
বিরাট বাস। পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ উঠেছে এই বাসে। সবাই মিলে সারাদিন ঘুরে দেখবো আইসল্যান্ড। আমাদের সুদর্শন চটপেেট গাইডের নাম জন পোরসন। জন নামে ডাকলেই হবে জানালো সে। উচ্চারণ সহজ। আরো কয়েকটা হোটেল ঘুরে সবাইকে বাসে উঠিয়ে শুরু হলো যাত্রা।
টিপিক্যাল ট্যুর গাইডের মত শুরু হলো তার বক্তৃতা। প্রথমেই আইসল্যান্ডের ইতিহাস জানালো। দ্বীপটির প্রায় ১১ শতাংশ হিমবাহ দ্বারা আবৃত। দ্বীপের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা পশু চারণের জন্য ব্যবহার করা হয়। আর মাত্র ১ শতাংশ এলাকায় হয় কৃষিকাজ। ৯০০ খ্রীষ্টাব্দে দ্বীপটিতে মানুষ বসতির আগে দ্বীপটির প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ বৃক্ষ আচ্ছাদিত ছিলো। বর্তমানে কেবল কিছু বার্চ গাছের জঙ্গল ছাড়া আর তেমন কোন বনভূমি অবশিষ্ট নেই।
আরো কিছু মজার তথ্য দিলো গাইড জন। তা হলো আইসল্যান্ডে কোন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী কিংবা বিমান বাহিনী নেই। দেশটির পুলিশ নিজেদের সাথে কোন অস্ত্র রাখেনা। কারণ এখানে অপরাধ খুবই কম হয়। তাছাড়া দেশটি এতটাই পরিষ্কার যে সেখানে কোন মশা নেই। দেশটিতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও নেই। আইসল্যান্ডের মানুষ আইসক্রীম খেতে ভীষণ পছন্দ করে। এতটাই পছন্দ করে যে, তারা কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও আইসক্রীম খেয়ে থাকে। জাতিসংঘের প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুযায়ী আইসল্যান্ড বিশে^র মধ্যে তৃতীয় সুখী দেশ।
বাস প্রথমে এসে থামলো একটি চার্চের সামনে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে একটা জিনিস আমি দেখেছি সে সব দেশে প্রতিটি ট্যুর প্রোগ্রামে চার্চ দর্শন অন্তর্ভূক্ত থাকে। চার্চগুলোর যেমন রয়েছে ইতিহাস তেমনি আছে নান্দনিক স্থাপত্য। তাই সেগুলো দর্শনীয় তালিকায় পড়ে।
আমাদের যে চার্চটি দেখাতে নিয়ে আসা হলো তার নাম হলগ্রিমিস্কিকা চার্চ। লুথারর্ণ সম্প্রদায়ের এই চার্চটি আইসল্যান্ডের সবচেয়ে বড় চার্চ এবং দেশটির সবচেয়ে লম্বা স্থাপত্য। এর অবস্থান রিকজাভিকের একেবারে মধ্যভাগে। তাই দেখা যায় যে কোন অংশ থেকে। গাইড জানায় ৪১ বছর সময় নিয়ে এই চার্চটি তৈরি করা হয়। পাথরের তৈরি লম্বা লম্বা কলাম একটি আর একটির সাথে লাগানো। দুই পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট কলাম এবং ধীরে ধীরে মাঝপথে উঁচু লম্বা কলাম একসাথে হয়ে দেয়াল আকৃতির একটা উঁচু পাহাড়ের রূপ ধারণ করেছে। চার্চটির নামকরণ করা হয়েছে আইসল্যান্ডের কবি Hallgrimur Petursson এর নামে।
বাস ছুটে যাচ্ছিলো মসৃন পথ ধরে। রাস্তায় দুধারের মাঠে কালো কুচকুচে এবড়ো থেবড়ো পাথর। গাইড জানালো এগুলি আগ্নেয়গিরির লাভা গলে এই কালো পাথরে পরিণত হয়েছে। এই পাথুরে জমিতে কোন ফসল উৎপন্ন হয় না। এক ধরনের গুল্ম জাতীয় ঘাস দেখা গেলো এখানে সেখানে। স্থানীয় ভাষায় এগুলোকে বলা হয় ‘মস’। আর এগুলি ঘোড়ার প্রিয় খাবার। মাঝে মাঝেই ঘোড়ার পালের দেখা মিললো এসব জমিতে। অনেক সময় দাড়িয়ে থাকা ঘোড়াগুলোকে স্টাচু বলে ভ্রম হয়।
