কেউ বলে জ্বীনের পাহাড়। কেউ বলে যাদুরর পাহাড়। ইউরোপীয়ানরা বলে ঘোষ্ট ভেলী। আর আরবদের কেউ ডাকে ওয়াদি আল আবইয়াজ, ওয়াদিয়ে জ্বীন, ওয়াদি রাজা। কেউ বা অন্য কোন নামে। তবে যে নামেই পরিচিত হোক না কেনো এটি পৃথিবীর এক অবাক বিস্ময়। এখানে সবকিছু ঢালুর বিপরীতে গড়ায়। মানে সাধারণ নিয়মের সব উল্টো। এখানে হার মেনে যায় বিজ্ঞানের সব সূত্র। দুনিয়া জোড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতো প্রসারের পরেও আজ অবদি এই অপার রহস্যের উদঘাটন করতে পারেনি কেউ। আজো বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছে এই অদৃশ্য শক্তির পাহাড়।
জায়গাটি সৌদী আরবের মদীনা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। সেই জ্বীনের পাহাড় দেখবো বলে নিউইয়র্ক থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে গিয়েছিলাম।
আগেরদিন মদীনার আশেপাশে অনেকগুলো ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখেছি। সেগুলোর মধ্যে ছিলো বদর, ওহুদ এবং খন্দকের যুদ্ধ ক্ষেত্র। বীরে রোহা, জবলে মালাইকা, জান্নাতুল বাকী, মসজিদে কুবা, মসজিদে কেবলা তাইন, মদীনা গভর্নর হাউজ সহ আরো অনেক ঐতিহাসিক স্থান। গাইডকে বলা ছিলো আজ জ্বীনের পাহাড় দেখতে যাবো। কথামত তিনি সকাল ৬টায় এসে আমাকে হোটেল থেকে উঠিয়ে নিলেন।
মদীনায় আমার গাইডের নাম এরশাদ উল্লাহ। বাড়ী ঢাকার গাজীপুরে। ৩৫ বছর ধরে বসবাস করছেন নবীর শহর মদীনায়। তার কাজ হজ বা ওমরাহ করতে আসা লোকদের ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখানো। বলা যায় সৌদি আরবের বেশীর ভাগ জায়গা তার হাতের তালুর মতো চেনা।
গাড়ী চলছে রাজপথ ধরে। দুপাশে কালো কালো পাথরের পাহাড়। পাহাড়ের কাছ দিয়ে শুকনো পানি শূন্য খাল। গাড়ীর আওয়াজ ছাপিয়ে কানে আসছে আমার গাইডের ধারা বর্ণনা। ওয়াদি বলা হয় পানি জমা হওয়ার ছোট ছোট খাল-কে। এই খালে বৃষ্টির সময় পানি জমা হয়। আর সে পানি খুব মিষ্টি।
একটু পর পর খেজুর বাগান। পাশেই ন্যাড়া পাহাড়। পাহাড়ের উপর ধারালো সূচের ন্যায় পাথর। এমন পাহাড় নাকি শুধুমাত্র এই এলাকায়-ই। সৌদি আরবের অন্য কোথাও এ ধরনের পাহাড় চোখে পড়ে না। পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা সড়ক। আর সেই সড়কেই লুকিয়ে আছে অপার বিস্ময়।
এরশাদ উল্লাহ জানান, ২০০৯-১০ সালের দিকে সৌদি সরকার এই এলাকায় রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত কাজ করার পর সমস্যা শুরু হয়। হঠাৎ দেখা যায় রাস্তা নির্মাণের যন্ত্রপাতি আসে আস্তে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মদিনা শহরের দিকে চলে যাচ্ছে। কোন অদৃশ্য শক্তিগুলো যেনো যন্ত্রপাতিগুলোকে মদীনার দিকে ঠেলছে। এমনকি পিচ ঢলাইয়ের ভারী রোলারগুলো বন্ধ থাকা অবস্থায় আস্তে আস্তে ঢালু বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। এসব দেখে কর্মরত শ্রমিকরা ভয় পায়। এবং তারা কাজ করতে অস্বীকার করে। ফলে রাস্তা নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তাটি ২০০ কিলোমিটার করার কথা থাকলেও মাত্র ৩০ কিলোমিটার করেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়।
দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটি মদিনার দিকে চলে গেছে এটি ক্রমেই উঁচুতে উঠে গেছে। কিন্তু অবাক করা কান্ড হলো গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেও গাড়ী উচুঁ পথের দিকে চলতে থাকে। আরো একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই সড়কের একেবারে শেষ প্রান্তে প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কে গাড়ী চলতে কোন তেল লাগে না। ইঞ্জিন বন্ধ অবস্থায়ও গাড়ী চলতে থাকে ১০০ মিটার বেগে।
গাইড এরশাদ উল্লাহ তার পা গাড়ীর এক্সেলেটর থেকে তুলে সীটের উপর রাখলেন, ইঞ্জিন নিউট্রাল করে দিলেন। অবাক কান্ড স্পীড মিটার ক্রমেই ১৪০ মিটার বেগে গাড়ীর গতি দেখাচ্ছিলো। এই রহস্যময় সীমার এক প্রান্তে এসে এরশাদ উল্লাহ গাড়ী থামিয়ে একটি পানির বোতল রাস্তার ওপর রাখলেন। কি অবাক করা কান্ড? পানির বোতলটি ঢালুর বিপরীতে গড়িয়ে যেতে লাগলো। বোতল থেকে পানি ঢাললাম, তাও বিপরীতেই গেলো।
কেউ কেউ বলে পাশের পাহাড়ে চুম্বক আছে, যা গাড়ীকে উল্টোদিকে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু আমরা সবাই জানি চুম্বক কেবলমাত্র লোহাকেই টানে। পানির বোতল, জুতা বা বোতল থেকে রাস্তায় পানি ঢাললে তাও ঢালের বিপরীতের দিকে গড়াতে থাকে। এ প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারেননি।
দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে রাস্তাটি যেখানে গিয়ে শেষ হয়ে ইউটার্ন নিয়ে ফের মদিনার দিকে চলে গেছে সেখানেই গাড়ী পার্ক করলেন এরশাদ। আমাকে সুযোগ দিলে দুইপাশের পাহাড়ের ছবি তোলার সুযোগ দিলেন। দেখলাম বেশকিছু শ্রমিক রাস্তা পরিষ্কার করার কাজ করছে। চেহারা সূরত দেখে বাঙালী বলে মনে হলো। কাছে গিয়ে আলাপ করতেই আমার কথার সত্যতা পেলাম। তাদের সবার বাড়ী বৃহত্তর কুমিল্লার চাঁদপুরে। দিনের বেলায় এখানে কাজ করেন আর সন্ধ্যায় চলে যান মদীনা শহরে। এই রাস্তাটা খোলা রাখা হয় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এরপর আর কোন গাড়ী বা মানুষকে এই এলাকায় আসতে দেয়া হয় না। কেউ এই এলাকায় থাকতে চাইলেও অনুমতি দেয়া হয় না।
তারা আরো জানান, এই এলাকার উল্টো রীতি নিয়ে বিভিন্ন ধরণের জনশ্রুতি আছে। তা হলো- এই
পাহাড়ের উপরে উঠে নবী করীম (সা:) জ্বীনদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তখন নাকি কিছু জ্বীন পালিয়ে যেতে চায়। তাই বয়স্ক জ্বীনরা তাদের পালানো ঠেকাতে পথ উল্টে দেয়। তাই এখানে সব কিছু উল্টা চলে।
তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। এরশাদ উল্লাহ জানান- বর্তমানে ওয়াদি আল জ্বীন এলাকটি পর্যটন স্পট হিসেবে ধীরে ধীরে পরিচিতি পাচ্ছে। স্থানীয় আরবরা এখানে ছুটির দিনে অবসর কাটাতে আসেন। এখানে ছোট ছোট গাড়ী ভাড়া দেয়ার দোকান গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে গাড়ী ভাড়া নিয়ে উল্টো পথে গাড়ী চলার অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়।
মদীনার রহস্যময় এই পাহাড় নিয়ে রীতিমত হৈচৈ চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক এখানে আসে এই জ্বীনের পাহাড় দেখতে। প্রতি বছর হজ্ব ও ওমরাহ করতে আসা মানুষও এই রহস্যময় জ্বীনের পাহাড় দেখতে ভীড় জমান।
বেলা যতই বাড়ছিলো প্রচন্ড তাপমাত্রায় অস্থির হয়ে উঠছিলাম। গাড়ীর এসিও মনে হয় কাজ করছিলো না। তাই রহস্যময় এলাকা থেকে মদীনার দিকে গাড়ী চালাতে এরশাদ উল্লাহকে অনুরোধ জানালাম।