আমরা চার্চ দেখে রের হতেই হুড়মুড় করে শুরু হলো বৃষ্টি। অথচ হোটেল থেকে যখন আমরা বাসে উঠি তখন আকাশ ছিলো নির্মেঘ, সমগ্র আকাশে ছিল ছোট ছোট সাদা ভেলার ছড়াছড়ি। অবশ্য আমি এবং আমার গ্রুপের পূর্ব প্রস্তুতি ছিলো আগে থেকেই। সবাইকে ছাতা সাথে রাখতে আগেই বলে দিয়েছিলাম। আইসল্যান্ড আসার আগে আমি হোম ওয়ার্ক করে এসেছিলাম। তাতে জেনেছি এখানের আবহাওয়া ক্ষনে ক্ষনে পাল্টে যায়। মুহূর্তে মুহূর্তে চলে রোদ বৃষ্টির খেলা। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে কৌতুক প্রচলিত আছে তা হলো “আবহাওয়া তোমার পছন্দ না হলে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো”। অর্থাৎ আইসল্যান্ড এমনই একটা জায়গা যেখানে সূর্যের তাপে ত্বক পুড়ে যাবে আবার একটু পরেই ঝমঝম বৃষ্টি আপনার গা ভিজিয়ে দিবে।

গুলফস জলপ্রপাত
গুলফস জলপ্রপাত

এরপর বাস এসে যেখানে থামলো তার নাম ‘বিয়ার নারফেল’। এখানে আছে একটি গরম পানির ঝর্ণা যা থেকে সব সময় বুদ বুদ উঠছে। একটু পরেই এই গরম পানি উঠে আছে অনেক উচ্চতায়। প্রাকৃতিক এই উষ্ণ প্রবাহকে ইংরেজীতে বলে গাইজার।
বাসে উঠার পর গাইড ঘোষণা দিলো আমাদের পরবর্তী স্টপেজ হবে এটা জলপ্রপাত। আমি নায়াগ্রার দেশের মানুষ। এছাড়াও সুইজারল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনেক সুন্দর সুন্দর জলপ্রপাত দেখেছি। তাই তেমন কোন আগ্রহ ছিলো না জলপ্রপাত দেখার। কিন্তু গাইডের পীড়াপীড়িতে নামলাম। জলপ্রপাতের তীরে এসে বুঝতে পারলাম, না আসলে অনেক মিস করতাম।
প্রপাতটির নাম ‘গুলফস’। অর্থাৎ সোনালী জলপ্রপাত। সূর্যের আলোর প্রতিফলনে জলপ্রপাতটিকে সোনালী রং এর মনে হচ্ছিলো। প্রপাতে জল আসছে আইসল্যান্ডের অগণিত হিমবাহের জল গলে। প্রপাতের গর্জন, কুয়াশার মত জলের কণা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল।
দুপুরে বাস থামলো একটা মলের সামনে। লাঞ্চের পর কিছুটা ফ্রি সময় কেনাকাটার জন্য। আইসল্যান্ডের ভেড়ার মাংস খুব বিখ্যাত। আমার গ্রুপের প্রায় সবাই ভেড়ার মাংসের স্যুপ এবং পাউরুটির অর্ডার দিলো। হালাল হারাম বিবেচনায় আমি বিদেশে সাধারণত মাংস খাই না। তাই সামুদ্রিক মাছের স্যান্ডউইচ অর্ডার দিলাম। এর পরে স্থানীয় খাবার ‘স্কীর’। এটা হলো ঘন দই এবং খেতে খুব সুস্বাদু।
খাওয়া দাওয়া এবং কিছু কেনাকাটার পর গাইড আমাদের নিয়ে এলো ‘থিংভেলি ন্যাশনাল পার্কে’। অপূর্ব সৌন্দর্য্য মন্ডিত এই পার্ক। গাঢ় নীল রংয়ের একটা লেক রয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। গাইড জানালো পৃথিবীর উপরের স্তরটা অনেকগুলো প্লেট ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে জোড়া লাগালে যেমন হয় অনেকটা সেরকম। এই প্লেটগুলোকে বলে ‘টেকটনিক প্লেট’। এই প্লেটগুলি যখন এদিক ওদিক নড়াচড়া করে তখনই হয় ভূমিকম্প। এই রকম দুটো প্লেট সেখানে জোড়া লেগেছে। তার ঠিক উপরে বসে আছে আইসল্যান্ড দেশটা আর প্রতিবছর এই প্লেটগুলো বাইরের দিকে এক ইঞ্চি করে সরে যাচ্ছে। আর মাঝের সেই ফাটল ভরে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির লাভা জমে যাওয়া পাথরে। থিংভেলী ন্যাশনাল পার্কের এক জায়গায় দু’দিকের প্লেটের সেই ফাটল দেখালো গাইড। এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে যেন কুয়াশায় ঘিরে আসছে চারদিক। শীতও পড়ছে জাঁকিয়ে। হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতে আবার বেরোতে হবে সুমেরু প্রভা বা অরোরা বোরিয়ালিস দেখার জন্য।

Categories
ইউরোপ

আমস্টারডাম-এক শহরে দুই দুনিয়া

আমস্টারডাম-নেদারল্যান্ডের রাজধানী। শহরটির যেমন রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তেমনি রয়েছে আধুনিক জগতের সমস্ত আকর্ষণ। পুরো শহরে রয়েছে ১৬৫টি খাল। ৯০টি ছোট-বড় দ্বীপ। যেগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত রয়েছে ২৮১টি সেতুর মাধ্যমে। ৬,৮০০ ঘরবাড়ী রয়েছে শহরটিতে। এরমধ্যে ১৬ শতক থেকে বিংশ শতাব্দীতে তৈরী বাড়ীঘর যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু অত্যাধুনিক স্থাপনা। নতুন-পুরনোর মিশেলে একাকার এই আমস্টারডাম। ৫০টি দেখার মতো যাদুঘর রয়েছে এই শহরে। এরমধ্যে ভ্যানগগ যাদুঘর এবং রিক্স যাদুঘরটি খুবই বিখ্যাত। এছাড়াও জলে ভাসা বসতবাড়ি, প্রকাশ্য রেডলাইট ডিষ্ট্রিক্ট, গুঞ্জিকা সেবনের বৈধতা, স্থাপত্য বৈশিষ্ট সবকিছু মিলিয়ে আমস্টারডাম সব মানুষের আকর্ষণ। বলা যায় এক শহরে যেনো দুই দুনিয়া। আর এ জন্যই শহরটি সারা বছর সারাবিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
আমস্টারডাম-কে খালের জন্য উত্তরের ভেনিস-ও বলা হয়। গত বছর ইতালীর ভেনিস শহর ঘুরে এসেছি। তাই উত্তরের ভেনিসটা দেখার আগ্রহ ছিলো। এবারের ইউরোপ ট্যুরে ভ্রমণের তালিকায় প্রথমেই অন্তর্ভূক্ত করেছিলাম আমস্টারডাম-কে।
ভ্রমণটা শুরু হয়েছিলো আইসল্যান্ড দিয়ে। আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকজাভিক-এর দর্শনীয় স্থানগুলো পরিভ্রমণ করে ওয়াও এয়ারলাইন্সের বিমানে চড়ে আমস্টারডাম-এর শিফল বিমানবন্দরে যখন পা রাখলাম তখন বেলা দুটো। আগেই জেনেছিলাম ব্যস্ত বিমানবন্দরটি সমুদ্র সমতল থেকে ১১ ফুট নীচে। তবে বাইরে থেকে তেমন কিছু বুঝা যায়নি।
শিফল বিমানবন্দরের নামেরও একটি ইতিহাস রয়েছে। এক তথ্যমতে ‘শিফ হল’ অর্থ জাহাজের নিরাপদ ঘর। অন্য ভাষ্যমতে- প্রাচীন ডাচ ভাষায় ‘হল’ মানে সমাধি। অর্থাৎ জাহাজের সমাধি। আবার কারো মতে শব্দটি এসেছে ‘শিফ হেল’ অর্থাৎ জাহাজের নরক থেকে। যেখানে প্রায়ই জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটতো।
শিফল বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে বেরুতেই ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ঘিরে ধরলো। অনেকটা লাগেজ নিয়ে টানাটানি। এদের মধ্য থেকে বয়স্ক মতো একজনকে বেছে নিয়ে উঠে পরলাম ট্যাক্সিতে। গাড়ী ছুটে চললো নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম-এর পথে।
১৫/২০ মিনিট হাইওয়ে ধরে চলার পর ট্যাক্সিটি সরু পথ ধরে নেমে গেলো। একে-বেঁকে রাস্তা ধরে চলছিলো ট্যাক্সি। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিলো- মিটারে বেশী ভাড়া তুলতে ড্রাইভার ঘুরপথে যাচ্ছে। পরে আবশ্য এ ধারণাই ঠিক হয়েছিলো। নিয়মিত ভাড়ার চেয়ে দেড়গুণ ভাড়া আদায় করেছিলো সে। আমার হোটেল রিসেপসনিষ্ট একথাই বলেছিলো।
হোটেলে চেক-ইন করেই তাড়াহুড়া করে ছুটলাম আমাদেও গ্রুপের জন্য ট্যুর প্রোগ্রামে যোগ দেয়ার জন্য। দিনব্যাপী একটি ওয়াকিং ট্যুর বুক করেছিলাম আগেভাগেই নিউইয়র্ক থেকে। ওয়াকিং ট্যুর-এর মাধ্যমে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই দেখা যায়। ট্যুর গাইড যতক্ষণ হাঁটতে থাকে ততক্ষণ সে চারপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোর ধারা বর্ণনা করতে থাকে, যা ট্যুরিস্টদের কাছে হয় উপভোগ্য ও আকর্ষণীয়। হোটেল রিসেপশন থেকে জানিয়েছিলো গাইডের সাথে আমাদের মিটিং প্লেসটা খুব দূরত্বে নয়। হাঁটা পথে ২০ মিনিটের মতো। তবে সময়-স্বল্পতার জন্য অচেনা দেশে কোন রিস্ক নিতে চাইনি। এজন্য ট্যাক্সি নিয়ে যথাসময়ে পৌছে গেলাম সঠিক ঠিকানায়।
ওয়াকিং ট্যুরটার সদস্য ছিলো অনেক। নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষ। দুই গ্রুপে ভাগ করে দুজন গাইড নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। আমাদের ভাগের ট্যুর গাইডের নাম মারিয়া। বয়স ৩০-এর কোঠায়। অধ্যাপনা করেন একটা কলেজে, আর পার্ট টাইম ট্যুর গাইড। তাকে নিয়ে শুরু হলো আমাদের হাঁটাপথে আমস্টারডাম নগর ভ্রমণ।
টিপিক্যাল গাইডদের মতো প্রথমেই নেদার‌্যান্ড নিয়ে একটা বড় লেকচার দিলো মারিয়া। নেদারলান্ড শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘নি¤œভূমি’। উত্তর ও দক্ষিণ হল্যান্ড নামে দুটো প্রদেশ নিয়ে গঠিত নেদারল্যান্ড। নিয়মিত বন্যার কবলে পড়া শহরটিকে বাঁধ দিয়ে সুরক্ষিত করে বহু বছরের চেষ্টায় গড়ে তোলা হয় বর্তমান আমস্টারডাম। শহরটির মূল কেন্দ্রবিন্দু ড্যাম্স স্কোয়ার নামের বিশাল চত্বরটি উন্মুক্ত হয় ১২৭০ সালে আমস্ট্যাল নদীতে বাঁধ তৈরী করার পর। এরপর জলের তলায় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে তৈরি করা হয় বাড়িগুলো। আর এভাবেই গড়ে উঠে আমস্টারডাম-এর নগর স্থাপত্য।
আমস্ট্যাল নদীর মোহনায় আমস্টারডম শহর। এটি ক্যানেলের মাধ্যমে উত্তর সাগরের সাথে সংযুক্ত। আমস্টারডাম-এর খালের পাড় ঘেষে বাড়িঘরগুলো। প্রতিটি বাড়ী একটি সাথে আরেকটি লাগোয়া। একই উচ্চতায় একই রকম বাড়ী। গাইড জানালো, জলের আগ্রসন ঠেকিয়ে জাগিয়ে তোলা মাটির মধ্যে সহ্য ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে ১৫০০ শতক থেকে এধরনের বাড়ি নির্মানের অনুমতি দেয় সরকার। বাড়িগুলো যেন বেশী ওজন না হয়, সেজন্য একই ধরনের পরামর্শ দেয়া হয় এবং তা নজরদারীও করা হয়। এসব বাড়িগুলোতে স্থানীয়রা আদর করে বলে ড্যান্সিং হাউজ। আমস্টারডাম-এর এসব বাড়িগুলো বেশীরভাগ কমবেশী সামনের দিকে হেলানো। কারণ হিসেবে গাইড জানায় বাড়িগুলোর উপর তলায় উঠার জন্য সিড়িগুলো হচ্ছে সরু। আর সেগুলো দিয়ে বড় কোন আসবাসপত্র উঠানো প্রায় অসম্ভব। তাই দড়ি বেঁধে যাতে জানালা দিয়ে উঠানো যায়, সেজন্যই বাড়িগেুলো সামনের দিকে হেলিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
এরপর গাইড আমাদের নিয়ে এলো ভ্যানগগ যাদুঘর পরিদর্শনে। আমস্টারডাম-এ সবচেয়ে বেশী পর্যটক আসেন এই যাদুঘরে। ভ্যানগগের চিত্রকর জীবনের শুরু থেকে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত যেসকল ছবি একেছেন এখানে ধারাবাহিকভাবে তা সাজানো আছে। ভ্যানগগের চিত্রকর্মের পাশাপাশি রেনেসাঁ ও ইম্প্রেসনিষ্ট যুগের মনে, মেতিস সহ অন্যান্য আরো কয়েকজন শিল্পীর বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম রয়েছে এই যাদু ঘরে।
যাদুঘরে ঢুকে প্রথমে আমরা উপভোগ করলাম শিল্পী ভ্যানগগের জীবন ও কর্ম নিয়ে তৈরী ৮ মিনিটের একটি প্রামাণ্য চিত্র। যাদুঘরের প্রথম তলায় মূলত: শিল্পীর পরিচিতি দিয়ে সাজানো। বিভিন্ন ছবি, আতœপ্রতিকৃতি ইত্যাদি। দ্বিতীয় তলায় তার পারিবারিক পরিচিতি, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ইত্যাদি। তৃতীয় তলাটি মুলত: বিখ্যাত কিছু সংগ্রহের। একপাশে জায়গা পেয়েছে শিল্পীর ভক্তদের আকাঁ কিছু ছবিও। এখানে ভ্যানগগের কিছু শিল্পকর্ম যেমন সানফ্লাওয়ার, দ্য স্টারি নাইট, পটেটো ইটার্স-এর মতো বিখ্যাত চিত্রকর্মও রয়েছে।
ভ্যানগগ যাদুঘর দেখতে দেখতে একটা ব্যাপার মনের কোনে বারবার উঁকি দিচ্ছিলো। গত কয়েক বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেখছি সেসব দেশের মিউজিয়াম, বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম। কিন্তু একটি ব্যাপারে সকল শিল্পীর ভাগ্য একই রকম মনে হয়েছে। তাহলো তাদের বেশীরভাগ জীবদ্দশায় যেমন নিজেরা মূল্যায়িত হননি, তেমনী আর্থিকভাবেও বিবেচিত হয়নি তাদের শিল্পকর্মগুলো।
আমি আজ ভ্যানগগ যাদুঘরের যেসব শিল্পকর্মগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেগুলোর এক একটির বর্তমান মূল্য ৬০/৬৫ মিলিয়ন ডলার। অথচ এই শিল্পী জীবদ্দশায় অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন। রং তুলি কেনার পয়সাও তাঁর জুটেনি।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রিক্স যাদুঘর। ভ্যানগগ যাদুঘরের পাশেই এর অবস্থান। বিশ্বখ্যাত ডাচ শিল্পীদের চিত্রকর্মের সংগ্রহ আছে এই যাদুঘরে। এরমধ্যে দুজন শিল্পী হচ্ছেন র‌্যামব্রান্ট এবং ভার্মিয়ার। এই মিউজিয়ামের সবচেয়ে বড়, মূল্যবান ও বিখ্যাত চিত্রকর্মটি শিল্পী র‌্যামব্র্যান্টের আকাঁ। দুজন পাহাড়াদার সবসময় ছবিটি আগলে রেখেছে। পুরো একটি ঘরে শুধু এই ছবিটিই রয়েছে। সবমিলিয়ে ১০ লক্ষাধিক চিত্রকর্ম রয়েছে এই যাদুঘরে। এরমধ্যে ৮ হাজার শিল্পকর্ম দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।
গাইডের সাথেই পায়ে হেঁটে আমরা আমস্টারডাম শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখছিলাম। একটু পর পর দেখছিলাম সাইকেল আরোহীদের সারি। তরুণ-তরুনী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউই বাদ নেই। ২/৩ বছরের বাচ্চাদের জন্য রয়েছে সাইকেলের পিছনে বা সামনে বসার বিশেষ ব্যবস্থা।
গাইড জানালো আমস্টারডাম শহরে মানুষের চেয়ে সাইকেল বেশী। দেশের প্রেসিডেন্টও নাকি সাইকেলে চড়ে অফিস করেন। সাইকেলের জন্য রয়েছে আলাদা লেন বা রাস্তা। এখানে-সেখানে প্রচুর দোকান রয়েছে, যেখানে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। পর্যটকরা চাইলে সাইকেল ভাড়া নিয়ে শহর ঘুরে দেখতে পারেন। ট্রেন অথবা ট্রামে সাইকেল নিয়ে উঠে পড়া যায়। তাছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে সাইকেলের জন্য রয়েছে সুবিশাল কয়েক তলা গ্যারেজ।
আমস্টারডাম শহরের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত কফি শপ। এইসব কফি শপে খাবার-দাবার, কফির সাথে মারিজুয়ানা, গাজা সহ বিভিন্ন ড্রাগস লিগ্যালি বিক্রয় হয়। গাইড জানালো এই কফি শপগুলোর টানেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণ-তরুনীরা ছুটে আসে আমস্টারডাম- যা ড্রাগ ট্যুরিজম নামে পরিচিত।
গাইড আরো জানায়, ওলন্দাজরা জাতি হিসেবে খুবই উদার। এই দেশে সমকামিতা বৈধ। কিন্ডারগার্টেন থেকেই বাচ্চাদের সেক্স সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়। এরা চায় বাচ্চারা যেনো সেক্স সম্পর্কে তাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালোমতো জানতে পারে।
ইতোমধ্যেই দলের সবার কয়েক ঘন্টা হাঁটা হয়ে গেছে। কিন্তু গাইডের আলাপ-আলোচনায় সবাই এতোটাই মগ্ন ছিলো যে কেউই ক্ষুধা-তৃষ্ণা টের পায়নি। গাইড-ই তা মনে করিয়ে দিয়ে আমাদের একটি খাবার দোকানে নিয়ে এলো। এখানে পাওয়া যায় স্থানীয় ডাচ ফুড। গাইড সবার মতামত নিয়ে অর্ডার দিলো আলু ভর্তা আর সবজি মিলিয়ে এক ধরনের ডাচ খাবার। সাথে ভেড়ার মাংস। শেষে আপেল কেক। যার যার পছন্দ মতো ড্রিংঙ্কস। যেহেতু বিদেশে আমি মাংস খাইনা, তাই বাকী খাবারগুলো খেলাম। টেষ্ট ছিলো দারুণ।
দিনের সবশেষে ছিলো নৌকা ভ্রমণ। জলযানে করে খালের পানিতে ভেসে বেড়ানো। আমাদের সাথের গাইড এই নৌকা ভ্রমণের দর্শক কারণ এখানে রয়েছে আলাদা গাইড। তিনি ইংরেজী এবং ডাচ ভাষায় ধারা বিবরণি দিচ্ছিলেন। খালের দুপাশে মধ্যযুগীয় বাড়ী-ঘরের সারি। এর অনেকগুলোর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। গাইডের বর্ণনায় তাই উঠে আসছিলো। আর আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম।